Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

"পাঠগ্রহণের দিনগুলি" সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অমিতাভ দাস (পর্ব - ৭)

maro news
"পাঠগ্রহণের দিনগুলি" সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অমিতাভ দাস (পর্ব - ৭)

পাঠগ্রহণের দিনগুলি

পর্ব - ৭

রাণাঘাট , নদিয়া থেকে নয়ের দশকে দুটো দারুণ কাগজ প্রকাশিত হতো ।  তপন ভট্টাচার্যের 'পাললিক' আর সজ্জ্বল দত্তের 'মধুবন' । দুটো কাগজেই চুটিয়ে লিখেছি ।তপনদার 'চূর্ণী ' আর 'অগ্নিকীট ' দুর্দান্ত লেগেছিল । সজ্জ্বলদার 'স্বাগত শ্রাবণ-জোনাকি' । এই বইটির প্রতি ভালোবাসা আজো অটুট । সজ্জ্বলদা আর লেখেন না ,পত্রিকাটাও বন্ধ । হঠাৎ করেই আবির সিংহের মতো তিনিও কবিতা-জগৎ থেকে হারিয়ে গেলেন ।  তাঁর মতো কবির না লেখা আমাদেরই ক্ষতি । বহু বছর পর তাঁকে সম্প্রতি ফেসবুকে খুঁজে পেলাম । সামান্য বয়স হয়েছে । সেই তেজি , রাগী যুবকটিকে খুঁজে পেলাম না । অনেক শান্ত , স্থিতধী । তবে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সেই আগের মতোই । আগের মতোই সমালোচক । তীব্র এক মেধাবী পাঠক । শুনলাম তিনি আবার কবিতা লিখছেন । জেনে খুব আনন্দ পেয়েছি । তাঁর কবিতার একটু অংশ পড়ুন :
"ইটের জঙ্ঘা ফুঁড়ে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে পুকুরের দিকে ।
টলটলে জলে কুসুম ফোটার ছায়াকল্পনা...
এখন চৈত্র মাস ,তার মানে উষ্ণতা বেশী
মৃদু ঘাস বুদবুদ পার হয়ে কেউ যাচ্ছে...ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে ।
ছবিটা শেষ অব্দি এ রকম হবে :
রাস্তার দুপাশে সাজানো গোলাপঝাড় ,আর
একটা ছেলে সেখানে গোল্লাছুট খেলছে ।"
(নৈসর্গিক অথবা নিছক যৌন কবিতা)
মধুবন পত্রিকার একটা চরিত্র ছিল ।ছিমছাম ঝকঝকে ছাপা একটা কাগজ ।অধিকাংশ সংখ্যায় চারটে করে বিখ্যাত বাংলা কবিতার বইয়ের আলোচনা থাকত ।ফিরে এসো চাকা ,শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা , লালস্কুল বাড়ি ,উন্মাদের পাঠক্রম , আমাদের কবিজন্ম , দেবীপক্ষে লেখা , সেগুন কাঠের পা , ব্যান্ড মাস্টার , অন্ধত্বের প্রশ্নে জড়িত , এসেছি জলের কাছে , অবিদ্যা , জিপসীদের তাবু  এইসব বইগুলোর আলোচনা পড়েছি ।আমার কাছে সেগুলি যত্নে রক্ষিত । বাঁধাই করা । সম্পদ স্বরূপ । আমার কাছে এই ভাবনাটা সে'সময় খুব অন্যরকম ও অভিনব মনে হয়েছিল । প্রকৃত ছোট পত্রিকার মান কেমন হবে , তা মধুবন , পাললিক , ফিনিক্স , হিল্লোল ইত্যাদি পড়ে বুঝেছি । কলেবর বৃদ্ধি নয় , লেখার মানটাই আসল । ভাবনা-চিন্তায় অভিনবত্ব চাই । চাই সাহস ও দৃঢ় মানসিকতা । এক ফর্মা, দু-ফর্মার পত্রিকাও অনিন্দ্য -সুন্দর হয়ে উঠতে পারে সম্পাদকের মুন্সিয়ানায় । মধুবনে কাব্যগ্রন্থের আলোচনা লেখকদের তালিকায় ছিলেন সুজিত সরকার , ফল্গু বসু , সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় , দেবজ্যোতি রায় , তপন ভট্টাচার্য , মঞ্জুষ দাশগুপ্তের মতো কবিতা লেখকরা । মধুবনে 'যুবকের স্নান'-এ পড়লাম সেই চমৎকার কাব্য পংক্তি " নতুন উজ্জ্বল স্তন উড়ু উড়ু ফিকে টিউ ফুল " । ভাবনা-চিন্তাকে যেন তোলপাড় করে দেয় । এই গদ্যে জানলাম দেবারতি মিত্র তাঁর কবিতা সমগ্রের ভূমিকায় বলেছেন ," কবিতায় কোনো চৌকো আকৃতির রত্নভর্তি সিন্দুক নয় , দিগন্তের দিকে ঢেউ খেলানো অদৃশ্য বাতাসকেই আমি খুঁজি যদিও জানি তার দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব "।
