আবেগ সংযুক্ত শব্দচিত্র চিত্রকল্প ।সংস্কৃত কাব্যে উপমার আধিক্য ছিল। পরবর্তীকালে উপমাই সংহত হয়ে চিত্রকল্প তৈরি করেছে। অনেক সময় উপমা ও চিত্রকল্প পাশাপাশি চললে তাদের অভিন্ন মনে হয় কিন্তু তফাৎ আছে ।কোন তুলনার দায় চিত্রকল্পের নেই। ইমেজ শব্দের অর্থে আমরা চিত্রকল্প নয় রূপকল্প শব্দটি ব্যবহার করব । রূপকল্প চিত্র ধর্মকে ছাড়িয়ে অনেক বিস্তৃত ব্যঞ্জনায় ছড়িয়ে পড়ে। চিত্রকল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য তার সৃজনী ভূমিকা। রূপকল্প শব্দটির ব্যাবহারে এই সৃজনধর্মীতাকে বাস্তব অতিক্রান্ত একটি নবগঠনের দিক বলে মনে করব।অভিজ্ঞতা ও বিষয় (স্পর্শ ,ঘ্রাণ ইত্যাদি )ও আবেদন বা অনুভূতি অনুযায়ী রূপকল্পের অনেক ভাগ আছে ।সেগুলি স্বীকার করেও বলব স্পষ্টতঃ দুটো ভাগে রূপকল্প আলোচনার ক্ষেত্রটি সহজ হতে পারে----১ -মূল রূপকল্প, 2 -সহযোগী রূপকল্প। সহযোগী রূপকল্প আবার মূলতঃ পুনরাবৃত্ত রূপকল্প বা রিকারেন্ট ইমেজ। বিষয় মূল রূপকল্পে থাকবে অস্মিতা ও সোত্তরতা। অতএব ইমেজ অর্থে আমরা রূপকল্প শব্দটিই ব্যবহার করব। জনৈক আলোচকের মতে, পঞ্চেন্দ্রিয় নির্ভর অনুভূতি ,যা দৃশ্যমান,শ্রব্যমান,ঘ্রানানুভূতিক, স্পর্শানুভূতিময় এবং স্বাসানুভূতিলিপ্ত--তাই ই রূপকল্প ।গঠনরীতি অনুসারে রূপকল্প কে সাজিয়ে নেওয়া গেল। ---------সিনেসথিসিয়া
পারসোনিফিকেশন
ইমেজ ক্লাস্টার
চেন ইমেজ
সাবমাজর্ড ইমেজারি
সিনেসথিসিয়া রূপ রচনায় ইঙ্গিত সজ্ঞাত ধারণা অন্য আর এক ইন্দ্রিয়জ ধারণা তৈরি করে দেয়। বয়ে নিয়ে আসে ইন্দ্রিয়জ ও অভিজ্ঞতার প্রতিরূপ :"মেঘের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা গাছ/ বৃষ্টি পেয়ে কাঁপছে থরো থরো/কে জানত; এমন হবে আজ /ও মেঘ, এমন আদর কেন করো?( অগ্নি বসু)"।
মেঘ না প্রেম, কে এসেছিল বুকভরা আদরে প্রিয়াকে জাগাতে?প্রকৃতির প্রতি কবির প্রেম শরীরী হয়েও আবার অশরীরী স্পর্শ এনেছে ।যে বাক প্রতিমা যা রূপকল্প ,চেতনায় গভীরতর অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে তাই ই হল শ্রেষ্ঠ রূপকল্প নির্মিতি। রূপকল্প মূলতঃ প্রতীক ধর্মী ।তবুও শুধুমাত্র প্রতীকী শব্দই রূপকল্প নয় ।কবি জীবনানন্দের মতে, প্রতীকী ও উপকার রসায়ন ই চিত্রকল্প -সেই রূপের অনন্য বিস্তৃতিই রূপকল্প বলে আমরা মনে করি:'কয়েকটা খোঁড়া হাঁস ছেড়ে যায় জলের কিনারা/, সন্ধ্যা আসে মেঠো মানুষের ঘরে ফেরা ধূলো মাখা পায়ে পায়ে' (অজিত বাইরী)।
