Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্য বোলো না -তে পাভেল ঘোষ

maro news
গদ্য বোলো না -তে পাভেল ঘোষ

'ভটামদা,আবার....'

সকাল থেকে আকাশে বড়, মাঝারি ,ছোট মেঘের মধ্যে যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলছে। করোনার আবহে প্রত্যেকের মনের আকাশে সূর্য এখন অনুপস্থিত। আবার কবে সোনালী রোদ মাখানো ভোর আসবে,কে জানে? সকাল থেকেই সারা শরীর জুড়ে একটা ব্যাথা টের পাচ্ছি।হাত পা বেঁধে মনে হচ্ছে কেউ গুছিয়ে ঠেঙিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। 'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও..' রিংটোন বেজে উঠলো ফোনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধরলাম। "হ্যালো..." "আমি ল্যাটাদা বলছি...!" হে ঈশ্বর.!বাড়ি করার সময় কে জানতো..আমার দুই প্রতিবেশী এমন হবে..! ডানদিকে 'ভটামদা'..আর বামদিকে 'ল্যাটাদা'। দুটোতে শালা হাড়মাস চিবিয়ে খেলো। আগের জন্মে দুটোই নির্ঘাত বিচুটি গাছ ছিলো..! ফোনটা ধরলাম.। "বলুন ল্যাটাদা...." "আরে শুনেছ,ভটামের করোনা হয়েছে..!" "কি বললেন? ভটামদার করোনা..!" তড়াক করে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। সর্বনাশ..! আর মনে হচ্ছে রুখতে পারলাম না। এতদিনের তপস্যা দেখছি বিফলে গেল। মাস চারেক তিনটে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। বেড়িয়েছি সাকুল্যে দিন পাঁচেক। তাও এমনভাবে,যে রাস্তা দিয়ে গেলে অন্য সবাই শত কাজ ফেলে আমার দিকে একবার দৃষ্টি দেবেই দেবে...! দুটো রেনকোট চাপাতাম,ভিতরে নতুনটা, উপরে পুরোনো। গরমে হাঁসফাঁস করতাম। কিন্তু যখনই ভাবতাম,করোনার কথা, 'একটা ঠিক করেছি' ভাব আসতো গর্বে। "চুপ করে গেলে কেন ভাই...?" "হ্যাঁ.. ল্যাটাদা..! কিন্তু আমি... আমি তো শুনিনি।" ভয়ে তোতলাতে লাগলাম। "আরে ভাই,আমি কাল রাতে ভটামের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম,বুঝলে..!পষ্ট শুনলাম, 'করোনাকে নিয়ে আর কতদিন ঘর করবো ,কে জানে..?" "তাই..? কে বললো কথাটা?" "আরে..ভটাম, আবার কে?" "আর বাঁচবো না দাদা..! মরণ দুয়ারে...!" আমার চোখে জল আসছে,বুঝতে পারলাম। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।বুকের মধ্যে হাতুড়ির আওয়াজ টের পেলাম । মনে হলো যেন করোনা সশরীরে উপস্থিত। "ল্যাটাদা রাখছি...বাড়িতে কেউ ..." "ঠিক আছে ভাই..সাবধানে থেকো।" ফোনটা কেটে দিলুম। "শুনছো... তোমাকে ভটামদা ডাকছে...!" "ভটামদা...! কেন?" কিন্তু ভটামদার তো...? সর্বনাশ। বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে দেখছি। "ছাড়োতো...দিন দশেক বাজার করো নি.. সে খেয়াল আছে? দুদিন ধরে আলুসিদ্ধ ভাত খাচ্ছি। যাও.. দাদা- ভাই মিলে বাজার করে এসো..।" "ভটামদার সাথে আমি যাবো না.." "আরে বাবা লোকটা ডাইনিং রুমে এসে বসে আছে...আর তুমি বলছো..!যাও আমি রেনকোট দুটো বের করে দিচ্ছি।" আমার হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। মনে হচ্ছে চিতা'র উপর শুয়ে আছি..! "আরে মাস্টার...! চলো ভটাম করে...। দেরী করছো কেন ?" ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ভটামদা..!মুখে কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার। "ভ.. ভ..