Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব - ২)

maro news
ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব - ২)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

২।। পালিয়ে কতদিন থাকা যায়?
আমরা সবাই একত্রিত হলাম। গুল্লুকে মাহাবুব ভাইয়ের কাছে গিয়ে সরি-টরি বলতে বললাম। না হয় একটা থাপ্পর দিবে। এতে আর তেমন কি হবে।
গুল্লু আমাদের কথা মানতে রাজি নয়। চেঁচিয়ে ওঠে: মাথা খারাপ! আমি কানে নিচে থাপ্পর খেতে পারব না। এমনিতেই মাঝে মাঝে আমার কানের ভেতর পিঁপিঁ শব্দ হয়। শেষে কালা হয়ে যাব।
গুল্লুর সাথে বৃথা তর্ক না করে আমি কাজের কথা তুললাম। বললাম: আমার এক মামাতো বোন আছে। নাম কঙ্কনা। ভয়াবহ রকমের সুন্দর। মাহাবুব ভাই তার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন।
ছাগির বলল: কিভাবে ইন্টারেস্ট দেখালেন?
: মাহাবুব ভাই আমার মামাবাড়ি যেতে চেয়েছেন কঙ্কনা আপুকে দেখতে।
: ধুর! তার কথার কোনো হেড এন্ড টেল নাই। সে বিয়ে করার পাবলিক না।
: আমরা মাহাবুব ভাইয়ের বাবা-মায়ের কাছে যাব। তাদের সাথে কথা বলবো। তারপর মাহাবুব ভাইকে নিয়ে যাব। পছন্দ হলে আর কোনো দেরি নেই.....। কঙ্কনা আপুর চেয়ে সুন্দর মেয়ে ঢাকা বিভাগে নাই, চ্যালেঞ্জ।
: দেশে নাই বললে একটা কথা হতো। ঢাকা বিভাগে আবার সুন্দর মেয়ে আছে নাকি? সুন্দর মেয়ে সব খুলনা বিভাগে। আমার ছোট খালাকে দেখলে মাহাবুব ভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
: তাহলে তোর ছোট খালাকেই দেখা।
: পাগল হয়েছিস! বিয়ে হলে মাহাবুব ভাইকে খালু ডাকতে হবে। এই সম্পর্ক আর থাকবে? তোর কঙ্কনা আপুকেই দেখানোর ব্যবস্থা কর।
: চল, আজ আমরা সবাই মিলে মাহাবুব ভাইয়ের বাসায় যাই। তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো।
গুল্লু ফস করে বলে উঠল: আমি যাব না।
ফেকু বলল: তোর ভয় নেই। আমরা বিকালে যাব। বিকালে মাহাবুব ভাই বাসায় থাকে না।
বিকালে আমরা দল বেধে মাহাবুব ভাইয়ের বাসায় গেলাম। বেল টিপতেই দরজা খুললেন মাহাবুব ভাইয়ের মা-আমাদের সবার প্রিয় খালাম্মা। আমি বললাম: শুভ বিকাল, কেমন আছেন খালাম্মা?
: ভালো আছি বাবা। তোমরা ভালো তো? এসো, ভেতরে এসো।
ভেতরে গিয়ে আমরা সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। খালাম্মা ভাবছিলেন, আমরা মাহাবুব ভাইয়ের কাছে এসেছি। তিনি এসি ছেড়ে চলে যাবার আগেই গুল্লু বলল: খালাম্মা, আমরা আঙ্কেলের কাছে এসেছি।
মাহাবুব ভাইতে গুল্লুর এক রকম ভয় মেখে আছে। খালাম্মা থেমে গেলেন। তিনি কিছুটা বিস্মিত। আমরা সাধারণত মাহাবুব ভাইয়ের কাছে যাই, আঙ্কেলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। খালাম্মা বললেন: বসো, আমি তাকে পাঠাচ্ছি।
খালাম্মা চলে যাবার পর গুল্লু বলল: আমি চাই, তোর মামাতো বোনের সাথে মাহাবুব ভাইয়ের বিয়ে হোক।
আমরা কেউ কিছু বললাম না। গুল্লু বলল: এটা কোনো জীবন হলো না। স্ত্রী, সংসার, সন্তান ছাড়া জীবন কোনো জীবন না।
ফেকু বলল: তুই তো জীবনের মানেটা খুব ভালো বুঝে ফেলেছিস।
: তুই-ই বল, পুরো একটা জীবন একাকি কাটিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয়?
