Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

এক মাসের গপ্পো - সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব- ১)

maro news
এক মাসের গপ্পো - সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব- ১)

মুখী - ১

মুখী কে আমি প্রথম বার যখন দেখি... তখন প্রায় শেষ সন্ধে ... আমারও তখন মাথার ঠিক ছিল না একটু আগেই আমি আমার শ্বশুর বাড়ির প্রতিষ্ঠা করা নিজস্ব কালীমন্দিরে মাথা কুটে কুটে নিজের মরণ কামনা করেছি... আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম... কিন্তু করে উঠতে পারিনি... নাঃ.... আত্মহত্যা মহাপাপ বলে নয়... আমার পেটের টার কথা ভেবে...আর আমার ছোট্ট মেয়েটার কথা ভেবে..... এই মন্দিরটা মূল বাড়ি থেকে অনেক দূরে...পশ্চিম দিকের জঙ্গলের বেশ ভিতরে...মন্দিরটারও প্রায় ভগ্নদশা...কেউ তেমন এদিকে আসে টাসেও না... আমি অবশ্য বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার প্রায় পর পর ই অন্ততঃ সন্ধেবেলা একবার এই মন্দিরে এসে বিবর্ন হয়ে আসা কালী মূর্তির সামনে একটা প্রদীপ জ্বালাই আর কিছু বুনো জবাফুল খুঁজে পেতে রেখে আসার চেষ্টা করি....একদিন ঘুরতে ঘুরতে এদিকে চলে এসেছিলাম...মন্দিরের আর কালী মূর্তির এই একাকী বিবর্ণ দশা দেখে, কেন জানি না মন টা কেমন খারাপ হয়ে গেছিল...তারপর থেকেই রোজ....বড় জা অবশ্য প্রকাশ্যেই মুখ বেঁকিয়ে বলে "আদিখ্যেতা....শহরের মেয়ের ঢং..." খুব অল্প বয়সেই বাবা মা কে হারিয়ে আমি মামা বাড়ির আশ্রিতা....আর এই সব ক্ষেত্রে লাঞ্ছনা গন্জনা সাধারণত যা হয়ে থাকে... আমার কপালেও তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি...তবে পড়াশোনার মাথা নেহাত খারাপ ছিল না বলে পাত কুড়োনো খেয়ে আর বাড়ির সব কাজ করার পরেও গ্র্যাজুয়েশন টা কমপ্লিট করতে পেরেছিলাম...তাই দু চারটে টিউশনিও জোগাড় হয়ে গেছিল... অবশ্যই এই শর্তে..যে মাস গেলে পুরো টাকাটাই মামীমার হাতে তুলে দিতে হবে.... আর এই রকম এক টিউশনি বাড়িতেই অর্কর সাথে আমার প্রথম দেখা...সেই বাড়িরই এক ছেলের বন্ধু ছিল সে... সত্যি কথা বলতে কি হাজার অভাব দুঃখ আমার জন্মগত রুপ কিছুটা ম্লান করতে পারলেও সেভাবে কেড়ে নিতে পারেনি...কেউ আমাকে এক বার দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে পারতো না,...আর একবার ঘুরে তাকাতোই... তবে আমি নিজের অবস্থান আর যৌবনে ঘটে যেতে পারা নানান বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম...আর সিঁদুরে মেঘ দেখলেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পালাতাম...তাই আমার চব্বিশ বছরের জীবনে তখনো পর্যন্ত কোনো পুরুষের অস্তিত্ব ছিল না এক ঝমঝমে বৃষ্টির সন্ধ্যায় অর্ক আমাকে লিফ্ট অফার করে.... এবং কেন যেন আমি প্রত্যাখান করতে পারিনি.....তাই অত দামী গাড়িতে বসা এবং একটি পুরুষের অত কাছে বসা....এই দুই অভিজ্ঞতাই আমার প্রথম বার হয়.... ‌ দ্বিতীয় বারেই অর্ক আমাকে খুব সোজাসুজি বিবাহ প্রস্তাব দেয়..... "চিন্ময়ী, আমি তোমার কাছে কিচ্ছু লুকোতে চাই না...পূর্বা... আমার প্রথম স্ত্রী আমি তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম... কিন্তু আমার মেয়ে শ্রিয়ার যখন তিন বছর বয়েস...ও হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে.... আমার মেয়েটা মা ছাড়া বড় কষ্ট পায়...