ভটামদা.." "আরে ভাই তোতলাচ্ছো যে..." "না..মানে আমি শুনলাম..." কিছুক্ষন আগে ল্যাটাদার সঙ্গে ফোনে কথোপকথন খুলে বললাম কষ্ট করে..! শুনে ভটামদা হেসে লুটোপুটি..! "কি হলো..?আপনার তাহলে করোনা হয় নি..?" আমি প্রশ্ন করতেই ভটামদা বলে চললেন, "আরে মাস্টার.…তোমাদের পুলিশবৌদির আসল নাম কি জানো?" "জানি না দাদা.." আমতা আমতা করে বললাম। "করুণাময়ী..! আরে তোমাদের 'করোনা' এসেছে তো মাস চারেক হলো..আমার ঘরে 'চোদ্দো' বছর..!" "চোদ্দো বছর..! কি আজেবাজে বলছেন?" "আরে ভাই,প্রথম দু এক বছর ওকে 'করুণা' করে ডাকতাম বুঝলে.? তারপর 'করুণা' কখন যে আদরে 'করোনা' হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি।" ভটামদা সামান্য লজ্জা পেয়েছেন বুঝলাম..! "কিন্তু কাল ল্যাটাদা..?" "শালা..এই মোটা মাথায় কি করে যে মাস্টারি করো,কে জানে?" তারপর শ্রাবণ ধারার মতো বলে চললেন..। "অশান্তি হয়েছিলো ভাই..!এখন তোমার বৌদিকে কিছু বললেই সামনে এসে হেঁচে দেবে ইচ্ছে করে..! জানে আমি করোনাকে ভয় পাই। মানে.. আমি কোভিডের কথা বলছি..! আমি তোমার বৌদিকে ভয় পাবো..?ছিঃ.! এর থেকে শালা ভটাম করে মরে যাওয়া ভালো।" "সকাল থেকে তো চা মেরেছ, চর্ব্য,চোষ্য, গিলেছো...এবার দয়া করে বাজার থেকে ঘুরে এসো।নাহলে রান্না চাপবে না,এই বলে দিলুম..।" গিন্নির হুঙ্কার কানে আসতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। "চলো,ভাই..বৌমা আদর করে বলছে..এরপরে তো স্নেহ করবে..!তার আগে.." "হ্যাঁ, দাদা..কিন্তু মাস্ক কোথায় গেল আপনার?" "তোমার বৌদি আমায় বিপত্তারিণীর তাবিজ বেঁধে দিয়ে বলেছে,মাস্ক না পড়লেও চলবে। উনি ঠিক রক্ষা করবেন..!" শুনে কানটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। সত্যি মানুষের সংস্কার এখনো বিজ্ঞানের আগে..! "কিন্তু ভটামদা..." হঠাৎ লক্ষ করলাম ওনার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। এই হালকা গোঁফের ফাঁকে হাসিটা আমি অনেকদিন ধরেই চিনি। "ভাই উপরের ছেঁড়া রেনকোটটা আমায় আজকের মতো ধার দাও।তোমার সঙ্গেই যাবো..ভটাম করে একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়..!" "আবার কিসের ভুত চাপলো মাথায় ভটামদা ?" "তোমার বৌদি আজ বাজারেই আছে...ডিউটি করছে জানো। কেমন মস্তানী করছে একবার দেখবো..! আসলে বাড়িতে তো আমার শাসনেই থাকে..! বাইরে তাই মনটা চায় একটু স্বাধীন হতে। বুঝতেই পারছো মাস্টার..। হ্যাঁ... একটা মাস্কও দিও কিন্তু.." ভটামদা কোনো কাজ 'কারণ' ছাড়া করে না। এটা সর্বজনবিদিত। রহস্যটা কি জানতে হবে আমাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম। বাজার আসার ঠিক আগে ভটামদা বললেন, "দাঁড়াও ভাই..আমাকে নামিয়ে দাও..!তোমার সঙ্গে গেলে আমাকে তোমার বৌদি ঠিক ভটাম করে চিনে ফেলবে।"
গিয়ে দেখি বাজারে আগুন লেগেছে। কোনো সবজি পঞ্চাশ টাকার নীচে নেই। এই বছরটা 'হিস্টোরিকাল মার্ক' হয়ে গেলো। উনিশ সাল 'এ.সি' আর একুশ সাল 'বি. সি'। মানে 'আফটার করোনা' আর 'বিফোর করোনা'। সভ্যতাকে একদম কোমরে দড়ি লাগিয়ে নাচাচ্ছে..! "ভাই তোমার বৌদি এসে গেছে..ওই দেখো..!" ওই 'ক্যালানি' কাণ্ডের পর বৌদিকে একটু বেশী সমীহ করি..ঘরে বাইরে মা কালীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এতদিন মনে হতো,শিবের বুকে পা দিয়ে কালি বুঝি লজ্জায় জিভ বার করে..!