: তোর কাছে কোনো মানে না থাকতে পারে, অনেকের কাছে আছে। পৃথিবীতে অনেক মহামানুষ বিয়ে করেননি। মহামতি বুদ্ধ তো বিয়ে করে শেষে সংসার ত্যাগ করলেন।
: বিয়ে-ঘর-সংসার করেও তো রবীন্দ্রনাথ নবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
: আর সেই নবেল প্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নবেল ছিলেন চিরকুমার। আসলে যার যার জীবন তার তার মতো। যে যেভাবে জীবনের ভালো মানে পেতে চায় সেভাবেই জীবন কাটাবে।
আলফ্রেড নবেল যে চিরকুমার ছিলেন আমরা কেউ তা জানতাম না। ফেকু সত্যি বললো, নাকি গুল মারলো তা ধরতে পারছিলাম না।
ফেকু বলল: আলফ্রেড নবেল যদি বিয়ে করতেন, এবং তার যদি পাঁচ/সাতটা ছেলেমেয়ে থাকতো তো ডিনামাইট বিক্রির টাকা তাদের নামে উইল করে যেতে হতো। আমরা চুপ করে রইলাম।
ফেকু গুল্লুকে ধাক্কা দিয়ে বলল: বিজ্ঞানী নিউটন, গ্যালিলিও এঁদের নাম শুনেছিস?
গুল্লুর চোখে-মুখে বিরক্তি। এত বিখ্যাত মানুষদের নাম শুনবে না এটা কী করে হয়? ফেকু বলল: এই বিজ্ঞানীদ্বয় ছিলেন চিরকুমার। মোনালিসার ছবি দেখে তো চোখ সরাতে পারিস না। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। নারীরা পার্লারে গিয়ে ভ্রু প্লাগ করে সৌন্দর্য বাড়ায়। আর ভ্রুহীন এই নারীর সৌন্দর্য তুলনাহীন। এই মোনালিসার শ্রষ্ঠা চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন চিরকুমার। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক দেকার্তে, ইমানুয়েল, কান্ট, নিৎসে ছিলেন চিরকুমার।
এইসব দার্শনিকদের সম্পর্কে ফেকু জেনেছে মাহাবুব ভাইয়ের কাছ থেকে। আর সে এখন মাহাবুব ভাইকে চিরকুমার রাখার পক্ষে। আমরা তার সাথে নেই। মাহাবুব ভাই বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তিনি বিয়ে করুন, আমরাও একটা ভাবী পাই।
একটু পর মাহাবুব ভাইয়ের বাবা এলেন। আমরা সবাই দাঁড়ালাম। আঙ্কেল আমাদের বসতে বললেন। তারপর তিনিও আমাদের মুখোমুখি একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। তিনি কন্ঠে কিছুটা বিস্ময় মেখে বললেন: তোমরা আমার কাছে এসেছো?
গুল্লু বলল: জি আঙ্কেল।
: কী মনে করে?
: মাহাবুব ভাইকে বিয়ে করাবেন না?
: তার আর বিয়ে! আঙ্কেলের বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল।
আরও কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ভেতরে চেপে আঙ্কেল বললেন: তোমাদের নিয়ে মেতে থেকেই তো তার বিয়ে-ঘর-সংসার সব কিছুর মোহ চলে গেছে। একদিন তোমরা লেখাপড়া শিখে কাজ-কর্ম করবে, বিয়ে করবে, কিন্তু সে.....?
: আঙ্কেল, আমরাও বিয়ে করবো না।
: তোমরা বিয়ে করবে না মানে?
