Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব - ২৪)

maro news
জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব - ২৪)

আকাশি টেবিলক্লথ রহস্য

পর্ব ২৪

একবার ছোটবেলায় মাসীদের প্রডাকশান হাউজের মানে,  প্রযোজিত (যেহেতু সব খরচই মাসীদের!), পরিচালিত ও অভিনীত একটা নাটক দেখেছিলাম গ্রামের একমাত্র ক্লাব - যুগের যাত্রী ক্লাব প্রমোশনে কিছু সাহায্য করে থাকবে, যার মানে একটি ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে মাইকে কানের পোকা বার করে ভোর থেকে রাত অব্দি প্রচার- আসুন আসুন, দেখে যান অশ্রুসজল সামাজিক নাটক ইত্যাদি। সম্ভবত তাদের হার্টথ্রব কচিবুড়ি সে নাটকে একটা ছোট রোল করেছিল সেই সুবাদে। আচ্ছা অসামাজিক নাটক কিছু হয়? আপনাদের জিগেস করছি।) পুরুষবর্জিত নাটক। তাতে সেজমাসী হয়েছিল বিধবা মা, পরদা উঠতেই দেখা গেল সে বসে বসে  ছেঁড়া সেলাই করছে লাস্টসিন অব্দি বসে বসে ওই কাজটিই করে গেল। সাদা শাড়ি, চুলে পাউডার মাখা, পেন্সিলের দাগ দিয়ে মুখে ভাংগা চোরার চিহ্ন।সেই নাটক দেখা ইস্তক আমার সেলাইয়ের প্রতি বিরাগ। সেলাই আমার কাছে কেন যেন দারিদ্র্য আর রিক্ততার প্রতীক হয়ে উঠল।
শুধু নাটকের চরিত্রে নয়, ইন রিয়েল লাইফও, সেজমাসী পড়াশোনার পাশাপাশি সেলাই ফোঁড়াইয়ে নিপুণ ছিল। মেজমাসীও। আমার দিদার কাছ থেকে এটা পেয়েছিল। আমার মার যদিও আমার মতোই সেলাইয়ের নামে গায়ে জ্বর আসত। কথিত আছে, বাবা একবার মাকে কোটের বোতাম লাগিয়ে দিতে বলায়, মা নাকি বোতাম ঘর ঘিরে লাল সুতো দিয়ে প্রজাপতি বা গোলাপ ফুল করে দিয়েছিল। বাবা হয়তো আশা করেছিল সিনেমায় যেমন হিরোইন হিরোর বোতাম পরায়, তেমন হবে। তার বদলে গোলাপ ফুল! 
সেসময় কিন্তু যেকোন বাড়িতে গেলেই দেওয়ালে সেই বাড়ির নারীদের সেলাইয়ের দক্ষতার নমুনা মিলত।তার সবচেয়ে কন উদাহরণ ছিল চটের ওপর শাড়ির পাড় ছেঁড়া সুতো দিয়ে ফুল লতা পাতা ইত্যাদি সৃজন করে তার ওপর লেখা- সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এইটা দেখতে দেখতে ভেতরে যে যে অনিচ্ছাগুলো তৈরি হয়েছে, তার একটা বিস্ফোরণ হল –কিছুতেই সেলাই শিখব না। আর এর আর একটা বাই-প্রোডাক্ট, আমার কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুল যেখানে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মেয়েরা চাকরি করে আর ছেলেরা ঘর সামলায়। এইসব ছেলেদের  স্কুলে অবশ্যপাঠ্য  হোম টেকনলজি, সেখানে ছেলেরা অ্যাটম গেঁথে গেঁথে লেখে- সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে!
