Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় - ১১

maro news
সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় - ১১

গল্প নেই - ১১

অফিস থেকে ফেরার পথে মাধবের সঙ্গে রাস্তায় চায়ের দোকানের কাছে দেখা। ও আমার বন্ধু দুলালের ছোটো ভাই। বলল, কি ব্যাপার দাদা আপনার অনেকদিন দেখা নেই!

এই কথার আর কি জবাব দেব! আমার সঙ্গে দেখা না হওয়ায় এত অবাক হওয়ার কী আছে। ওর সঙ্গে রোজ দেখা হবেই বা কেন?

তবু বললাম, আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত থাকি। দেখা হওয়ার সুযোগ কোথায়। তুমি ভালো আছ? বাড়ির সবাই ভালো?

বাবা মারা যাওয়ার পর একবার গিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে। তারপর তো আর গেলেন না। মাধব বলল। 

বললাম, অফিস করে তারপর নানা কাজে একেবারে সময় পাই না।

মাধব ওর বাবা মারা যেতেই গোটা বাড়িটার দখল নিয়েছে। আমার বন্ধু দুলাল চাকরির জন্য বাইরে থাকে। কদিনের ছুটিতে বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি আসতে মাধব ঝামেলা করেছে। বাড়িতে ঢুকতেই দিতে চাইছিল না। আমরা সবাই ঝামেলা মেটাতে গিয়েছিলাম। বাবা মাকে নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। বয়স হয়ে গিয়েছে এই সময় নিজেদের ভিটে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তাঁদের মন চায়নি। 

দুলাল ওর বাবা মারা যাওয়ার সময় এসেছিল। তখন ওদের বাড়িতে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। বাইরে থেকে দুলালের চলে আসার কথা ছিল। মাধব কিছুতেই বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে দুলাল কয়েক বছর ভাড়া বাড়িতে থেকে, পরে নিজে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে।

এই মাধবের  সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রাখবার তেমন কোন কারণ নেই।

অফিস থেকে আমি যে পথে বাড়ি ফিরি সেই পথেই চায়ের দোকানটা। মাধব তিন বন্ধুর সঙ্গে চা আর সিগারেট নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল।

বলল, আজ কিন্তু আমাদের বাড়িতে আপনাকে যেতেই হবে। মা সেদিনও আপনার কথা বলছিল। আজ আপনাকে সঙ্গে নিয়ে তবে যাব। মার সঙ্গে তাহলে দেখা হবে।

মাসিমার সঙ্গে দেখা হয়নি বহুদিন। মাধবের কথা ভেবেই যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি।  

বলতে যাচ্ছিলাম অন্যদিন যাবার কথা। মাধব একেবারে হাহা করে উঠল। না দাদা কোনো কথা শুনব না। আজ যেতেই হবে। মাকে তো কদিন বাদেই দাদার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এরপরে এলে দেখাও পাবেন না। আমি আর মাকে কদিন টানব বলুন?

তেমন কোনো জরুরি কাজ ছিল না। মাসিমা এখান থেকে চলে গেলে আবার কবে দেখা হবে কে জানে! দুলালের বাড়িতে যে হুট করে যেতে পারব তাও নয়। ঘণ্টাখানেকের মতো সময় দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া মাসিমার সঙ্গে বহুদিন বাদে দেখাও হবে।

মাসিমা দুলালের বাড়ি চলে গেলে গোটা বাড়িটা মাধবের হয়ে যাবে। সেই কথা ভেবেই কি ও এতটা চনমনে। মনে হল গোটা বাড়িটা পাওয়ার আশায় খুব খুশিতেই আছে। 

মাধব চায়ের কথা বলতে না করলাম। বললাম, তোমাদের বাড়িতে গিয়েই না হয় হবে।

মাধবের একটা সিগারেট ছাড়া অন্য তিন বন্ধুর কাছে বোধহয় আর সিগারেট নেই। ওই একটাই চারজনের ঠোঁটে ঘুরে ঘুরে একটু সময় পরে ফুরিয়ে গেল।

মাধবের এক বন্ধু মাঝেমাঝেই জামা সরিয়ে ঘাড়ের কাছটা কেন চুলকোচ্ছিল জানিনা।

আর একজন বাহাতের কড়ে আঙুলের নোখ দিয়ে দাঁতের ভিতর থেকে কি খুঁজে আনতে চাইছে কে জানে।

আর একজন পকেট থেকে পেন নিয়ে কানের ভিতর ঢুকিয়ে ঘুরিয়েই যাচ্ছে আপন মনে।

মাধব তার মুখের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে কিছু একটা টেনে নিল মাড়ি থেকে। এর আগে হয়ত বিস্কুট খেয়েছিল। মুখের ভিতরে তারই অবশিষ্ট হয়ত একটু ছিল, সেটা খেয়ে নিল।

দুলাল একটু অন্যরকম। ও এইসব পছন্দ করে না। 

মাধবকে কে বলবে আমার বন্ধুর ছোটো ভাই। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। নিকোটিনে ক্লান্ত দাঁত। হাসলে বা কথা বললে মুখটা কেমন দুমড়ে যায়।

মাধবের দুটি ছেলে একটি মেয়ে। বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, ওর ছেলে মেয়েদের রোগের কথা। কত ডাক্তার দেখাচ্ছে কিছুতেই সারছে না। ছোটো ছেলেটির বয়স ছমাস। খুব ভুগছে।

ওর বাড়ির সামনে গিয়ে দরজার কাছ থেকেই মাধব চিৎকার শুরু করে দিল। দেখ কাকে ধরে নিয়ে এসেছি।

ধরে আনবে কেন! আমি কি কোনো অপরাধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম? যাক এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই।

মাসিমা বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। মনে হল কী ক্লান্ত সেই হাসি।

মাধবের বউয়ের কোলে ছমাসের বাচ্চাটি। ওদের পিছনে মাধবের মেয়ে। বছর চারেকের হবে। দিন তিনেক আগে জ্বর থেকে উঠেছে।

মাধবের বড়ো ছেলেটি পেটরোগা। বছর ছয়েকের মতো বয়স। একটা পয়সা নিয়ে একবার মুখে দিচ্ছে আবার বের করে আনছে।

মাধবের বউ তাই নিয়ে বকতেই, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

মাধব বলল, ওকে বকছ কেন? খেলছে।

নোংরা পয়সা মুখে নিয়ে খেলা? মাধবের বউ বলল।

পয়সার মতো জিনিস তা কখনো নোংরা হয়? মাধব আমার সমর্থনের জন্য হে হে করে হাসল। বলল, তোমার আবার বড়ো বেশি শুচিবাই। ওকে পয়সাটা দাও। এই বলে মাধব ওর বউয়ের কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে আদর করতে লাগল।

তিন বন্ধুর কাছ থেকে বারবার নেওয়া সিগারেটে তিনজনের লালায় মেশান মাধবের লালাসিক্ত ঠোঁট। তার ছমাসের বাচ্চাটির ঠোঁট, গাল, চোখ ছুঁয়ে গেল। অবিরাম। 

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register