Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

Cafe কলামে পূর্বা দাস - ২

maro news
Cafe কলামে পূর্বা দাস - ২

প্রান্তজন

এমন তো হতেই পারে

আজ নিয়ে মোট চারদিন দেখলাম পাগলীটাকে। এরোড্রাম সার্কলের ঠিক আগে ফ্লাইওভারের নীচেই বোধহয় ওর আস্তানা। প্রথমবার অনিতাদিদির সাথে মার্কেটে গেছি ফল কিনতে। ঠিক মনে নেই, জুলাই কি অগাস্ট হবে গত বছরের। রাস্তাটা পার হবার সময় ফুলওয়ালা দেখে আমি দাড়িয়ে গেলাম। এখানে, নাঃ বর্ষার বেল যুঁই না, মরচে পড়া দু একগাছা গ্ল্যাডিওলাস আর পোকায় কাটা পাপড়ি ঝরা গোলাপ দেখেই আমি আহ্লাদিত। নেব আমি। একটা হাতল ভাঙ্গা নীল রঙের কাপে যদি রাখি তাহলে আমার প্রবাসী গাছতলাটাও একটু ঘর ঘর মনে হতে পারে। একটুও দরদাম না করেই কিনে ফেললাম, হ্যা, যাই বলো, `তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম' ই একগোছা। কিন্তু দু সেকেন্ডের বেশী আমার হাতে রইলনা ওরা। ছিনিয়ে নেওয়া হাতের মালিক যেই হোক, তার ধারালো নখে আমার হাতে দু তিন জায়গায় রক্তরেখা। দেখি রাজস্হানী পোশাকে পাগলীটা হি হি করে হাসছে একটু দূর থেকে। আসন্নপ্রসবা। ঘাগরার ওপর ছোট কুর্তি মাতৃত্বের লক্ষণ ঢাকতে পারে নি। অনিতাদি তেড়ে যেতে ঐ অবস্হাতেই ও হেলেদুলে আরো দু চার পা দূরে সরে গেল। ফুলগুলো ছুড়ে ফেলে হাত দিয়ে নিজের পেট দেখাল। তারপর ওর ভাষাতে কি সব বলে গেল একটানা, যার একবিন্দু আমি বুঝতে পারলাম না। শুধু এটুকুই বুঝলাম যে আগামী সন্তানের নাম করে ও খাবার চাইছে। আমি পার্স খুলতেই অনিতাদি বলল, দিতে চাও তো টাকা নয়, কিনে দাও খাবার। কি কিনব? ফলটল কিছু দিই। না, অনিতাদির পরামর্শ, ফল ও পায়। এখানকার ফলওয়ালারা গাই কে তরমুজ খাওয়ায়, ওকে তো নিশ্চয়ই দেয়। তুমি বরং মুখরোচক কিছু কিনে দাও। অগত্যা একটা ভেজ বার্গার আর গোটা ছয়েক পনির টিক্কা কাছেই একটা ফার্ষ্টফুড কর্নারে পেয়ে যাই সাথে একটা ম্যাঙ্গো জুসের বোতল দোকানীর সাহায্যে ওর হাতে পৌছয়।
ফেরার পথে গল্পটা শুনলাম। খুবই সাধারণ ঘটনা এই ঘরানার। এক রাজপুত ডাক্তারের মেয়ে ও। নাম মীরা। বিজ্ঞান নগরে প্রসাদোপম বাড়ী। মহব্বত হয়েছিল ইন্দ্রা মার্কেটের এক মুসলমান ব্যাবসায়ীর একমাত্র ছেলের সাথে। পরিণাম যা হয়- অনার কিলিং এবং পরবর্তীতে মীরার বর্তমান অবস্হা। ডাক্তারবাবু সপরিবারে অর্থাৎ মীরাকে ছাড়াই জয়পুরে ব্যবসা পেতেছেন ।
এদিকে আরেক কান্ড। আমার পাশের বাড়ীর ন্যাড়া ছাদে জমা করা ছোট ছোট পাথরকুচির মধ্যে একটুখানি গর্ত করে ডিম পেড়েছে কমলা ঠোঁটের এক পাখী। কি লম্বা লম্বা পা পাখীটার। বাংলায় এ পাখী দেখিনি কখনো। কিন্তু এখানে প্রচুর। আপাতত একজোড়া এই ছাদের দখলদার। ছবি তুলে সংযুক্তাকে পাঠাতে ও বলল, এগুলো Common Lapwing। দূর বাবা! দেশী নাম বল না। বলে, জানি না। তো আমিই দিলাম একটা নাম ওর। দীর্ঘপদ রোদবিলাসী। প্রকৃতির বিধান, নাকি instinct ( তা সেও তো প্রকৃতিদত্তই) - মেয়ে পাখীটা গত পনেরো দিন এই সাংঘাতিক রোদ্দুরে একদম খা খা খোলা ছাদে ডিমে তা দিয়েই যাচ্ছে। এই পনেরো দিন ও ছাদ ছেড়ে কোথাও যায় নি। ওদের incubation period কতদিন কে জানে! আমি শুধু ভাবছি, বাচ্চাগুলো যখন ডিম ফুটে বেরোবে, কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে ওদের এরকম খোলা জায়গায়। আমার ছাদের ওপরে টিনের শেডের ভেতর থেকে যখন দেখছি ওদের, রোদে আমার চোখ জ্বালা করছে। আর ঐ অতি দূর্বল প্রাণ, সূর্যরশ্মিকে কোনক্রমে বশ করলেও চিল, শকুণ বা ভামের চোখ থেকে বাঁচবে কি করে!