ই হোম টেকনলজি অবশ্যই আমাদের সময়ের হোম সায়েন্সের সন্তান। এটা সম্ভবত একটা ক্লাস নাইনে একটা চ্ছিক বিষয় ছিল, কিংবা ইলেভেনে যারা হিউম্যানিটিজ নিত, তাদের পড়তে হত। যারা হোম সায়েন্স নিত, তাদের ছিল দুশ মজা, তারা ভালো ভালো রান্না করত আর খেত, তাদের থেকেও মজা ছিল দিদিমণিদের। প্রথম চাখার অধিকার তাঁদের ছিল কিনা।
বহু চাখুনির গল্প আছে, যারা চাখতে চাখতে পুরো খাবার খেয়ে নিত। সেই এক সাহেব একবার একটা বক শিকার করে এনে রাঁধুনীকে বলেছিলেন জমিয়ে রাঁধতে, তো সে রাঁধুনী একটু চাখতে চাখতে একটা গোটা ঠ্যাংই খেয়ে ফেলল। খাবার টেবিলে একটা মোটে ঠ্যাং দেখে সাহেব তো মহা খাপ্পা, তখন রাঁধুনী তাঁকে বলল বকের একটা ঠ্যাংই হয়। সাহেব রেগেমেগে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন জলার ধারে, যেখানে একটা বক তার প্রিয় ভঙ্গিতে একটা পা বুকে গুঁজে এক ঠ্যাং-এ দাঁড়িয়ে ছিল। রাঁধুনী বলল ‘দেখলেন তো সাহেব, বকের একটাই ঠ্যাং হয়’ সাহেব তখন হাততালি দিলেন। বকটি উড়ে গেল, তার দুটি পা স্পষ্ট এবার। সাহেব কটমট করে তাকাতে রাঁধুনী অবিচলিত ভাবে বলল ‘সাহেব, আপনি খাবার টেবিলে যদি হাততালি দিতেন, তবে তখনি দুটো ঠ্যাং পেতেন’
অতটা না হলেও চাখতে চাখতে অর্ধেক শেষ করে দেওয়া আমরাও করেছি। মা নুন মিস্টি চাখার জন্যে কিছু দিলে অম্লান বনে বতাম ‘কিছু বুঝতে পারলাম না, আরেকবার দাও দেখি’ এরকম দুতিনবার হবার পরেই মা ধরে ফেল অবশ্য! 
যাই হোক, হোম সায়েন্সের প্রতি আমাদের আকর্ষটা ছিল খানিকটা কৌতুক, হয়তো  খানিকটা তাচ্ছিল্য মিশ্রিত।তখনো আই কিউ অর্থাৎ ইন্টেলিজেন্ট কশেন্টের পাশাপাশি ই কিউ অর্থাৎ নাল কশেন্ট শব্দটা তৈরি হয়নি, বিজ্ঞান পড়ার গ্ল্যামার ছিল সবচেয়ে বেশি, আর অংকে কাঁচা, মাথামটা মেয়েরাই আর্টস পড়বে, তারাই হোম সায়েন্স নিয়ে রান্নাবান্না কবে-এম একটা ধারণা ছিল। নিজে কবিতা লিখলেও আমি সেই ধারণার বাইরে ছিলাম না। তাই রান্না, সেলাই এমনকি গানের চর্চাকেও আমার বেজায় মেয়েলি মনে হত।  এইসব বিদ্যার আস লক্ষ্য যে বিয়ের বাজারে দর তোলা, নিজের ভালো লাগাটা গৌণ- এটা বুঝে গিয়ে আমি আরও এসবের বিরুদ্ধে গেছিলাম।জেদ করে গানই শিখিনি। তায় সেলাই ফোঁড়াই
এদিকে হায়, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরতে গেলে  তো আমাকে সেলাই পরীক্ষায় পাস করতেই হবে। কারণ ওই যে য়ার্ক এডুকেশ নামে একটি ভয়ংকর সাবজেক্ট, যা আমার জিনা হারাম করে তুলেছিল। মোজা, রুমাল, টেবিল ক্লথ। দেখতাম বয়েজ স্কুলের বালকরা কি সুন্দর বাড়ি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ছোট ছো গাছ, কুয়তলা সমেত, যেন ঝুল সাজানর এক্সটেন্সন। আর আমাকে শিখতে হবে উল বনা, হেম সেলাই, বখেয়া, কাশ্মীরি স্টিচ। কি বৈষম্য! 
