- 31
- 0
আশ্রয় কেন্দ্রে পা ফেলানোর জায়গা নেই। যারা আগে আসতে পেরেছে তারা মাদুর পেতে শুয়ে আছে। যেন এক জীবন্ত ভাগার খানা। কেউ কেউ শহরে আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে তাই কিছু জায়গা ফাঁকা হওয়ায় উঠতে পেরেছে সমিরন। আলিফকে একটা মাদুরের উপর পাতলা কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। পরাজিত যোদ্ধার মতো ক্লান্তি নিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে রাত। আজানের সাথে কিছু মানুষ ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় জায়গা করে নামাজের জামাতে দাঁড়িয়েছে। পুটলিটা একপাশে রেখে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বসে বসেই ঝিমুতে থাকে সমিরন। সমিরনের পাশেই এক মাঝ বয়সী লোক খস করে দিয়াশলাই এ ঘষা দিয়ে একটা আকিজ বিড়ি ধরান। সমিরন বিড়ির গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে আঁচল চেপে ধরেন। গন্ধটা আরো উগ্র হতে থাকে হয়তো বিড়ির সাথে গাঁজাজাতীয় কিছু মেশানো হয়েছে। সমিরনের খালি পেট ধূমপান এর গন্ধে বমির মতো উগরে আসতে চায়। সে এবার মুখ খুলে। মিয়া ভাই বিড়িডা একটু দূরে যাইয়া খান। আমার ধুমার গন্ধ সইয্য অয়না। ক্যারে দূরে আমু কে মাতারি, এইডা কী তোমার বাপ দাদার ভিডা পাইছো নি। নামাজ শেষ করে এদিকে আসে ছত্তর মুন্সী। টুপিটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে কী হইছেরে সমিরন। দেহেন্না ভাইজান এই ব্যাডা এহেনে খাড়াইয়া বিড়ি টান্তাছে, হরতে কই হরেনা। অই মিয়া তোমার বাড়ি কই। মাইয়া মানুষ দেখলেই ঘেষতে মন চায়। বিড়িখোর লোকটা কথা না বাড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। সবার কাছে কিছু কিছু চাল ছিল। চালগুলো একসাথে করে, ডাল আর আলু মিশিয়ে রান্না করা হয় সব্জি খিচুড়ি। এভাবে হয়তো দিন তিনেক চলা যাবে কিন্তু বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে তাকিয়ে থাকতে হবে রিলিফের দিকে। খিচুড়ি রান্না হয়েছে সবাইকে কলাপাতায় খিচুড়ি বেরে দেয়া হচ্ছে। আলিফ ক্ষুধায় মুর্ছা যাচ্ছে। দুজনের সামনে দুটো কলাপাতা পাতা আছে। সবাই লাইন ধরে বসে আছে। প্রায় পাঁচশত লোকের খাবার কম কথা নয়। চেয়ারম্যান সাহেবও ৫ বস্তা চাল দান করেছেন। গরম খিচুড়ির ভেতর হাত দিতেই হাত জ্বলে উঠে আলিফের। সমিরন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে বাবা জুরাইয়া লোউক, তারপর খাও। বাইরে মেঘ ডাকছে চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। বৃষ্টির সাথে সাথে বাড়তে থাকে পানি।
একটা স্বেচ্ছাসেবক দল ট্রলার নিয়ে এসেছে। ট্রলার ভর্তি ত্রাণের শুকনা খাবার। চিড়া, গুড়, আটা, এইসব। লোকজনের প্রচন্ড ভিড়। একজন সাদা টিশার্ট ও লাল ক্যাপ পড়া স্বেচ্ছাসেবক হ্যান্ডমাইক দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলছেন। অবশ্য কেউই দাঁড়িয়ে নেই। সবাই বুক সমান পানিতে ভেসে আছেন। যারা সাইজে ছোট তারা সাতরে সাতরে নিজেদের ব্যালেন্স টিক রাখার চেষ্টা করছেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ট্রলারের উপর। আলিফ এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছে। সে মানুষ ঠেলে ট্রলারের সামনে যেতে পারছেনা। জোয়ান মর্দদের ধাক্কাধাক্কির তোড়ে সে যেন ডুবে যাচ্ছে। আলিফ কিছুতেই সামনে এগুতে পারেনা। দেখতে দেখতে সমস্ত ট্রলারই খালি হয়ে যাচ্ছে। আলিফ অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সামনে এগুতে পারেনি। সে খুব ক্লান্ত তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের জ্বরাগ্রস্থ ক্লান্ত মুখটি। তাকে যে ত্রাণ নিয়ে যেতেই হবে। কাল থেকে মা না খেয়ে আছে। ট্রলার ছেড়ে দেয়। সে ট্রলারের পিছনে ছুটতে থাকে। ভাই আমারে ত্রাণ দিয়া যান। আমি পাই নাই। আমার মা অসুস্থ। দেখতে দেখতে অনেক দূরে চলে যায় ট্রলারটি। নদীর স্রোত বাড়তে থাকে। আকাশে বৃষ্টির ঘনঘটা। আলিফের চোখে ক্লান্তি নেমে আসে।
দু’ঘন্টা পর। আলিফ চোখ মেলে তাকায়। সে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। মা তার গালে চুমু খাচ্ছে। আমার বাপধন। আজ তুই তোর বাপের মতো ভাইসা গেলে আমি কী নিয়া বাঁচতাম। আমার মনে কু ডাকছিল তাই বইসা থাকতে পারিনাই। আর একটু হইলেতো তুই ভাইসা যাইতি। তোর মামু আইছে ঢাহা থিকা। আমরা তার লগে ঢাহা যামু। আলিফের চোখে তখনও ভাসছে ট্রলারটি ভটভট শব্দ করে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
0 Comments.