Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

মেহেফিল -এ- কিসসা গদ্যে শাখাওয়াৎ নয়ন

maro news
মেহেফিল -এ- কিসসা গদ্যে শাখাওয়াৎ নয়ন

ঘোড়ামাছের ডায়েরি

তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। রাহেলা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, -বড় হয়ে কী হতে চাও? বেশির ভাগই ডাক্তার, কেউ কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইল। আমি বললাম, -ঘোড়া হতে চাই। ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে দিল। কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকল না, সবাই হাসছে কেন? আড়চোখে তাকাতেই দেখি ম্যাডামও হাসছেন। তিনি হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলেন, -এত কিছু থাকতে তুমি ঘোড়া হতে চাও কেন? -বাবাকে পিঠে চড়াতে পারব। রাহেলা ম্যাডাম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ডাস্টার দিয়ে টেবিলের ওপর সজোরে আঘাত করে বললেন, -চুপ, একদম চুপ। কেউ হাসবে না। ম্যাডাম কাছে এসে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, -বাবা তোমাকে পিঠে চড়ান? -হুঁ। -তুমি পিঠে চড়তে খুব পছন্দ করো? -হুঁ। -মা পিঠে চড়ান না? ‘না’, কথাটি উচ্চারণ করতে পারলাম না। শুধু মাথা ঝাঁকালাম। মায়ের বিষয়ে আরো কিছু জানতে চাইলেন। ঘাড়ভাঙা মূর্তির মতো নতমুখে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কোনো উত্তর দিইনি। বাসায় এসে বাবাকে বলেছি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অঝোরে কেঁদেছি, ফ্রক-জামায় চোখ মুছেছি। বেশ কয়েক বছর পর ভীষণ কৌতূহলে একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, -জীবনে এমন কিছু হতে চেয়েছিলে, যা হতে পারোনি? তিনি আমার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছেন, কিছু বলছেন না। কী জানি কী চিন্তা করছেন। পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে গেলেন। সংবিৎ ফিরে পেলে বললেন, -হুঁ, ঘোড়ামাছ হতে চেয়েছিলাম মা, ঘোড়ামাছ। -ঘোড়ামাছ হতে চেয়েছিলে কেন, বাবা? -কারণ, পুরুষ ঘোড়ামাছ সন্তান ধারণ করতে পারে। অবাক হয়ে গেলাম। কী বলব আর কী বলব না, বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন, -তুমি তো জানো, তোমাকে জন্ম দিতে গিয়ে তোমার মা মারা গেছে। -হুঁ। তিনি জামার কোনা দিয়ে চশমার কাচ ঘষছেন আর বলছেন, -শুভ্রা আমার হাতে হাত রেখে কাঁপতে কাঁপতে নিথর হয়ে গেল। সেদিন আমার মনে হয়েছে, যদি ঘোড়ামাছ হতে পারতাম, তাহলে আমিই তোমাকে গর্ভধারণ করতাম। তোমার মা মারা যেত না। কথাগুলো বলতে বলতে তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। একজন প্রেমিক পুরুষ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য কাঁদছেন। সন্তান হিসেবে বাবাকে কাঁদতে দেখা খুবই কষ্টের, কিন্তু সেই কান্না যদি সন্তানের মায়ের জন্যই হয়, তাহলে তা স্বর্গীয়। এই অপার্থিব দৃশ্যটি জীবনে যতবার দেখেছি ততবারই ভেবেছি, এমন একজন ছায়াময়, হৃদয়বান পুরুষ কি আমার জীবনে জুটবে? একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, বাবা কেমন করে জানি মায়ের ভূমিকাও পালন করছেন। একদিন রাতে খাবারের টেবিলে বললাম, -বাবা, আমার ইচ্ছে হলে তোমাকে ‘মা’ ডাকব, তুমি কিন্তু সাড়া দিয়ো। -তোমার যা ভালো লাগে তা-ই ডাকবে। তার পর থেকে মা দিবসে ‘মা হওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ’ লিখে বাবাকে কার্ড দিই। কার্ডগুলো তিনি ডায়েরির পাশে জমিয়ে রাখেন। বাবার সব ডায়েরির ওপরেই বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ঘোড়ামাছের ডায়েরি’। ডায়েরি ভরা শুধু একটি কথাই লেখা ‘আবার জন্ম হলে একটি লাজুক বাইসাইকেলে চড়ে শুভ্রাদের বাড়ির সামনেই ঘোরাঘুরি করব। শুভ্রাময় কোনো এক শুক্রবারে ভয়ে ভয়েই ভালোবাসি বলে ফেলব। সম্ভব হলে ঘোড়ামাছ হয়ে জন্মাতে চাই, যাতে আর ছেড়ে যেতে না পারে।’ ঘোড়ামাছ হতে চাওয়া এই মানুষটি দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী, মৃত্যুপথযাত্রী। ডাক্তাররা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন। একে একে পবিত্র কোরআন শরিফের সব সূরা পড়ে তার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করছি আর মনে মনে বলছি, -আবার যদি জন্মাই, তোমার কন্যা হয়েই জন্মাতে চাই, বাবা। তোমার কন্যা হয়েই...।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register