ওয়ার্ক এডুকেশনের ভায়রা ভাই ছিল ফিজিক্যাল এডুকেশন। সে তবু একরকম ভালো, একরকম কেন অনেকটাই। হাত পা নাড়ায় প্রবল অনীহা যাদের, তাদের সপ্তায় একদিন একটু বাধ্যতামূলক ঘাম ঝরানো হত। সেটা আমি মন দিয়েই করার চেষ্টা করতাম। তবে সারাজীবন খুব ভুলভাল কারণে শাস্তি পেয়েছি। ক্লাস ফোরে যেমন সরল মাস্টারমশাইয়ের কাছে বাড়তি হোম ওয়ার্ক করে রাখার জন্যে বকুনি খেয়েছিলাম, তেমনই, একদিন ফিজিক্যাল এডুকেশন ক্লাসে খো খো খেলার সময় মার্ক্স কাটা গেল টিম জেতায় উৎসাহে হাততালি দেওয়ার জন্যে। প্রতিভার অপমৃত্যু আর কাকে বলে? এখন হলে আদর করে নিয়ে গিয়ে চিয়ার লিডার করত!
এর ব্রতচারী অংশটা ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সেই সব চমৎকার গানগুলো- ব্রতচারী হয়ে দেখো, জীবনে কি মজা ভাই/ হয়নি ব্রতচারী যে সে, আহা কি বেচারাটাই,
-যমুনা পুলিনে, 
-চলো কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই
ব্রতচারী করাতে আসতেন খুব ফর্সা এবং খুব বেঁটে এক যুবক, যাঁকে অনেকটা ভিক্টর ব্যানার্জির মতো দেখতে। সেসময় ভিক্টর ব্যানার্জি আমাদের নতুন ক্রেজ। উত্তমকুমার যখন মারা যান , তখন হলে চলছিল সম্ভবত তাঁর শেষ সম্পূর্ণ শুট করে যাওয়া ছবি ‘দুই পৃথিবী’। সেই সিনেমায় ভিক্টর ব্যানার্জি উত্তমকুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে সবার নজর কাড়লেন, তার বছর তিনেক পরে ১৯৮৩ সালে সত্যজিত রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ তে তাঁকে  নিখিলেশ রূপে দেখে তো আমরা মুগ্ধ। স্বাতীলেখার দুটি চুমুর (একটি সৌমিত্র, অন্যটি ভিক্টরের সঙ্গে) কোনটি বেশি ভালো এমন তুলনামূলক আলোচনাও চলত। সেই ভিক্টরের লুক অ্যালাইক যখন আমাদের ‘যমুনা পুলিনে’ নেচে নেচে দেখাতেন, আমাদের হাসি চাপা শক্ত হত। সেই নাচে গানে জমজমাট ব্রতচারী পালা চলাকালীন, এক প্যাচপ্যাচে বিকেলে, মাধবীলতা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে সতীশ খামোখা কেন যে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা, পাশাপাশি শুলেই কি বাচ্চা হয়?’ সেইদিনই  হয়তো নিঃশব্দে আউট অব সিলেবাস জীবনশৈলী শিক্ষা শুরু হয়ে গেল।
তখন হাসাহাসি করলেও আজ মনে হয় ব্রতচারী জিনিসটা এই ডায়েটিং আর জিমের চক্করের তুলনায় অনেক বাস্তববাদী ছিল। অর্থাৎ এই শারীরিক কসরত অনেকটাই কাস্টমাইজড। যাকে যেটা স্বাভাবিকভাবেই করতে হয়, যেমন নাচ, সাইক্লিং বা সাঁতার- সেটাই তার এক্সারসাইজ। এবং সেটা করার সময় মিউজিক  অনেকটাই স্ট্রেস রিলিভারের কাজ করে।
