কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবেই কেটে গেছিল...এই কদিনে ছোট্ট মেয়েটা যেন আমাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল....আর আমি বুঝতে পারছিলাম... শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না... মাতৃত্ব একটা অনুভুতি ...সেটা যার ভিতরে জেগে ওঠে বা যে জাগাতে পারে...তারা খুব অবলীলায় মা আর সন্তান হয়ে ওঠে... আমি মনে করি না আমি শ্রিয়ার জন্মদাত্রী মা'র থেকে শ্রিয়ার কাছে কম কিছু।.....অর্কও আমাদের রসায়ন দেখে ভীষন নিশ্চিন্ত আর খুশী ছিল।
আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলতো...."দেখেছো তো চিনি... আমি মানুষ চিনতে কোনো ভূল করিনি..... তুমি ই সেই মানুষ যে আমার আর শ্রিয়ার জীবন টা আনন্দে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছো....আর তুলবেও...
একদিন অর্ক অনেক টা খাসীর মাংস নিয়ে এল...
"চিনি... আমার দুজন চেনা বিজনেস পার্টনার আজ খাবে... জমিয়ে রান্না করো তো... "
আমি মাংস টা একটা পাত্রে ঢাকা দিয়ে বিলেসী কে পেঁয়াজ আলু কুটতে বলে শ্রিয়ার দুধ টা গরম করে ওকে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছিলাম... কিছু দূর যেতেই মনে হোলো...আরে...কাল অর্ককে দিয়ে যে চকোলেট মিক্স টা আনালাম...সেটা তো মেশাতে ভুলে গেছি... তাড়াহুড়ো করে আবার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবো... দেখি...বিলেসী আঁচলের তলায় কি যেন একটা চাপা দিয়ে...উঠোন পেরিয়ে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে সোজা বড়'জার ঘরে গিয়ে ঢুকলো..... আমি রান্নাঘরে এসে কি মনে হতে মাংসের ঢাকা টা খুলে দেখি কাঁচা মাংস যা ছিল তার থেকে পরিমাণে বেশ কিছুটা কম...
আমি আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম...বিলেসী যে মাংস চুরি করেছে... সেটা তো বুঝতেই পারছি.... কিন্তু কথা হচ্ছে কাঁচা মাংস চুরি করে ও করবে টা কি....আর বড়'জার ঘরেই বা কেন গেল....যদি ধরেই নি.... বিলেসী বা বড়'জার মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে... তাহলে তো ওরা রান্না করা মাংস চুরি করতো.....আর আমাকে জব্দ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়...তাহলে তো পুরো মাংস বা রান্না করা মাংসতেও কিছু করতে পারতো...বাংলা সিরিয়ালে বৌ জব্দ করার এরকম অনেক ঘটনা দেখি বটে.. কিন্তু সেখানেও তো কাঁচা মাংস চুরি কোনোদিন দেখিনি....
আমি আর সেদিন কথা বাড়ালাম না...তবে আরো একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম... বড়'জা সেদিন রাতে কিছু খেলো না......
কয়েকদিন নিস্তরঙ্গ ভাবে কেটে গেল.. আমি আর একটু সতর্ক হয়ে থাকার চেষ্টা করলাম....শ্রিয়াও দিনদিন আগের থেকে অনেক বেশি হাসিখুশি হয়ে উঠছিল... আমি রোজ সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে সেই নির্জন কালীমন্দিরে যাওয়া শুরু করেছিলাম...তবে শ্রিয়াকে আমি কখনো ওর সেই প্রথমদিন বলা ভয়ঙ্কর কথার প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাসা করি নি... আমি জানতাম... বাচ্চাদের মন খুব সংবেদনশীল হয়...ও নিজে থেকে যখন কিছু বলবে...তখন দেখা যাবে... কিন্তু শ্রিয়া কে আমি এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতাম না...ওর স্কুলের সময় টুকু ছাড়া....