: একটু আগে বিয়ে না করা বিখ্যাত মানুষদের যে ফিরিস্তি শুনেছি, তাতে বিয়ে করার ইচ্ছা মন থেকে উবে গেছে।
ফেকু গুল্লুকে কুনুইয়ের গুতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল: তুই বিয়ে না করলে না করবি। আমাদেরকে এই দলে টানিস কেন?
একটু আগে ফেকুই কিন্তু বিয়ে না করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিল। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র।
আমি সরাসরি মূল কথায় চলে গেলাম। বললাম: আঙ্কেল, আমার একটা মামাতো বোন আছে, নাম কঙ্কনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী। অসম্ভব সুন্দর দেখতে। মাহাবুব ভাইকে তার কথা বলেছি। মাহাবুব ভাই তাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
: অসম্ভব সুন্দর বুঝি না, মানুষ সবাই যে যার মতো সুন্দর। আমরা চাই, মাহবুব বিয়ে করুক। ওর জীবনে একটা স্থিতি আসুক।
তখনই ট্রলিতে নাস্তা নিয়ে খালাম্মা এলেন। মাহাবুব ভাইয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে শুনে বসলেন। তাহলে তুমি ওকে কবে নিয়ে যাবে তোমার মামাবাড়ি?
: আমরা কালই যেতে পারি।
: তাদেরকে কোনো খবর দিবে না? মেয়ে বাড়িতে আছে, নাকি ইউনিভার্সিটির হলে.......।
: আমি দু’দিন আগে মামাবাড়ি থেকে এসেছি। কঙ্কনা আপা বাড়িতেই আছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকলেও সমস্যা নেই। আমার মামাবাড়ি মানিকগঞ্জ। খবর দিলেই সাভার থেকে ছুটে যেতে পারবে।
: তাহলে তো ভালোই।
খালাম্মা আমাদের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললেন: শোন, যদি মেয়ে এবং মেয়ের পরিবার মাহাবুবকে পছন্দ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে খবর দিবে। আমরা গিয়েই বিয়েকাজ সম্পন্ন করে ফেলবো। গহনা-গাটি সব প্রস্তুত আছে। বিয়ে সম্পন্ন করে সময়-সুযোগ মতো আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে আনবো।
: মাহাবুব ভাইকে অপছন্দ হওয়ার কিছু নেই। আমি মাহাবুব ভাইয়ের কথা তাদের সবাইকে বলেছি।
: যদি বিয়েটা হয় তো সাতপাড়া মাতিয়ে অনুষ্ঠান করবো। কত সাধ বুকে নিয়ে বসে আছি। ছেেেল তো তা বোঝে না। সে আছে তার মতো। তোমরা খাও, খাও আর কথা বলো।
খালাম্মা ভেতরে গেলেনে। তখনই আঙ্কেলের সেলফোন বেজে উঠল। আঙ্কেলও উঠে চলে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন মাহাবুব ভাই। গুল্লু তো ডাইনোসার দেখার মতো চমকে উঠল। মাহাবুব ভাই এসময় বাসায় থাকবে না জেনেই সে এসেছিল, এখন কানের নিচে থাপ্পর তাহলে খেতেই হবে।
কিন্তু গুল্লুর কানের নিচে থাপ্পর দেয়ার ব্যাপারে মাহাবুব ভাইয়ের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। তিনি গরম চোখে তাকালেন আমার দিকে। বললেন: আমি কি তোকে বলেছি যে, তোর মামাতো বোনকে বিয়ে করবো?
: নাহ! তা বলেননি?
: তাহলে....?
: আপনি তাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন।
: সে নাকি মিস ঢাকা ডিভিশন, সেটা যাচাই করার জন্য তাকে দেখতে চেয়েছি। দেখতে চাওয়া মানেই কি বিয়ে করতে চাওয়া?
: তাকে দেখলে আপনার ভালো লাগবে। এই এক ঘেয়ে ব্যাচেলর জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাইবেন।
: আমার জীবন যে এক ঘেয়ে তুই তা জানিস কিভাবে? তোকে কি কখনও আমি এরকম কিছু বলেছি?
