Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী - ৮

maro news
Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী - ৮

করোনা-ধারায় এসো - 8

ফুটবল ও ফ্রান্সেজিনা

সেদিন ছিল সপ্তাহের মাঝমধ্যিখান। পুত্রসহ লাঞ্চে এসেছি কাছের একটি আইবেরিয়ান রেস্তোরাঁয়। এখানে আমরা নিয়মিত ঢুঁ মারি অথেন্টিক স্প্যানিশ-পর্তুগিজ রান্না খেতে। পায়েয়ার (Paella) অর্ডার গেছে। আমাদের পছন্দের ডিশ। গোলগোল মুক্তোর মতো স্প্যানিশ চাল, তাতে টমেটো আর পেপার, তার সঙ্গে আবার এট্টুসখানি জাফরান। শামুক-ঝিনুক-স্ক্যালপ-চিংড়ি আর সসেজে ভরপুর। মাঝে আবার একটি বিরাট লবস্টার আলো ছড়ায়।
সে রেস্তোরাঁর মালিক বেনিতোও সেদিন বসেছিল আমাদের টেবিলে। একটা স্প্যানিশ ওমলেট নিয়ে। খদ্দের কম, তাই দুদণ্ড ফুরসৎ মিলেছে তার।
এপর্যন্ত পড়ে পাঠক যদি শিউরে ওঠেন এই ভেবে যে কোন দুঃসাহসে আমরা লকডাউনে রেস্তোঁরায় বসে গল্পগুজব করছি, তাহলে তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি - এসব সেই করোনাকালের আগের কথা। যখন জীবন চলতো স্বাভাবিক ছন্দে।
বেনিতো আইবেরিয়ান পেনিনসুলার লোক। পর্তুগিজ। বাড়ি পোর্তো শহরে। এবং সে আর পাঁচটা ইউরোপীয়ানের মতোই ফুটবল-অন্তপ্রাণ।
শুনেই আমি উৎসাহিত, “পর্তুগালের ফুটবল মানেই ইউসেবিও, লিসবনের বেনফিকা ক্লাব। হুঁ হুঁ বাবা - আমি কি কিছু কম জানি?”
বেনিতো তৎক্ষণাৎ আমার উৎসাহে জল ঢেলে দেয়। বরফ-শীতল গলায় জানিয়ে দেয় যে লিসবন শহরকে সে শহর বলেই মনে করে না। তার না আছে ঐতিহ্য, না আছে কুইজিন, না আছে ম্যাজেস্টিক ক্যাফের মতো ঐতিহাসিক ক্যাফে, না আছে স্বয়ং গুস্তাফ আইফেলের তৈরী করা দৌরো নদীর ওপর ব্রিজ। পোর্তোর সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না। যেহেতু বেনফিকা ক্লাব লিসবনে আস্তানা গেড়েছে এবং ইউসেবিও ভুল করে বেনফিকাতেই খেলে ফেলেছেন, অতএব বেনিতো এবং ইউসেবিওর মধ্যে কোনোরকম সম্পর্ক থাকতেই পারে না।
এ পর্যন্ত বলে বেনিতো হঠাৎ শুধোল, “বলো দেখি, পর্তুগাল নামটা কোত্থেকে এলো?”
বেনিতোর প্রশ্নে বুদ্ধি খুলে গেল, চট করে আন্দাজ করে নিয়ে জবাব দিলুম, “কেন? পোর্তো শহরের নামেই তো পর্তুগাল দেশের নাম।”
ভারী খুশি হয়ে বললো, “রোমানদের হাতে গড়া শহর, বুঝলে? সেই যীশুর জন্মের তিনশো বছর আগে এ শহরের পত্তন। ল্যাটিন ভাষায় নাম ছিল পর্তুস কালে। সেখান থেকেই পর্তুগাল নাম।”
উৎসাহিত হয়ে বললুম, “তাহলে পর্তুগাল বেড়াতে গিয়ে পোর্তো তো যেতেই হচ্ছে!”
বেনিতো অসীম আত্মপ্রত্যয়ী, “অবশ্যই! নদীর মোহনায় ছোট্ট বন্দর-শহরটি আমাদের। দৌরো নদী পাশ দিয়ে ছলছল করে বয়ে গিয়ে সমুদ্দুরে মিশে গেছেন। আর তার উপত্যকাতেই পর্তুগালের বিখ্যাত ওয়াইন অঞ্চল। যেখান থেকে তোমার টেবিলে পোর্ট ওয়াইন আসে।
বলেই এক ওয়েটারকে ডেকে বললে টেবিলে এক বোতল পোর্ট রেখে যেতে।
“সদ্য দেশ থেকে এনেছি - বুঝলে?”
বুঝে কৃতার্থ হলুম। মিনমিন করে যেই না বলেছি, “তিনজনের জন্যে পুরো একবোতল ওয়াইন? এই দুপুরবেলা?”