কবিতার দেহ ঘিরে চিরন্তন চতুরঙ্গ আয়তন সাজিয়ে চলেন কবিরা। সেইসব চতুরঙ্গ বিন্যাস আনে প্রেম প্রকৃতি বিষাদ ও নির্জনতার প্রতিভাস। আমাদের ইন্দ্রিয়জ ভাবনাকে উদ্বেল করে:'ঘাটের /নিবেছে সমস্ত আলো/ মরা নদী নির্জনতা ।আর/ বিষন্ন সন্ধ্যায় একা আমি,'( আহসান হাবীব)। একই বিষন্নতায় একটা অদ্ভূত শূন্যতা ও একাকীত্ব পাঠককে ছুঁয়ে যায় ,যখন কবি বলেন:' ভুলেই গেছো নিভৃত মেঘ/ দূরের মরুভূমি/ তোমার আশায় বসে আছে '(অগ্নি বসু)। পারশোনিফিকেশন বা নরত্ব আরোপ দাঁড়া কবিরা ইমেজ সৃষ্টিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন ।একটা চিত্রময় রূপকল্পে এত
বাধা পড়েছে কতসব রুপোলি ছবি:' পিঠার মতো হলুদ মাখা চাঁদ '--(আল-মাহমুদ) অথবা অন্যত্র দেখি:' আমার ঠোঁট তৃষ্ণার্ত তটরেখার মত ডাকছে'( শামসুর রহমান)। নরত্ব আরোপের যাদু দেখি কবিতার নানান বিভঙ্গে :'খুব শীত করছে বলে কুয়াশায় তৈরি আঁটোসাঁটো কার্ডিগান/গায় দিয়ে পায়ে আমাদেরই দিকে এগিয়ে /আসছে জিয়াভরলি নদী '(অগ্নি বসু)।আপ্রাণ বস্তুতে এই যে প্রাণিক অনুভবের স্তর কে আবিষ্কার করে চলেছেন কবিরা, এখানেই সৌন্দর্য লুকোচুরি খেলে। রূপকল্প পুঞ্জ বা ইমেজ ক্লাস্টারের ব্যবহার কবিতা দেহে পুনরাবৃত্তির ভাবনা মিশিয়ে দেয় ।সাধারণত এইসব ইমেজ জনসংঘ চিত্র রচনার
ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় -"পাথরে খোদিত নাম ধুয়ে যায়/ বন্দীদের স্তবগান শোক সংগীতের সুরে কখনও মিলিয়ে যায় /দুপুরের দাহের ভিতরে থাকে আগ্রাসী ছায়ায়/ধীর সঞ্চরণ পিতার শরীর থেকে যুবরাজ নেমে এসে আমাদের উজ্জ্বল শরীরে ঢুকে পড়ে,,,,,,,"/ যযাতি আতঙ্কে ডুবে হাত পাতে পুত্রের যৌবন ফিরে পেতে /হে নচিকেতা ! প্রাজ্ঞতম বালক!কি জেনেছো বলে /কোটি বছরের দীর্ঘ পরমায় অনিঃশেষ যৌবন সাম্রাজ্য আর/ দেবভোগ্য রমনীর হাতছানি ফিরিয়ে দিয়েছো? (পবিত্র মুখোপাধ্যায়)।কিম্বা কখন ও দেখি চিত্রপুঞ্জেই কবিতার সাজানো শরীর: ট্রেন চলছে/ মেট্রো রেলের /সেন্ট্রাল স্টেশনে/ মাইক্রোফোন বাজছে/চিত্রার্পিত প্লাটফর্ম বিহ্বল হয়ে /শুনছে /জর্জ বিশ্বাসের মন্ত্রস্বর (অগ্নি বসু )। চেন ইমেজারি তে থাকে সংবেদনার ছেদহীন প্রবাহ কখন সূক্ষ্ম, কখনো দীর্ঘ ,কখনো উত্থান-পতন ময়;:" প্রথম বিষাদ-সিন্ধু, আগে বইটা পড়াই ছিল না/ পড়লাম,সেই সঙ্গে দ্বিতীয়টি, শ্রীমদভাগবত/ তৃতীয় যা রাজহংস, কয়েকটি কে ছাড়লাম পুকুরে ,তাকে আমি মুগ্ধ/ করে ফেললাম যে কয়টি উপায়ে তার চতুর্থটি নেই /পঞ্চমটি হলো গিয়ে ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪/ ষষ্ঠ প্রফেসর শঙ্কু, সপ্তম কারণ এই শ্রীমান/,,,,(জয় গোস্বামী)।এই প্রবাহমানতায় চেন ইমেজারি এক অদ্ভুত মায়াময় অনন্তের ধারণায় ফিরে দেখে জীবনকে:' যদি অনন্ত বছর পর ফিরে এসে দ্যাখো/ দেখবে, সেই চাষী মাটি ভেঙে রোপন করছে বীজ/ শ্রমিক খনিগর্ভ থেকে জীবন বাজি রেখে/ তুলে আনছে খনিজ সম্পদ (আব্ দুশ শুকুর খান)। '