প্রশ্রয় পেয়েছিলাম গৌতম সাহার কাছে । তিনি তখন  নদীয়ার ধুবুলিয়া থেকে 'ফিনিক্স' বলে একটা কাগজ করতেন । এখনো অবিশ্যি করেন । কত ভালো ভালো সংখ্যা হয়েছে এই পত্রিকার ।  আমাদের মধ্যে চিঠি চালাচালি হতো খুব । প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই লিখতাম তখন । ফুল নিয়ে একটা চমৎকারর সংখ্যা আছে । আছে পবিত্র-মঞ্জুষ সংখ্যা । তাঁর 'দুখজাগানিয়া' কবিতার বইটি আমার বেশ ভালোই লেগেছিল সে'সময় ।
প্রভাত চৌধুরীর 'কবিতা পাক্ষিক' তখন তরুণ কবিদের ছিল একটা নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম । আমি ছিলাম লেখক ,পাঠক এবং গ্রাহক । প্রচুর কবিতা ছাপা হয়েছে আমার এই কাগজে । পোস্টমডার্ন কবিতা নিয়ে প্রভাত চৌধুরী ,সুজিত সরকার প্রমুখের প্রবন্ধ আমাদের জ্ঞানচর্চাকে মসৃন করেছিল । আমরা পোস্টমডার্ন কবিতা কী তা বোঝার চেষ্টাও করছিলাম । মাঝে মাঝে লেখার যে চেষ্টা করিনি , তা নয় ।
প্রভাত চৌধুরীরর  'কাঠের পা ঘোড়ার পা ,'এক অভিনব শৈলীর কাব্যগ্রন্থ । অরিন্দম নিয়োগীর 'কন্দমূলের আকাশ ,' বিভাবসুর 'হলুদ জেব্রাক্রসিং , ' বিজয় সিংহের 'অযুত মায়াবী ধান্য আর ' নীল হারমোনিয়াম ' ,' সংযম পালের 'ক্বচিত্ মূর্চ্ছার দীপ্তি ' ,অরুণাংশু ভট্টাচার্যের 'হিম:জীবনানন্দের প্রতি ' আর 'শাসন সংক্রান্ত' বিভাস রায় চৌধুরীর 'শিমুল ভাষা পলাশ ভাষা' আমার পাঠ গ্রহণকে সঞ্জীবিত করেছিল । তাঁদের এইসব লেখার কাছে আমরা অনেকেই হয়ত ঋণী ।
"যেন সে শোনে না আমার মৃত্যু
যেন সে আসে না মৃত্যুশয্যায় ।" (রাগ)
দীপক রায় । আমার আরেকজন প্রিয় কবি । অবগুন্ঠনে তাঁর সাক্ষাৎকার  নেবার প্রয়োজনে তাঁর সবকটি বই পড়েছিলাম ।যে বইটি পড়ে তাঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম সেটি  'হে সুন্দর হায় অসুন্দর ।'
তারপর একে একে পড়লাম জগন্নাথের জীবন চরিত , স্লেজগাড়ি ,অংশত সুন্দর ,আকুল ঘন্টা বাজে আনন্দ পাঠশালায় । 'তিন পয়সার যাত্রাপালা'র প্রথম কপিটি দীপক রায় আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটে বর্ণ পরিচয়ে প্রকাশকের ঘরে দাঁড়িয়েই ।এ কাছে আমার পরম পাওয়া ।ক্যুরিয়ারে পাঠিয়েছিলেন'নিঝুম হয়েছে গাছপালা ' আর  'নির্বাচিত কবিতা ।'
দীপক রায়ের সামগ্রিক কাব্যকৃতির ওপর একটা বড়ো লেখা  লিখেছিলাম ইতিকথা পত্রিকায় । প্রকাশিত হয়েছে । যে কথা বলতে চাই তা হলো দীপক রায়ের কবিতা বারবার আমাদের পড়তে হয় ।পড়তে হবে ।নির্বাচিত কবিতা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোনোর মতো একখানি বই । হাতের কাছে রাখি । সহজ সরল চমৎকার দর্শনঋদ্ধ কবিতা লেখেন তিনি ।গভীর তত্ত্ব কথাও সরল ভাবে বলেন । তাঁর কাব্যভাষা সহজেই মগ্ন পাঠকের মন ছুঁয়ে দেয় । একটা সময়ে অবগুণ্ঠনের নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি । তাঁকে লেখা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের অপ্রকাশিত চিঠিও ছেপেছি আমরা । আমার একটি প্রিয় কবিতা--
অপেক্ষা করতে করতে
দিন গেল মাস গেল--বর্ষা বসন্ত গেল
সব পাতা ঝরে পড়ল আমাদের হেমবর্ণ উঠোনে
সেখানে বসে থাকব তোমার না আসা অবধি ।(অপেক্ষা)
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register