এই দু’টি প্রশ্নের জবার খুঁজে পেলাম না আমি। কারণ, মাহাবুব ভাইকে মুহূর্তের জন্যও জীবন নিয়ে বোরিং দেখিনি। এরকম কিছু তিনি আমাদেরকে বলেনওনি। আমি চুপ করে রইলাম।
মাহাবুব ভাই বললেন: ভালোই ঘটকালি শিখেছিস। ইস্টার্ন প্লাজার নয় তলায় একটা অফিস নিয়ে ফেল। ঘটক পাখি ভাইকে রাস্তায় বসিয়ে দেবার ক্ষমতা তোর ভেতর আছে।
: প্লিজ মাহাবুব ভাই, যদি কোনো ভুল করে থাকি নিজ গুণে ক্ষমা করে দেন। কালই মানিকগঞ্জ যাব। কখন, কিভাবে গেলে ভালো হয় সেটা বলুন।
তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। পরমুহূর্তের ভীষণ বজ্রপাতের শব্দ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশে ঘন-কালো মেঘ। জমাট বেধে নিচে নেমে এসেছে। এরকম মেঘ কখন জমলো? আবার বিদ্যুৎ চমকালো। ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক, আমরা কালই মানিকগঞ্জ যাবো এরকম প্রত্যয় ব্যক্ত করলাম।
আমরা এগারো জন। মাহাবুব ভাইসহ বারোজন। মাহাবুব ভাইদের টয়োটা এলিয়ন আছে। আকাশী রঙের। গতবার সেটার রঙ ছিল লাল। তার আগের বার কালো। মাহাবুব ভাই প্রতি বছর গাড়িটার রঙ বদলান। অনেকেই ভাবেন, তারা প্রতি বছর পুরনো গাড়ি বাতিল করে নতুন গাড়ি কেনেন।
বারোজন মানুষের তো একটা টয়োটা গাড়িতে বসা সম্ভব না। মাহাবুব ভাইকে বললাম ষোল সিটের একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করতে। তাহলে সবাই মিলে আরাম করে যেতে পারবো। পিকনিক পিকনিক আমেজ থাকবে।
মাহাবুব ভাই রেগে উঠলেন: মাইক্রোবাস ভাড়া করবো মানে? ঢাকার পাশে মানিকগঞ্জ যেতে মাইক্রোবাস লাগে? ফার্মগেট থেকে বাসে উঠে যাব গাবতলী। গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের বাস এভেইলএবেল। আরিচার বাসে উঠলেও মানিকগঞ্জ স্টেশনে নামা যাবে।
আমি বললাম: মেয়ে দেখতে যাবেন বাসে করে? মাইক্রোবাস নিলে একটা স্ট্যান্ডার্ট আসতো।
: মেয়ে দেখতে যাচ্ছি মানে? কিসের মেয়ে দখতে যাচ্ছি? তুই যে বলেছিস, তোর মামাতো বোন মিস ঢাকা ডিভিশন সেটা প্রমাণ করতে যাচ্ছি। স্ট্যান্ডার্টের খ্যাতা পুড়ি।
আমাকে সাপোর্ট করে কেউ কিছু বলে না। গুল্লুর কাছ থেকে মোটামোটি সাপোর্ট পাওয়া যায়। কিন্তু সে এখন মাহাবুব ভাইয়ের বিপক্ষে বলবে না, পাছে কানের নিচে থাপ্পরের কথা মাহাবুব ভাইয়ের মনে পড়ে যায়। গুল্লু বলল: মাইক্রোবাসের দাম আট লাখ, আর একটা বড় বাসের দাম বিশ লাখ। মাইক্রোবসে স্ট্যান্ডার্ট আসে কিভাবে? আমি মাহাবুব ভাইয়ের সাথে একমত। আমরা বাসে করে যাব।
সবাই বাসে করে যেতে রাজি হল। শুধু আমার মনটা একটু দমে রইল। মাহাবুব ভাইয়ের গল্প মামাবড়িতে অনেক করেছি। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। খুব ফিটফাট। খরচের দরাজ হাত। তাকে নিয়ে যাচ্ছি বাসে করে।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register