Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

|| ছাপাখানার গুটেনবার্গ || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

maro news
|| ছাপাখানার গুটেনবার্গ || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

ছাপাখানার গুটেনবার্গ

আজকের দিনটা গুটেনবার্গ সাহেবের মৃত‍্যুদিন। ১৪৬৮ সালের ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে মোটামুটি আটষট্টি বছরের বেশি বয়সে তাঁর প্রয়াণ। জন্মের তারিখ ঠিকমতো জানা যায় না। অনেকে মনে করেন ১৩৯০ সালের শেষ দশকের শেষের দিকে তাঁর জন্ম। অনেকে ভাবেন ১৩৯৮ তে গুটেনবার্গ জন্মেছিলেন।
তো গুটেনবার্গ ছিলেন জার্মান। আর স‍্যাকরা। সোনার অলঙ্কার নিয়ে কাজ করতেন। সেই তিনি নড়াচড়া টাইপের সাহায্যে ব‌ই ছাপানোর যন্ত্র বের করে ফেলেছিলেন, আর তাইতে দুনিয়ার তাবৎ শিক্ষিত লোকের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে পড়েছেন।
 চীন দেশে নাকি কাগজ তৈরি হয়েছিল আর ছাপাখানার ব‍্যবস্থাও সেখানে ছিল। কিন্তু গুটেনবার্গকে কদর ক‍রা হয় এই কারণে যে তিনি ধাতুর রডের উপর টাইপের অক্ষর গড়ে তুলে তা সাজিয়ে সাজিয়ে ছাপানোর বন্দোবস্ত করেন। আর তেলতেলে ছাপার কালি তৈরি করেন।
এর আগে যে কেউ ছাপানোর কথা ভাবেননি, তা কিন্তু নয়। কাঠের তক্তা বা ধাতুর পাতের উপর কুঁদে কুঁদে লিখে, তার উপর কালি বুলিয়ে তা কাগজে ছেপে নেবার পদ্ধতি ছিল বৈকি। কিন্তু ওই যে আলাদা আলাদা এক একটা টাইপ, আর তাকে সাজিয়ে তোলা, এতে সময় বাঁচল অনেক।
গুটেনবার্গ সাহেবের চেষ্টাকে তাই এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে কদর করা হয়।
গুটেনবার্গ সাহেবের বাবা ছিলেন স্বর্ণকার। গুটেনবার্গ নিজেও স‍্যাকরার কাজ জানতেন। কিন্তু তাঁর মাথা খেলত নানা দিকে। সোনার মতো দামি ধাতবপাত সূক্ষ্মভাবে পালিশ করে আয়না বানাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। মণি মাণিক‍্য পালিশেও তাঁর হাতযশ ছিল।
এহেন গুটেনবার্গ একবার মতলব করেছিলেন যে চমৎকার পালিশ করা ধাতবপাতের দর্পণে তিনি স্বর্গীয় পবিত্র আলোক ধরবেন এবং দর্পণে পাকড়াও করা সে আলো ধর্মধ্বজীদের গছাবেন। তো গুটেনবার্গের সে ব‍্যবসা লাটে উঠেছিল বলে শোনা যায়। শুধুমাত্র লাটে ওঠা নয়, নানাভাবে মামলা মোকদ্দমায় তিনি জেরবার হয়েছিলেন।
কারবারে চোট খেলেও গুটেনবার্গের মতো মানুষের শিক্ষা হয়নি। আবার তিনি ছাপাখানার জন‍্য মতলব এঁটেছেন। এক ধনী সুদখোর মহাজনকে জপিয়ে তাঁর ছাপাখানার কারবারে পার্টনার করেছেন। মহাজনের জামাইকে পটিয়েছেন অক্ষরের ডিজাইন তৈরিতে।
 ১৪৫০ সালের দিকে গুটেনবার্গের ছাপাখানা মোটামুটি খাড়া হয়। তাতে তিনি একটা জার্মান কবিতা ছাপেন। কবিরা এ কথা শুনে উৎফুল্ল হতে পারেন।
গুটেনবার্গের পরবর্তী উদ্যোগ হল বাইবেল ছাপানো। সেকালে বাইবেল হাতে লেখা হত। আমাদের দেশেও পুঁথিলেখকদের আদর ছিল। অনেকেই চমৎকার হস্তাক্ষরে লিখতে জানতেন।