ফিজিকাল এডুকেশনে একরকম উতরে গেলেও ওয়ার্ক এডুকেশন ছিল আমার সাপবাঘ।সম্ভবত লীলা মিশ্র বলে এক  গাঁট্টাগোট্টা মহিলা আমাদের এই কর্মশিক্ষার ক্লাস নিতেন। অন্য ক্লাসে যে আমি কলার উঁচিয়ে থাকি, এঁর ক্লাসে আমার অবস্থা ‘ইঁদুরছানা ভয়ে মরে’। আমাকে দেখলে তাঁর চোখে একটা হাসি ফুটে উঠত, যার মধ্যে থাকত এক চামচ তাচ্ছিল্য, এক চামচ কৌতুক আর এক চিমটে করুণা।হয়তো চেষ্টা করলে আমিও কিছু করতে পারতাম, কিন্তু ওই চাউনিটা আমাকে একেবারে ধসিয়ে দিত।ওতে লেখা ছিল ‘তোমার কিস্যু হবে না’। বছরের পর বছর সেই চাউনির সামনে আমি আমার অত্যন্ত বদখত নীল উলের মোজা (একটা আর একটার চেয়ে বড় ছিল), ট্রাপিজিয়াম শেপের রুমাল, এবং একটা কোণ কোনমতে  শেষ করা টেবিলক্লথ, জীবনে কেউ পরতে পারবে না- এমন পেটিকোট, করে এসেছি। স্বীকার করি এর অনেকগুলোতেই মান্তাদির অবদান ছিল। তবে টেবিলক্লথটা কিন্তু আমার নিজের হাতে করা ছিল। একটি কোণ অবিশ্যি। সেই একটি কোণ প্র্যাক্টিকাল খাতায় কায়দা করে সেঁটে( যাতে অন্য কোণগুলো দেখার কথা অব্দি পরীক্ষক না ভাবেন) টেস্ট পরীক্ষায় উতরে গেলাম। এরপর জল্পনাকল্পনা - মাধ্যমিকে তো এক্সটারনাল একজামিনার আসবেন। তিনি যদি পুরো টেবিল ক্লথটা খুলে দেখতে চান। তাছাড়া পেটিকোটের কাট, বা সোয়েটারের বগল ফেলা সংক্রান্ত প্রশ্ন করলে তো আমি গেছি। এমনিতেই একটি পরীক্ষায় উলের কাপড় কীভাবে মেলতে হয় জিজ্ঞেস করায় বলেছিলাম – তার থেকে ঝুলিয়ে মেলে দেব। আর সিল্কের কাপড় কাচার কৌশল বলেছিলাম- জল খুব গরম করে তার মধ্যে ফোটাব!লীলাদি অজ্ঞান হয়ে যাননি, এই ঢের।
সুতরাং আমার ওয়ার্ক এডুকেশন পরীক্ষা নিয়ে হেব্বি চাপ ছিল বস।  শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর এসেই পড়ল। বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি গোঁফ দাড়ি শোভিত এক পুং পরীক্ষক হাজির। এমন কেউ জন্মেও শোনেনি। সেলাই ফোঁড়াইর পরীক্ষা নেবেন এক পুরুষ! সংশয় এবং অর্ধ-সমাপ্ত, নথি গোপন করা খাতা  নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতে, তিনি একগাল হেসে বললেন, রুমালের শেপটা জ্যামিতির কীসের মতো বলোতো?
ডুবে যাওয়া মানুষ যেমন কুটো আঁকড়ে ধরে, আমি তেমনি করে   বললাম ‘স্কোয়ার স্যার’
‘গুড। ফরমুলা বলো দেখি’
আহা। গরুর রচনা আপনাআপনি শ্মশানের দিকে ঘুরে গেল। জ্যামিতি,পরিমিতি-বল পুরো আমার কোর্টে!
একবারও সেই কুখ্যাত টেবিলক্লথের বাকি তিনটে কোণ খুলে দেখার কথা বললেন না। আজ মনে হয়, জীবনটা ওইরকম। তার শুধু একটুখানি আমরা সবার দেখার জন্যে  সাজিয়ে রেখে দি, বেশিরভাগটাই থাকে অন্তরালে, আমার সেই আকাশিরঙা টেবিলক্লথের মতো!

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register