একদিন মাঝরাতে কি একটা আওয়াজে হঠাৎ করে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল.....উঠে বসে দেখলাম..অর্ক ও শ্রিয়া দু'জনে ই গভীর ঘুমে... আমি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম...পুরোনো দিনের বাড়ির নিয়ম মেনে কলঘর নীচের বারান্দার শেষ প্রান্তে....অর্ক কে বলতে হবে একটা বাথরুম যদি উপরেও করা যায়....ভাবতে ভাবতেই আমি এগোতে লাগলাম...
কিন্তু ছোট কাকার ঘরের সামনে আসতেই একটা অদ্ভুত শব্দে আমার পা টা আপনিই থেমে গেল..... বলা ভালো একটা অদ্ভুত কিন্তু পরিচিত গলার স্বরে..
স্বরটা আমার বড়'জার... কিন্তু অদ্ভুত অন্যরকম ফ্যাসফেসে....বলা ভালো হিসহিসে্...কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া... ভয়ঙ্কর...সেই অদ্ভুত স্বরে বড়'জা কি বলছে
শুনতে আমার অসম্ভব ভয়ের সাথে অদম্য কৌতুহলও হোলো....বড়'জা বলছে
"আর কতদিন??? আমি আর সহ্য করতে পারছি না....ক্ষিদেয় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি....সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবকটা... তবুও কিছু করতে পারছি না...মেয়েটাকে অবদি এমন আগলে রাখে... আমি নাগাল পাইনা...
এই তুই...তুই আমায় জোয়ান মরদ টাকে খেতে দিলি না...মেয়েটাকে জোটালো...বুড়িটাকেও মারতে দিচ্ছিস না... আমি এবার তোকেই কিন্তু..."
ছোট কাকা চাপা গম্ভীর গলায় ধমকে উঠলেন..."খিদে সামলা....আর বাচ্ছাটার দিকে একদম নজর দিবি না...ওকে আরো দু'বছর বাঁচিয়ে রাখতেই হবে... আমার ক্রিয়া হয়ে গেলে তুই তখন ওকে খাস্... এমনিতেই তোর বর, অর্কর আগের বউ এরকম করে মরতে... সবাই সন্দেহ করেছে...তার উপর বৌদির এ্যাকসিডেন্ট.... সবচেয়ে বড় কথা অর্ক যে মেয়েটাকে বৌ করে জুটিয়ে এনেছে...মেয়েটা সিংহলগ্না...ওর উপর স্বয়ং দেবী মার আশীর্বাদ আছে... হারামজাদি তুই এমন পিশাচী...যে বশীকরণ টাও ঠিক করে করতে পারিস না....তোর ভূমির বাইরে যেই গেল অমনি অর্কর ঘোর কেটে গেল...আর ঐ মেয়েটা এখানে বৌ হয়ে এসে আমাদের ঝামেলা বাড়ালো ....তোকে এবার যেখান থেকে এনেছি... সেখানেই ফেরৎ পাঠাবো দাঁড়া...."
বড়'জা একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে উঠলো....
"দেবী...হুঁহ্....তা তোর যদি এত দেবী তে ভয়, তাহলে আমাকে... তাছাড়া, আমাকে অত সহজে এখান থেকে তাড়াতে পারবি না...খিদে না মিটিয়ে আমি এত সহজে এখান থেকে যাবো না... দরকার হলে তোকেই..."
আমার সারা শরীরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। বাপ মা হারা মেয়ে...ভয়ের বিলাসিতা করলে আমার চলতো না...ভীতু আমি কোনোকালেই নই! কিন্তু, কিন্তু এসব কি???এরা কারা??এরা কি এই জগতের??? কাদের সাথে বাস করছি আমরা?? এদের কথা অনুযায়ী তো আমার,অর্কর ,শ্রিয়ার... এমন কি অর্কর মা'র ও ভয়ঙ্কর বিপদ আসতে চলেছে, আমিই বা কি করবো এখন!