তবু আমি এতদিন আর কাউকে...কিন্তু আজ দু'বছর পর তোমাকে দেখে কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে তুমিই আমার শ্রিয়ার উপযুক্ত মা... আমার উপযুক্ত সঙ্গীনী হতে পারবে.... আমিও কেন জানি না অর্কর মায়াভরা বিষন্ন সুন্দর মুখ টা দেখে ভিতরে ভিতরে ভেসে গিয়েছিলাম... অর্কর কাছেই শুনলাম...পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী বলে একটা জায়গায় ওরা প্রায় জমিদার গোছের... সেখানে অর্কর পরিবারের তিনটি কাঠকল....এবং ট্রান্সপোর্টের ফলাও ব্যবসা...যা এখন বলতে গেলে অর্করই...ওদের যৌথ পরিবার হলেও সক্ষম ছেলে বলতে বাড়িতে অর্কই...অর্কর এক দাদা ছিলেন তিনি আজ থেকে ছ'বছর আগে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন...আর অর্কর এক ছোটকাকা আছেন... তিনি পুজো আচ্চা তন্ত্রমন্ত্র নিয়েই থাকেন...আর ওর মা আজ পাঁচবছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত..তাই বাড়িতে কয়েকজন আশ্রিত ছাড়া অর্কর অল্পবয়সী বিধবা বৌদিই সংসারের কর্ত্রী... "জানো চিন্ময়ী... আমার মেয়েটা সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে...ওকে দেখার সময় কোথায় কারোর??" আমি খুব ভালোই জানি মা ছাড়া বাচ্চাদের কি হাল হয়...তাই অর্কর আগের পক্ষের মেয়ের কথা শুনে আমার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগে নি...উল্টে অর্ক আর ওর না দেখা মেয়ের প্রতি মায়ায় মন টা ভরে গেছিল..... মামা মামীর প্রবল আপত্তি (বিনা পয়সার ঝি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখ ও হতে পারে) এবং আল্টিমেটাম... (একবার এই বাড়ি ছেড়ে গেলে যেন জীবনে আর মুখ না দেখাই) সত্ত্বেও এক শ্রাবণের বর্ষনক্লান্ত দিনে... প্রথমে মন্দিরে... তারপর রেজিস্ট্রি ম্যারেজের পর...অর্করই কিনে দেওয়া শাড়ি গয়নায় সেজে... নিজের বলতে আমার মায়ের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন এক সরু চেন...যার লকেটে শিবদূর্গা খোদাই করা...সেটা গলায় ঝুলিয়ে অর্কদের বিশাল বড় পুরোনো কিন্তু যথেষ্ট মজবুত বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালাম... আমার মতো পোড়াকপালীর কি আর ঘটাপটার বিয়ে হয়?? বিয়ে হয়েছে... সংসার পেতে চলেছি এই না কত!! আমার অভর্থ্যনাও সেরকম ই হোলো.... নিয়ম-কানুন নম নম করে বিধবা বড় জা ই করলেন... অবশ্য নামেই উনি বিধবা...ফেটে পরা যৌবন...রঙচঙে শাড়ি...আর পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটের মোহক হাসি ওনাকে অনেক কুমারীদের চেয়েও আকর্ষণীয় করে রেখেছে...তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ওনার চোখের দৃষ্টি...সে যে কি অদ্ভুত পলকহীন ...হিংস্র... ক্ষুধার্ত...প্রথম দর্শনেই আমার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেছিল... নিয়ম-কানুন মিটলে... সেরকম বেশী কিছু ছিলও না তো.... আমি সবার প্রথমে শ্রিয়ার খোঁজ করলাম..এক গিন্নীবান্নি গোছের কাজের লোক... পান চিবোনো দাঁতে হেসে বললো...."কেনো গো... এসেই সতীন ঝি কে খাবে নাকি??" হয়তো গেঁয়ো ঠাট্টা.....কিন্তু আমার গা টা রাগে জ্বলে উঠলো... আমি বললাম... "কেনো গো তোমাদের এখানে মা মেয়েকে খায় বুঝি??" বড় জা পিচ্ করে পানের পিক ফেলে মুখ বেঁকিয়ে বললো..." হুঁহ... সৎ মা আবার মা...!!! তবে বিলেসী ও আগে ওর বর কে খাক্ তবে তো মেয়ে...