কাব্য ঐতিহ্য থেকে কোনো অগ্ৰজ কবির ভাব ও ভাষা নিয়ে নতুন চিত্র প্রতিমা নির্মাণ কে বলে সাবমার্জড্ ইমাজারি। এমন ইমেজ সৃষ্টিতে বহু কবি অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন যদি শঙ্খচিল হয়ে ফিরে আসি আবার/তুমি চিনতে পারবে তো ,বলো?/ দারুচিনি দ্বীপ যদি হই?'(অগ্নি বসু)বস্তুত এ কবিতায় জীবনানন্দের পরিচয় স্পষ্ট।
এভাবে ভাগ না করেও বহু ধরনের ইমেজ কবিতা দেহকে ঘিরে থাকে ,দেখেছি ।সেসব ইমেজ বা রূপকল্পে ফুল, পাখি ,নদী ,সাপ, চাঁদ ,পৃথিবী প্রভৃতি একক পূর্ণতায় ধরা পড়েছে। সবই এক বিশেষ অর্থে আবর্তিত হয়েছে। কখনো কখনো মিথ ও প্রতীক নিজেরাই সৃষ্টি করে নেয় নানান রূপকল্প।কিছু রূপকল্প তুলে দেওয়া হল:ক-গোলাপের মধ্যে যাবো/ ম এলো রক্তাক্ত আঙ্গুল (আসাদ চৌধুরী)/
খ: রাত্রির আঁধার জানে/ নদীতীরে দাঁড়িয়েছি একা নির্মোহ কৃষ্ণের মতো (পঙ্কজ মান্না),গ:চাঁদ এক জীপসী রমনী( রফিক আজাদ)।ঘ: আকাশ ময়ূর-মেঘ লেগেছে চাঁদে ,,,,,(অশোক বিজয় রাহা ),ঙ:রাতজাগা পাখিটির/ডানার মতন নদীকে/ জ্যোৎস্নায় মেলে দিয়েছি( অমিতাভ গুপ্ত),চ:হঠাৎ নদী ধরলো এসে সাপের ফণা (আল মাহমুদ)।
একা নির্মোহ কৃষ্ণের মতো (পঙ্কজ মান্না),গ:চাঁদ এক জীপসী রমনী( রফিক আজাদ)।ঘ: আকাশ ময়ূর-মেঘ লেগেছে চাঁদে ,,,,,(অশোক বিজয় রাহা ),ঙ:রাতজাগা পাখিটির/ডানার মতন নদীকে/ জ্যোৎস্নায় মেলে দিয়েছি( অমিতাভ গুপ্ত),চ:হঠাৎ নদী ধরলো এসে সাপের ফণা (আল মাহমুদ)।
মিথ ব্যবহারের জৌলুসে কখন কখন কবির বক্তব্য হয়েছে তীক্ষ্ণ প্রতীকময় কিন্তু শান্তশ্রী অথবা প্রতিবাদে কঠিন :'এমন সময় প্রমিথিউস, অরণ্যের কোন্ নিভৃতে ফেলে গেলে তোমার আগুন ?'(অগ্নি বসু)।এ প্রসঙ্গে অতীত ভারতীয় স্মৃতি সুরভিত পঙতিও তুলে দিলাম 'জবালা আমাদের জননী/ আর আমরা সত্য কাম /দ্বিজত্বের সাধনা আমাদের( বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
এভাবে সীমিত ক্যানভাসেও দেখি বিভিন্ন ইমেজকে চিহ্নিত করতে গিয়ে দৃষ্টিপথে উঠে আসে অব্যর্থ অব্যক্ত কবি ভাবনার শিল্পিত রূপ। আমাদের চেনা ও জানা ছবি এনে দেয় এক নতুন আস্বাদ। দুই বাংলার যেসব রূপকল্পের কথা বলা হল তার মধ্যে দিয়ে কবি প্রাণের মূল সুরটি ধ্বনিত হয়েছে বলে মনে হয়। পাঠকের মুগ্ধ চোখ দেখুক রূপচিত্র আর মন গ্রহণ করুনরস ---এখানেই কবিতা সার্থকতা পাবে।
0 Comments.