হেসেই অস্থির।
“কী বলে রে মেয়েটা, এক এক বোতল তো এক এক জনই শেষ করে ফ্যালে। ভয় পেয়ো না, দ্য ওয়াইন ইজ অন মি।”
বলা বাহুল্য সেদিন সে ওয়াইনের বেশিটাই ঢালা হয়েছিল বেনিতোর গ্লাসে।
পেটে ওয়াইন, হাতে সময়, বেনিতো সেদিন অনেক গপ্পো শুনিয়েছিল। তার কাছেই প্রথম শুনি বেনফিকা, পোর্তো আর স্পোর্টিং ফুটবল ক্লাবের কথা। পর্তুগালের বিগ থ্রি। থ্রি-ওয়ে রাইভ্যালরি। অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডানের মতো। এই তিনটে ক্লাব ভাগাভাগি করে পর্তুগিজ ফুটবল লিগ জেতে। কখনো বেনফিকা তো কখনো পোর্তো আবার কখনো স্পোর্টিং। এদের মধ্যে খেলা মানে ঐতিহাসিক দ্বৈরথ, পর্তুগিজে তাকে বলে ‘ও ক্লাসিকো’।
ভাগ্যিস সেদিন আমার পুত্র ইতালিয়ান ন্যাশনাল ফুটবল টিমের একটা জার্সি পরেছিলো! সে জার্সির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বেনিতোর মন্তব্য, “ইতালিয়ানদের নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বেনফিকার জার্সি পরলে এখানে খাবার সার্ভ করা হয় না। ওয়েটারদের স্পেশাল ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে।”
তার অরিজিনাল দক্ষিণ ইউরোপিয়ান অ্যাকসেন্টে, “ইফ ইউ কাম হিয়ার, ইউ ক্যান ওয়ার ওনলি টু জার্সি - পোর্তো অ্যান্ড রিয়্যাল মাদ্রিদ । নো বেনফিকা, নো বার্সেলোনা, নো নাথিং।”
পুত্র আর আমি গোপনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করেছিলুম।
তারপর তো এলো দুঃসময়। করোনার চোখরাঙানিতে জীবন থেকে তিনটে মাস পুরো 'নেই' হয়ে গেল। তা সে আর কি করা। ইনফেকশন আর তার থেকে মৃত্যুর হার যখন কমলো, নিউজার্সির খাবার জায়গা গুলো টেক-আউট চালু করলো। আমরাও আবার গুটিগুটি গিয়ে জুটলাম বেনিতোর আইবেরিয়ান ঠেকে। বসে খাওয়ার অবিশ্যি উপায় নেই, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে টেক-আউট।
সময়কে ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে চলে আসি আজকে, মানে এই জুলাই মাসে। করোনার দাপটে ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবস্থা একটু সামলে নেবার পর অনেকগুলো দেশ তাদের লিগের খেলা আবার চালু করে দিয়েছে। পর্তুগিজ লিগ, যার আসল নাম প্রিমেইরা লিগা, সেও চালু। আর আজ জুলাইয়ের পনেরো তারিখে প্রিমেইরা লিগার খেলায় পোর্তো আর স্পোর্টিং মুখোমুখি হচ্ছে। মহারণ। ‘ও ক্লাসিকো’।
পুত্রের ইচ্ছা সে মহাযুদ্ধ দেখতে দেখতে বেনিতোর দোকানের অথেন্টিক পর্তুগিজ পায়েয়ার আস্বাদ নেওয়া। বেনিতোই ফোন ধরলো। পায়েয়ার অর্ডার শুনে ঠান্ডা গলায় জানিয়ে দিলো, আজ মেনুতে অন্য কিছু নয়, আছে শুধু ফ্রান্সেজিনা। পোর্তোর সিগনেচার স্যান্ডউইচ।
কিঞ্চিৎ অবাক হলুম। শুধু ফ্রান্সেজিনা? এ আবার কেমন মেনু? যদিও জানি ফ্রান্সেজিনা বড় সামান্য স্যান্ডউইচ নয়। তার মধ্যে হ্যাম, স্টেক, সসেজ, মশলাদার টমেটো ইত্যাদি সাড়ে-বত্রিশভাজা দেওয়া থাকে। আর থাকে উপাদেয় বিয়ার সস। একটা খেলে সারাদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত।
বেনিতো কিন্তু অদম্য, “ঐটাই দেখেছি কাজ করে। ম্যাচে পোর্তো কে জেতাতে হলে সারাদিন শুধু ফ্রান্সেজিনা খেয়ে থাকতে হয়। এমনি এমনি কি আজ পোর্তো লিগের টপ পজিশনে আছে?”
কৌতূহলী হলাম, “কিরকম?”
একগাল হেসে বললো, “লিগে পোর্তো ছিয়াত্তর আর বেনফিকা একাত্তর পয়েন্ট। আর স্পোর্টিং তো মোটে ঊনষাট । পোর্তো লিগ চ্যাম্পিয়ন হলো বলে। এ সব কি এমনি এমনি হয়? যেদিন পোর্তোর খেলা থাকে, সেদিন আমি ফ্রান্সেজিনা ছাড়া কিচ্ছু খাই না। তবেই না ম্যাচ জেতা যায়!”