পাগলীর কিন্তু একটা ছেলে হয়েছে নবরাত্রির সময় মানে গত সেপ্টেম্বরের শেষে। তারপরেও ওকে দুদিন দেখেছি ঐ একই জায়গায়। অশ্লীল এক মুখের ভাব আর দেহের ভঙ্গী করে কার্যত ও ভিক্ষাই করে। সমস্ত বোধ লোপ পেয়ে এটুকু আছে যে, ঐরকম করতে পারলে পাঁচ দশ টাকা হাসির ছররা র সাথে এসেও যায়। গত ডিসেম্বরের দশ তারিখে শেষবার ওকে দেখেছি। বাচ্চাটা সেদিন ওর সাথে ছিল না। একই ভাবে ও চৌরাহা তে নেচেকুঁদে লোক হাসাচ্ছিল। কেমন একটা বিতৃষ্ণায় সেদিন আর ওর সামনে যাই নি। সান্তারা আন্টির কাছ থেকে চেয়ে পুরোন সোয়েটার আর ছোট ছোট গরম জামা নিয়েছিলাম। আর রাই বিউটি স্টোর্স থেকে দুটো পুচকি জুতো। বাচ্চাটাকেই দেখলাম না, দেব কাকে! আমার কামওয়ালী বাঈ কৌশল্যা মাসীর নাতনী হয়েছে। ওকেই দিয়ে দিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম পাগলীটার কথা এই চার মাসে। চোখটা জ্বালাচ্ছে। কাল বিকেলে সুবি আই হসপিটালে নাম লিখিয়েছিলাম। কাজ মিটে গেল আধ ঘন্টাতেই। দিনের আলো তখনও প্রচুর। হাটতে থাকি মার্কেটের দিকে। ভালই হল। আম এসেছে আমাদের লোকাল মার্কেটে, কিন্তু সুস্বাদু নয়। দেখা যাক, বঢ়ি মন্ডীতে কি পাওয়া যায়। সার্কলের কাছাকাছি এসে আর চলা যায় না। বৈশাখ মাস। বিয়ে উতসব লেগেই আছে। আর রাজস্হানী বিয়ে, বিশেষতঃ বরযাত্রা, ওঃ দেখার মত। বিশাল প্রসেশনে কি না নেই - হাতি, ঘোড়া, উট....পাগলীটাও দেখি ওদের সাথে নাচতে নাচতে চলেছে। কি বিশ্রী অঙ্গভঙ্গী - আর একটি মহিলাও নেই দলে। মনে পড়ল, শুনেছিলাম যে, ওদের বিয়েতে মেয়েরা বরযাত্রী হতে পারে না। অমঙ্গল হয়। কি ভর করল আমার মাথায়, একদম ওর পাশে গিয়ে ডাকলাম, এ মীরা - মাথা ঘুরিয়ে সোজা আমার দিকে তাকালো। ঐ এক মুহুর্তের তাকানোর অভিব্যক্তির বর্ননা আমার দুর্বল কলমের অসাধ্য। কে জানে, কোন পূর্বজন্মের ডাক শুনেছিল ও। পরক্ষণেই ছুট লাগালো সামনে যেখানে বরের চার ঘোড়ার রথ। এবারে পাগড়ীধারী কয়েক জনের হাতের লাঠি কাজে লাগল। আমি আর দাড়ালাম না। ফলওয়ালা রমজানী চাচাকে দামদস্তুর জিজ্ঞাসা করব ভাবছি, চাচা বলল, " বেটি দেখো কিসমত ইসকি -" বললাম, বাচ্চাটা কোথায় চাচা? আছে তো?" "বিলকুল" আশ্বস্ত করে চাচা। "অবতক জিন্দাই হ্যয়" আর পাঁচটা বেওয়ারিশ বাচ্চার সাথে ফ্লাইওভারের নীচেই বড় হচ্ছে। গাড়ীটাড়ির তলায় না গেলে হয়ত বড়ই হয়ে যাবে কিছুটা যতদিন পর্যন্ত শিশুপাচারকারীদের চোখের মণি না হয়।
মেঘ করেছে বেশ। এই মেঘে বৃষ্টি নেই - শুধু আগুনের মত হলকা হাওয়া। জঞ্জাল, প্লাস্টিক, বালি উড়িয়ে তুমুল হাওয়া - আঁধি। যেটুকু বাষ্প মিশে থাকে হাওয়ার সাথে, বুভুক্ষু মাটি এক নিমেষে শুষে নেয়। চিহ্নও থাকে না। বাড়ি ফিরে রোদবিলাসীর খোঁজ করি। ছাদে যেতে পারি নি। ধূলোতে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আধো অন্ধকারে দেখি, ও ঠিক বসে আছে ওর জায়গাতে। ও কি চোখ খুলে রেখেছে? নাকি বোঁজা? তেজ বাড়ছে ঝড়ের। কাল সূর্যের আলো স্পর্শ করবে তো ওর অনাগত সন্তানদের? জানলা থেকে সরে এলাম। বাইরে তাকিয়ে থেকে কি করতে পারি আমি! কান ধরে সেই ছোট্ট থেকে ঠাকুরমশাই বলে আসছেন, ` সংশয় পারাবার অন্তরে হবে পার' - আর আমি এখনো কিনা.......
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register