হাভাতে ঘরের মেয়ে....ওর কি খিদে কম!!তাই তো এক্কেবারে না বলে কয়ে বৌ হয়ে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে..." আমি আহত স্তম্ভিত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে অর্ক কে বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করলাম...আর সাথে সাথে এটাও বুঝলাম মামাবাড়ির থেকে এখানে বেশি কিছু পেতে গেলে আমাকে সেটা লড়াই করেই পেতে হবে... এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যাই হয়ে যাক,দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই আমি করবোই....কারণ এই আশ্রয়ই আমার শেষ ভরসা.... তাছাড়া ছোট্ট শ্রিয়ার অসহায় মুখটাও আমাকে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুললো....প্রথম দর্শনেই মেয়েটা আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে কি যেন এক ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে চাইছে বলে আমার মনে হোলো... আমার শাশুড়ি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী.... তিনি কিন্তু আমাকে খুব ভালো ভাবে স্বীকৃতি দিলেন...কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করা ছাড়াও আমার মনে হলো উনি প্রচন্ড আতংকগ্রস্ত এবং আমাকে কিছু বলতে চান.... কিন্তু সর্বক্ষণ বড় জার উপস্থিতিতে তিনি কিছুই বলতে পারলেন না... এবং বড় জা আমাকে বেশিক্ষন সেখানে থাকতেও দিল না...প্রায় তাড়া দিয়েই বের করে এনে আমাকে খুড়শ্বশুড়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেল..... আমি বড় জার বিদ্রূপের দৃষ্টি অবজ্ঞা করেও শ্রিয়াকে বুকের ভিতর রেখেই ওনার সাথে দেখা করতে চললাম....যেতে যেতেই শ্রিয়া আমাকে ফিসফিস করে বললো " মামণি একটা কথা বলবো??" আমি শ্রিয়ার কপালে একটা চুমি খেয়ে বললাম...তোর মামণিকে তুই সব বলবি মা, জিজ্ঞেস করতে হবে না.."....শ্রিয়া সেইরকমই গলায় বললো "ছোট দাদু একদম ভালো না... আমার খুব ভয় লাগে... আমাকে কি সব করে.... খুব ব্যথা দেয়...আর বড় জেম্মা তখন কি রকম চুল খুলে হাসে.. আচ্ছা বড় জেম্মা কি ডাইনিবুড়ি??" আমি শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম...এ আমি কোথায় এসে পড়লাম...সেই মূহূর্তে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম... আমার প্রাণ দিয়ে হলেও শ্রিয়া কে আমি আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না...কিছুতেই না... ছোট খুড়শ্বশুর কে পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে উনি আমাকে ধরে তুললেন....আর ওনার স্পর্শেই আমি বুঝে গেলাম শ্রিয়া একটা কথাও মিথ্যে বলেনি... ওনার চোখের লালসামাখা চাউনি আর হাতের স্পর্শের বিকৃতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিল উনি একটি অত্যন্ত বিকৃত রুচির ঘৃণ্য মানসিকতার মানুষ... আমাদের মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এ ব্যাপারে কখনো ভূল বলেনা। আমি ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেলাম... আর মাথা তুলতেই আর একটি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম.... আমার বড় জা এবং খুড়শ্বশুরের মধ্যে খুব চকিতে কোনো ইশারা বিনিময় হোলো... আমি নতুন বউ.... এবং খানিকটা উড়ে এসে জুড়ে বসাও বটে,.... এখন ই কাউকে কিছু বলা বা জিজ্ঞাসা করার মতো অবস্থানে আমি নেই...