Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

মেহেফিল -এ- কিসসা ড. মো. এরশাদুল হক (প্রবন্ধ)

maro news
মেহেফিল -এ- কিসসা ড. মো. এরশাদুল হক (প্রবন্ধ)

উত্তরবঙ্গের লুপ্তপ্রায় বেহারা বা কাহার সম্প্রদায়

বেহারা বা কাহার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য অতীত ইতিহাসনির্ভর। প্রাচীনকালে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা বর-কনে, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ কিংবা অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসালয়ে বহনের কাজ করত। সময়ের বিবর্তনে আজ এ সম্প্রদায়ের ইতিহাস লুপ্তপ্রায়। কালের অতলগর্ভে হারিয়ে যাওয়া বেহারা বা কাহার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পেশা এবং তাদের সৃষ্ট লোকসংস্কৃতি জানা আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠাবহুল গবেষণা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অদ্যাবধি এ সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কোনো গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি। তাই নিজ উদ্যোগে কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করা হয়। গবেষণা সম্পাদনকালে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ সম্প্রদায়ের ইতিহাসের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং এদের লোকসংস্কৃতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি বেহারা বা কাহার সম্প্রদায়ের পরিচিতি নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। বেহারা বা কাহাররা পালকি বহনের কাজ করত। উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে দাসপ্রথা বিলোপের পর বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর এবং মধ্যদেশ থেকে পালকি বাহকরা বাংলায় আসতে থাকে। বহু সাঁওতাল পালকি বাহকের কাজ করতেন। শুষ্ক মৌসুমে তারা নিজেদের এলাকা থেকে এদেশে আসত এবং বর্ষা মৌসুমে আবার চলে যেত। প্রতি বছর বষা মৌসুমের শেষে তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় যেত এবং কোথাও কোথাও অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে সাময়িক আবাসের ব্যবস্থা করে নিত। এক পর্যায়ে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পেশাগত দিক থেকে বেহারা ও কাহার শব্দটি দুটি একে অপরের পরিপূরক। বেহারা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘পালকি-বাহক, কাহার’ (আহমদ শরীফ (সম্পাদক), ঢাকা, ১৯৯৯ খ্রি.)। অনেকের মতে, ইংরেজি বিয়ারার শব্দ থেকে বেহারা নামের উদ্ভব হয়েছে। অন্যদিকে কাহার আরবি শব্দ। ফারসি ভাষায়ও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ জবরদস্তকারী, জুলুমবাজ। হিন্দু ধর্মের একটি তত্ত্বমতে, ‘কাহারদের উৎপত্তি হয়েছে নিম্নবর্ণের এক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এবং এ শ্রেণি ব্রাহ্মণ পিতা ও চণ্ডাল মাতার বংশোদ্ভূত এক মিশ্রবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। কাহারগণ অবশ্য নিজেদের মগধের রাজা জরাসন্দের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। একই সামাজিক মর্যাদার অন্যান্য বর্ণের অনুসৃত ধর্মের মতোই কাহারদের ধর্ম। তাদের অধিকাংশই শিব বা শক্তির পূজারি এবং তাদের মধ্যে বৈষ্ণবদের সংখ্যা ন্যূন। সামাজিক বিচারে কাহারগণ কুর্মি ও গোয়ালা বর্ণের সমকক্ষ (পালকির গান এবং পুরনো দিনের 29, চট্টগ্রাম, ২০১৬ খ্রি.)। এ প্রসঙ্গে জাহিদুর রহমান বলেন- ‘কাহার নিচু জাতের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। কথিত আছে কাহারদের আদি পুরুষ ছিল বাংলার শেষ পাঠান বাদশাহর সৈনিক। মোগল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন করে এবং বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দু চাড়াল বেহারা জাতীয় ডুলি-পালকি বাহকদের নিকট আশ্রয় ও সাহায্য পায়। এরা পরস্পর বিয়ে-শাদিতে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে তারাও ডুলি-পালকি বহন করার পেশা গ্রহণ করে (বাংলাপিডিয়া, অনলাইন ভার্সন)। অতএব, অনুমেয় হয় যে, কাহাররাই বেহারার সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা মূলত পালকি বহনের কাজ করত। নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব’ গ্রন্থে কাহারদের পালকি বহনের বর্ণনা পাওয়া যায়। অতীতে কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি অথবা বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়ি যাতায়াতের জন্য বেহারাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। এ ছাড়াও জমিদার, তালুকদার, ভূস্বামী, রাজা-বাদশা ও উচ্চবিত্তদের নিজস্ব পালকি ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। ‘আঠারো শতকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পালকির প্রচলন শুরু হয়।’ ক্রমেই তা বাঙালি সমাজে যানবাহনের অন্যতম মাধ্যমে রূপ নেয়। সমাজের নিচুবর্ণের লোকেরাই পালকি বহনের কাজ করত। এরাই মূলত বেহারা সম্প্রদায়ভুক্ত। পূর্বে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের মতোই উত্তরাঞ্চলেও এই বেহারাদের সন্ধান মেলে। কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্যবাহী পেশা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। সমীক্ষিত এলাকায় অনুসন্ধানকালে পরিদৃষ্ট হয়েছে, এ সম্প্রদায়ের লোকেরা বর্তমানে জীবন-জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশা যেমন- দিনমজুর, ভৃত্য, কৃষক, মাছ ধরা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি পেশা গ্রহণ করেছে। পেশা বদল করলেও এই ঐতিহ্যবাহী পেশাজীবী সম্প্রদায়ের লোকদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি– যা বাংলার সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মধ্যে পালকি নৃত্য অন্যতম। নব দম্পতিকে পালকিতে বহন করার সময় পথে পথে বেহারা এক হাতে পালকির বর্ধিত কাষ্ঠখণ্ড ধরে অন্য হাতে সবাই এক সঙ্গে তালে তালে গা দুলিয়ে এই নৃত্য পরিবেশন করতো। এই নৃত্য ছিল শাস্ত্রীয় বহির্ভূত নৃত্য। কিন্তু পরিবেশনা ছিল অত্যন্ত চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর। নৃত্যের তালে তালে সংগীত পরিবেশনাও এই সম্প্রদায়ের অন্যতম আকর্ষণ। পালকির প্রসঙ্গটি উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় লোকসংগীত ভাওয়াইয়া গানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন-ও মুই পালকি না চড়োং ধুল্যা নাগিবে সোয়ারিতে না বসোং গাও এড়াইবে। উদ্ধৃত গানে নববধূ শরীরে ধুলা লাগার ভয়ে পালকিতে চড়তে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা নববধূরা যে সর্বদা নিজেকে পরিপাটি রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেই বিষয়টি এখানে ফুটে উঠেছে। লোকসংগীতে যেমন বেহারাদের প্রসঙ্গ এসেছে তেমনি বাংলা লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্য লোকছড়াতেও পালকির বিষয়টি পরিস্ফুট। যেমন- গরিব মানুষ ফড়িং খায় পালকি চড়ে বাহ্যে যায় ॥ অথবা পালকির মধ্যে পাকা ধান বর আসছে মুসলমান বরের মাথায় কাঠ কুঠা বৌয়ের মাথায় ঝাপা দেখে যা সাধের বর চাপদাড়ি তার পাকা॥ প্রবাদে পালকির বিষয়টি এসেছে এভাবে- ‘ঘ্যাগীক শেন পোষে না, ঘ্যাগী পালকি ছাড়া নড়ে না।’ বেহারা পেশা কেন্দ্রিক ধাঁধা যেমন- ১. চার পায়ের জিনিস আমি আট পায়ে হাঁটি রাক্ষস না খোকখোস না আমান মানুষ গিলি পানায়॥ (নীলকমল মিশ্র, লালমনিরহাট, ২০১৬ খ্রি.)। উত্তর- পালকির বেহুরা
২. খাঁচার ভিতর পেছাঁর ছাড় তিন মাথা ছয় পাও॥ উত্তরÑ পালকি এসব উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করা যায়, একসময় বাংলার সমাজজীবনে পরিবেশগত কারণে যোগাযোগের যানবাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার বা প্রচলন অপরিহার্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের কল্যাণে ঐতিহ্যগত এই যানবাহন হারিয়ে গেছে। বহু পথ-পরিক্রমায় বেহারা বা কাহার সম্প্রদায় আজও কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে চির ভাস্বর। একদিকে অবহেলা অন্যদিকে জীবন-জীবিকার নিরন্তর সংগ্রামে অন্য পেশা যেমন কৃষিকাজ, মাছ ধরা ও ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি পেশা গ্রহণ করলেও টিকিয়ে রেখেছে নিজস্ব সংস্কৃতিকে। বলা হয়, আদিম আরণ্যক পরিবেশে পশুজগৎ থেকেই মানুষের উদ্ভব এবং প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশেই মানবসভ্যতার বিকাশ। একাধারে ভয়ংকর ও উপকারী প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত সংগ্রামশীল মানুষ নিজেকে ও গোষ্ঠীকে ক্রমাগত এবং স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা থেকেই গড়ে উঠেছে নানা বিশ্বাস, আচরণ, অলৌকিকতা ইত্যাদি, যা প্রয়োজনের গণ্ডিমুক্ত হয়ে মানুষের সৃষ্টিশীলতার আলোয় প্রোজ্জ্বল। এরই আলোকে বেহারা সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতি যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ প্রবন্ধে উপস্থাপিত হয়েছে। লেখক-লোকসংস্কৃতি গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register