কোনোমতে ঘরে ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। বোধহয় কাঁপা হাতে একটু জোরেই শব্দ করে ফেলেছিলাম।
পরদিন দুপুরে...শ্রিয়া যখন স্কুলে....আর আমি আমার ঘরে একা.... বড়'জা পান চিবোতে চিবোতে আমার কাছে এল...সেই রকম শীতল দৃষ্টি নিয়ে আর ব্যাঙ্গের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে খানিক আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিল...তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বললো...."কি লা ছোট?? কাল রাতে ভালো করে ঘুমুসনি বুজি??"....... আমি অস্ফুটে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই বড়'জা কথা কইলো... কিন্তু এবার তার গলার আওয়াজ সম্পূর্ণ অন্যরকম... ঠিক কাল রাতে যেরকম শুনেছিলাম...সেই রকম অপার্থিব ভয়াবহ গলায় বড়'জা বলে উঠলো...."তোর পরের কথা আড়ি পেতে শোনার খুব শখ্....না রে মাগী??? এতদিন তোর অনেক বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও তোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম... এইবার দেখ...তোর কি হাল করি আমি....বড্ড সোয়ামি আর তার পরিবারের ভালো করার চিন্তা....তাই না???তোর চোখের সামনে সব কটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবো...তুই কিচ্ছু করতে পারবি না...তারপর তোকে বাবাঠাকুর নিজে ভোগ করে কালপিশাচের কাছে তোর রক্ত মাংসের ভোগ দেবে...ক্ষ্যামতা থাকলে তুই আর তোর দেবী আটকা...দেকি তুই কেমন সিংগি লগনের ঠাকুরের আশীব্বাদ পাওয়া মেয়ে..."
বলতে বলতেই আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে বড়'জার শরীরটা সম্পূর্ণ পিছন দিকে বেঁকে গেল...আর মাথাটা উল্টো দিকে ঘুরে চুল গুলো মাটিতে লুটোতে লাগলো... আমি অবরুদ্ধ আতংকে দেখলাম বড়'জার চোখের মণিগুলো অদৃশ্য হয়ে পুরো চোখ টাই কুচকুচে কালো হয়ে গেছে...আর মুখ দাঁত বিভৎস ভাবে পচে গলে রক্ত মাংস ঝুলে ঝুলে পড়ছে...গোটা ঘর টা একটা বিচ্ছিরি পচা গন্ধে ভরে উঠলো...সেই অবস্থাতেই খলখল করে হেসে উঠে সেই ভয়াল ভয়াবহ পিশাচিনী আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো...
আমার সারা শরীর যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেল..... আমি বিস্ফারিত চোখে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম....
আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্কুল থেকে ফিরে দরজা ঠেলে মা মা করতে করতে ঘরে ঢুকলো শ্রিয়া....
মুহূর্তে বড়জা আবার আগের মতো স্বাভাবিক....সহজ ভাবে হেসে আমাকে বললো....
"নেঃ....এখন সতীনের বেটি নিয়ে সোহাগ কর্...বলা তো যায়না কখন কি হয়... আমি যাই... আমার মেলা কাজ... এতোবড় সংসার তো আমারই ঘাড়ে...আজ থেকে আবার ঠাউরপোর ও দেকাশোনা আমাকেই কত্তে হবে....বলে আমার আর শ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বিষাক্ত হাসি এসে বড়'জা বেরিয়ে গেল...
আমি সাড় ফিরে পেয়েই আগে শ্রিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম...শ্রিয়া আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ই বলে উঠলো..." আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি মা....বড়জেম্মার ডাইনীবুড়ি হওয়া...এর আগেও দেখেছি....বাপি কে বলেও ছি...বাপি বিশ্বাসই করেনি... আমাকে বলেছে....বানিয়ে বানিয়ে এসব বললে আমাকে দূরের স্কুলে পাঠিয়ে দেবে... আমার খুব ভয় করে মা... তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো???"
আমি উত্তরে শ্রিয়াকে আরো জোরে নিজের বুকের ভিতর আঁকড়ে ধরলাম...এই মুহূর্তে আমার যদি এরকম মানসিক অবস্থা হয়.... তাহলে এইটুকু মা হারা বাচ্চাটার উপর দিয়ে কতখানি ঝড় বয়ে গেছে.... ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো..
আমি ঠিক করলাম...যাই হোক না কেন...অর্ককে আমার সব কিছু খুলে বলতেই হবে...অর্ক শ্রিয়াকে অবিশ্বাস করতে পারে...আমাকে নিশ্চয়ই করবে না।
0 Comments.