বলে কি? চোখের সামনে ভেসে উঠলো টিভির ঘর। ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ।
সৌরভ গাঙ্গুলী ক্রিজে নড়বড় করছে। যে কোনো মুহূর্তে আউট হয়ে যাবে আর তার সঙ্গেই ভারতের আশা-ভরসা সব শেষ! এমন সময় রিনিবৌদি ঢুকলেন ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে ওয়াসিম আক্রাম লোপ্পা ক্যাচ মিস করলো। গাঙ্গুলীর ঝুলিতে ছয় রান!
আর যায় কোথায়। রিনিবৌদি সেঘরে সারাদিনের জন্যে জমা হয়ে গেলেন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াও চলবে না। ঘরশুদ্ধু লোক হাঁ হাঁ করে উঠবে, "চেপে থাকো, চেপে থাকো।" প্রবল জনমতের চাপে রিনিবৌদি জল খেতেও আর সাহস পান না। যদি ছোটোবাইরে পায় আর ঘর থেকে বেরুলেই যদি গাঙ্গুলী আউট হয়ে যায়? সেদিন রিনিবৌদির জন্যেই সৌরভ গাঙ্গুলীর সেঞ্চুরি হলো!
এক বন্ধুর বাড়িতে আবার নির্দিষ্ট দুটি চেয়ার থাকতো। 'আউটের চেয়ার' আর 'রানের চেয়ার'। এক একটা চেয়ারের এক এক রকম মহিমা।
জাভেদ মিয়াঁদাদকে কিছুতেই আউট করা যাচ্ছে না। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ খুদেটিকে এনে আউটের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে মিয়াঁদাদের স্টাম্প উপড়ে গেল।
আবার শচীন তেন্ডুলকরের রান পেতে গেলে খুদেকে বসাতে হবে রানের চেয়ারে।
তিনবছুরে খুদে কি এক চেয়ারে বেশিক্ষণ থাকতে চায়? পিছলে নামতে গেলেই জোড়ায় জোড়ায় হাত এসে তাকে আবার চেয়ারে তুলে দেয়।
"কি চাই তোর? চকলেট? খেলনা? সঅঅঅঅব পেয়ে যাবি সোনা। শুধু চেয়ারে বসে থাক, খবর্দার নামবি না!"
শচীনের রানের বিশ্বরেকর্ড কি আর এমনি এমনি হয়েছে?
একই ঘটনা দেশকাল নির্বিশেষে। খেলোয়াড় তো শুধু মাঠে খেলে। তার সাফল্যের পিছনে এমন কত অদৃশ্য ভাগ্যনিয়ন্তা নীরবে কাজ করে চলে - তার খোঁজ কে রাখে?
আমাদের বেনিতোও এই গোত্রের। বলতে কি, তার জন্যেই আজ পোর্তো লিগ জিততে চলেছে। বেশ বুঝলুম, বেনিতো তার আইবেরিয়ান রান্নাঘরে আজ ফ্রান্সেজিনা ছাড়া আর কিছু বানাবে না।
হাল ছেড়ে বললুম, “আচ্ছা, দাও তবে দুটো ফ্রান্সেজিনা, তুলে নিয়ে আসছি।”
বললো, “ম্যাচ আরম্ভ হওয়ার আগে এসো কিন্তু। শুরু হয়ে গেলে আর ডেলিভারি পাবে না। আমি বৌ-বাচ্চার সঙ্গে খেলা দেখতে বসবো।”
অগত্যা।
যেতে যেতে ভাবলুম, প্রিমেইরা লিগার টাইমটেবিলটা দেখে রাখতে হবে, কোন কোন দিন পোর্তো খেলছে।
এই লেখার সময় টিভির পর্দায় পোর্তো আর স্পোর্টিং হাড্ডাহাড্ডি লড়ে যাচ্ছে। গোলের এখনো দেখা মেলেনি। যদিও স্পোর্টিং পয়েন্টের দিক থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। তবু বলা তো যায় না? বেনিতোর ফ্রান্সেজিনা থেরাপি চালু থাকবে যদ্দিন না পোর্তো প্রিমেইরা লিগা জিতে নিচ্ছে।
সর্বশেষ সংযোজন - ফ্রান্সেজিনার কল্যাণে আজকের ‘ও ক্লাসিকো’ ম্যাচে জয়ী পোর্তো। লিগেও তারাই চ্যাম্পিয়ন।
সন্ধেবেলায় বেনিতো আমায় ফোন করে বললো, “ভূতগুলোকে দু-দুখানা গোল ঠুসে দেওয়া গেছে। আমরা লিগও পেয়ে গেছি। নিশ্চিন্দি। ঘন্টাখানেক বাদে এসে পায়েয়া নিয়ে যেয়ো। আমি নিজে বানাচ্ছি। দাম লাগবে না।”
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register