কিন্তু বাংলাভূমির লিপিকরদের বড় দোষ ছিল, পুঁথির নকল করতে গিয়ে এখানে ওখানে তাঁরা নিজের মনোমত কথা গুঁজে দেওয়া দোষের বলে মনে করতেন না। বানানের ব‍্যাপারেও আলগা দিতেন। যেটা বুঝতে পারতেন না, সেখানে যাহোক কিছু একটা লিখে ফেলে কাজ সারতেন। ছাপাযন্ত্র এলে এইসব সমস্যা সামলাতে পারা গেল। মুদ্রণ প্রমাদ বলে একটা জিনিস আছে ঠিকই, তবে হস্তলিপিতে তা বিপর্যয়ের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। বাইবেল ছাপানোর উদ‍্যোগ তো নিলেন গুটেনবার্গ। প্রতি পাতায় ধরালেন বিয়াল্লিশটি করে লাইন। এই বাইবেল ছাপানো হল ১৮০ কপি। প্রতি কপির দাম ত্রিশ ফ্লোরিন। ব‌ই য়ের দাম হিসেবে সাংঘাতিক। কেননা, ওই পয়সা রোজগার করতে একটা গড়পড়তা কেরানিকে তিনবছর বেদম খাটতে হত। তবুও ছাপাব‌ই পুঁথির থেকে দামে কম পড়ত। কেননা, পুঁথি হাতে লেখাতে একজন লেখককে প্রায় বছরখানেকের মজুরি কবুল করতে হত। এই যে প্রতি পাতায় বিয়াল্লিশ লাইন করে ছাপানো বাইবেল, তার গোটা আটচল্লিশ কপি টিঁকে আছে। তার দুটি আছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। সেই বাইবেল ব‌ইতে পৃষ্ঠাসংখ‍্যা দেওয়া ছিল না। প‍্যারাগ্রাফ ভাঙাও ছিল না।কিছু কিছু কপি আবার ছাপানোর পর শিল্পীদের দিয়ে রীতিমতো অলঙ্করণ করা হত।
 যাই হোক, গুটেনবার্গের ছাপানো ব‌ইকে আধুনিক প্রযুক্তির কমপিউটার দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাঁর প্রতিটি টাইপ যে হুবহু এক রকম তা কিন্তু নয়। কিছু হেরফের আছে। মনে করা হয়, টাইপের ব‍্যাপারটি গুটেনবার্গ ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলেছেন।
ছাপানো ব‌ই এসে যেতে তা বহু সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছে গেল। মানবসভ‍্যতার এক নতুন পর্যায় এসে গেল। মতপ্রকাশের সুবিধা হল। চিন্তাবিদ ও জ্ঞানী ব‍্যক্তিরা নিজের বক্তব্য ছাপার অক্ষরে জনগণের কাছে তুলে ধরতেন। মিলটন ও ড‍্যানিয়েল ডিফো এ রকম লিফলেট প‍্যামফ্লেট প্রকাশ করে ক্ষমতাসীন শাসকদের ধিক্কার দিতেন।
আমাদের বাংলায় মুদ্রাযন্ত্র আনেন উইলিয়াম কেরি সাহেব ও তাঁর সহযোগী মার্শম‍্যান আর ওয়াটসন।। কেরিকে বাংলাভাষার অক্ষরের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন চার্লস উইলকিনস সাহেব। আর সেই ডিজাইন দেখে লোহার অক্ষর বানিয়ে ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার আর তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকার। হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে এই প্রেস বসে। কেরি বাংলা ভাষার পুরাতনী পুঁথি ছাপাতেন। ভেবেছিলেন এই সব পুঁথির লেখা পড়ে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অন্তঃসারশূন‍্যতা বাঙালিরা সবাই ধরে ফেলবেন। কাজে হল তার উলটো। নিজের ধর্মের ছাপাব‌ই হাতে পেয়ে শুরু হয়ে গেল এক নবজাগরণ। মুদ্রাযন্ত্র এসে যাওয়ায় মতপ্রকাশের বিপুল সুযোগ তৈরি হয়েছে। দিনবদলের স্বপ্ন জেগেছে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register