কিন্তু বিয়ে করে বছর দুয়েকের মধ্যে মনে হয়, বুকের উপর গিন্নি পা তুলে নাচছে, আর জিভ বার করে ব্যালেন্স রক্ষা করছে...! হঠাৎ দেখি,রাস্তার মাঝখানে একটা অল্পবয়সী ছেলেকে লাঠি করে খুব পেটাচ্ছেন বৌদি। আড়চোখে ভটামদার দিকে তাকালাম। মুখটা পাংশুটে ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ডাউন মেমোরি লেন ধরে এগোচ্ছেন হয়তো..! মজা পেলাম বেশ। আরো একটু ভয় পাওয়াবো বলে ভটাম দার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে বললাম, "আপনার দিকেই তো এগিয়ে আসছে ভটামদা..." আমার কথাটা শুনেই উনি একটু বেশি সতর্ক হলেন বলে মনে হলো। "আমি এলাম ভাই..মনে হচ্ছে,তোমার বৌদি আমায় চিনে ফেলেছে..আমাকে দেখলে আবার নার্ভাস হয়ে আর এক কান্ড..! আসলে খুব ভয় পায় তো আমাকে..!" কিন্তু আমার তা মনে হলো না। বৌদিকে দেখে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালালো মনে হলো ভটামদা..। তাহলে রেনকোট পরার দরকার কি ছিল? কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। "কি ভাই বাজার করা হলো?" মুখ ঘুরিয়ে দেখি সামনে বৌদি। "হ্যাঁ বৌদি..." "আপনার ভটামদা বাড়ি চলে গেলো?" "মানে...." আমি রেনকোট নেবার কেসটা খুলে বললাম। পুলিশ বৌদি শুনে বললেন, "আপনাদের ভটামদাকে এতো ক্যালানি দিলাম,কিন্তু কোনো কাজে এলো না বুঝলেন। তারপরেও একরকম মদ খাওয়া,গালমন্দ করছিল। বাড়িতে টিকতে পারছিলাম না।একটা প্ল্যান এলো মাথায়...." "কি প্ল্যান..?" মাস্ক না থাকলে আমার হাঁ মুখটা বেরিয়ে পড়তো। অনুগল্প শুরু..! "পরশু রাতে সারাদিন ডিউটি করে খুব ক্লান্ত হয়ে সাত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝ রাতে একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি,পাশে ও নেই..! এভাবে মিনিট পনেরো আধবোজা চোখে কেটে গেল। " "তারপর..." আমার চোখের পাতা পড়ছে না। "তারপর আবার কি? টের পেলাম,উনি মদ মেরে আমার পাশে শুলেন। খুব রাগ হলো বুঝলেন ভাই। মাথায় এলো সেদিন আমার হাতেই যে 'মার' খেয়েছে, সেটা জানানো দরকার।তাহলে যদি একটু ভয় পায়..!" "কি করে জানালেন?" "একদম সোজা..হঠাৎ ভুল বকার নাম করে বিড়বিড় করতে শুরু করলাম,'ভটাম...কেমন দিলাম রে সেদিন হারামজাদা? আমার চোখে ধুলো দিবি? এরপর বাজারে তোকে আর একদিন ক্যালবো। বুঝবি সেদিন কত ধানে কত চাল..!" "কাজ হলো বৌদি?" "কাজ মানে? এক চোখে তাকাতেই দেখি ও বিছানায় শুয়ে কাঁপতে আরম্ভ করেছে। পরের দিন থেকেই আমূল পরিবর্তন। পারলে আমায় ধুপ ধুনো দিয়ে সকাল বিকেল পুজো করে..!" "তাই নাকি? বেশ করেছেন..!" "তবে একটা পজিটিভ খবর আছে..!" "পজিটিভ খবর..?" আগে 'পজিটিভ' শব্দটার মধ্যে একটা রিনরিনে ভালো লাগা থাকতো। এখন শুনলে আতঙ্কে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। "আপনাদের ভটামদার করোনা 'পজিটিভ' এসেছে। এইমাত্র রিপোর্ট হাতে পেলাম। দিন তিনেক ঘুষঘুষে জ্বর ছিল। পই পই করে বারণ করে এলাম না বেরোতে..। সকালে পেটে মদ পড়েছে হয়তো..!"
বন্ধুরা,দিন তিনেক পর আপনাদের সব জানাচ্ছি..! বৌদির কাছে 'পজিটিভ' খবর পেয়ে ৪৮ ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরেছে..!
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register