তাই আপাতত চুপ করেই রইলাম... শুধু অসহায় বাচ্চাটাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ফুলশয্যার রাতে প্রবল ভালোবাসাবাসির পর...ক্লান্ত অর্ককে প্রশ্ন করে করে জানতে পারলাম...অর্কর বৌদিও আসলে আমার মতই উড়ে এসে জুড়ে বসা... অর্কর ছোটকাকা একদিন অর্কর বৌদিকে এই বাড়িতে এনেছিলেন, এই বলে , যে অর্কর বৌদি তমসা তাঁর একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে...যার বাবা মা দুজনেই রক্তের কোনো বিরল অসুখে প্রায় একই সাথে মারা গিয়েছেন... এবং এই বাড়িতে আসার দশদিনের মাথায়ই অর্কর বড়দা সৌম্য তমসার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য খেপে ওঠে... নিজের মায়ের প্রবল আপত্তিও তাকে আটকাতে পারে নি.... বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই অর্কর দাদা স্নায়বিক কোনো অসুখে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন....বড় বড় ডাক্তার ও অসুখ ধরতে পারেন না... এবং ক্রমশঃ দূর্বল হতে হতে উনি প্রায় বিছানার সাথে মিশে যান.... "জানো চিনি....তখন বৌদি কিছু সেবা করেছিল বটে দাদার.... দিন-রাত দাদার কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিত না...এর মধ্যেই একদিন রাতে মা দাদা কে দেখতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে... উঃ সে আমাদের ফ্যামিলির একটা সময় গেছে বটে... একদিকে মা সম্পূর্ণ চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়লো..কথাও বন্ধ হয়ে গেল...এখনও মা ঠিক মতো পরিস্কার করে কথা বলতে পারে না। তবে আমার বৌদির তুলনা নেই। একদিকে অসুস্থ স্বামী... আর একদিকে পঙ্গু শাশুড়ি....তার উপর ছোট কাকার দেখাশোনা.... সব একা সামলেছে....কেউ একফোঁটা চোখের জল ও কখনো ফেলতে দেখেনি...যৌথ পরিবারের জন্য আদর্শ বধূ....জানো? দাদা মারা যাওয়ার পর দাদার মৃতদেহ দেখলে তুমি শিউরে উঠতে...সাতাশ বছরের ইয়ং ছেলে তখন যেন আশি বছরের বৃদ্ধের মতো শুকিয়ে কুঁকড়ে গেছিল।.... তুমি আর যাই করো,বৌদির কথা কখনোই অমান্য কোরো না... বৌদি যেন কখনো কোনো আঘাত না পায়...আমি বৌদিকে খুবই শ্রদ্ধা করি..." আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্কর কাছে আবদার করলাম.... আমি শ্রিয়াকে আমার কাছে...,এই ঘরে এনে রাখতে চাই... এবং অর্কর দ্বিধাগ্রস্ত মুখের ভাষা পড়ে তাকে হেসে আশ্বস্ত করলাম... আমি শ্রিয়াকে তাড়াতাড়ি ঘুম পারিয়ে দেবো... আমাদের ভালোবাসাবাসিতে কোনো অসুবিধে হবে না পরদিনই কাজের লোকেদের দিয়ে শ্রিয়ার ছোট্ট খাট টা আমাদের ঘরে নিয়ে এলাম... বড়'জা বিষাক্ত হাসি হেসে বললো....এসেই কর্তাতি ফলানো শুরু!!! এই করেই কি মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবি??".... আমার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে এলেও...আমি মুখে হেসে বললাম......"কেন দিদি... তুমিও তো ওর মায়ের মতই....ও ভালো থাকুক... আত্মবিশ্বাসী হোক... সেটা নিশ্চয় তুমিও চাও তাই না??...."...বড়'জা আর কিছু না বলে বিষ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইতে চাইতে চলে গেল...

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register