|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় দীপশেখর দালাল

এইটুকু, প্রলাপদোয়াত

।।১।।
কী যেন অসুখ আছে, কী যেন ভুলের মাটি ছড়াছড়ি চারিদিকে
তাতে কেমন অনাদরে বাড়ছি শিকড়
কেমন রোদের দিকে সহস্রচোখ মেলে ধরছি কোলাহল পাতায়
কেমন পাখিকে বলছি আয়
কেমন পথিককে বলছি আয়
কেমন শীতকে বলছি আয়
কেমন পর্ণমোচীকে বলছি তুমি আরও দু’দণ্ড বাঁচো
শুঁয়োপোকাকে বলছি বিষরোম শেষে রঙিন হও
নারীকে বলছি আরও দূরে দূরে থাকো

অথচ ভুলে থাকছি যে মাটিতে শিকড় বড় আলগা
আমায় ডাকে না কেউ আর, উপদ্রব করে আগাছার ঝোপ
।। ২।।
জলের মধ্যে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি কোন যুগ থেকে
মাথার ওপরে ঘুর্ণি খেয়ে যাচ্ছে চিল
আমার গায়ের পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে নীলতিমি
সরে যাচ্ছে অন্তর্জলি আঁচল
সরে যাচ্ছে আধপোড়া কাঠ
সরে যাচ্ছে দীর্ঘ ছায়া বৃদ্ধ গাছটির
সরে যাচ্ছে প্রেমের কথাগুলি আজন্ম
সরে যাচ্ছে বিরহচিঠির অক্ষর
সরে যাচ্ছে রাত্রির আতরশিশি
সরছে মাতালটির ছেঁড়া চপ্পলটি

আর আমার চোখ ঝাপসা হলো বৃষ্টিফোঁটায়
স্বপ্নের মধ্যে বৃষ্টি পড়ে অনর্গল
।। ৩।।
একটি প্রস্তরখণ্ড তুলে আমি মৃত মানুষটির দিকে ছুঁড়লাম
এবং সে বাঁচার আর্তি নিয়ে তাকালো একবার
যেন আজন্মকাল তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি
ঢিলটি মারলে লাগে কিনা
যেন আজন্মকাল তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তার স্বপ্নের কথাগুলি
যেন কেউ ভালোবাসেনি তাকে গুল্মের মতো
এবং কোনো মহান কীর্তি সে স্থাপনও করেনি মুদ্রাভিক্ষার দিনে

এখন তার স্থিরচিত্রে ফুলেল সরণি
সে কি মরে গিয়েছিল?
।। ৪।।
স্নেহ নেই, ছোঁয়া নেই, কথা নেই বলার কিছু
আর রাত বাড়লে চরিত্রটি আমার
চৌরাস্তার মোড়ে কুকুরের মতো চিৎকার ছাড়ে
একটা-দু’টো ছিঁচকে চোর তাড়া করে, লাথি মেরে পালায়
আমি লকলকে জিভ বার করে আবার কুকুরের মতো ডাক ছাড়ি
রাত কেটে যায়
রাত কেটে যায়
এবং চৌরাস্তার মোড়ে আমার লাশ পড়ে থাকে
।। ৫।।
নিপুণ হাতে কোমরটি খোদাই করার সময়
আমি সময়ের খেয়াল রাখিনি
দিনে দিনে সেখানে সমুদ্র আসলো, মা-মরা পাখিটি এসে বসলো
শস্যতৃণ জন্ম নিলো বর্ষাদিনে
আসনপিঁড়ি হয়ে বসল স্বর্গের নর্তকী
কী রূপ, কী রূপ আহা জোনাকি মরে তাপে
আমার আয়ু ফুরায় সমূহ পতঙ্গশ্রমে
তবু কি এক দুরাশায় ছেনি হাতুড়ি নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি
।। ৬।।
সব লুঠ হয়ে যায় মা, সব লুঠ হয়
সমস্ত ধান, সমস্ত ঊরুর অঙ্গার, সমস্ত ঠোঁট
সমস্ত ধুলোর শব, সমস্ত নৌকো সব মৃত্তিকার উর্বরতা
সমস্ত সূর্যহাওয়া, জ্বলন্ত ভিটে
উর্বর সৈকতঝাউ, পরিদের পালক, তুলোর ঠিকানা
সব লুঠ হয়

খালি সন্ধেউঠোনের লন্ঠনটি লুঠ হয় না
কারা যেন ঠিক দেখতে পেয়ে যায় দালানবাড়িটি
কত আসে, কত কত আসে নবান্নদিনে
দানা খায় সন্ধেবেলা, শেয়াল ঘোরে ঝোপঝাড়ে
সন্ধ্যাতারা পরিব্রাজক হয় চোখের সমুখে
তারপরে লুঠ হয়ে গেল যুবক হরিণটিও
।। ৭।।
মানুষে সুতোই বুনে রেখে যায় কেবল
সুতো বুনে রেখে যায় জোছনাপদ্মবনে
একটি চরকা সযত্নে সে কিনে রাখে সওদাগরের কাছ থেকে
সুতো বোনে এবং সুতো বোনে
চরকা কাটার দিনে মানুষ অভুক্ত থেকে পাহারা দিল সিন্দুকটি
টানটান সুতো তার হিমবাহের গর্ভে জীবাশ্মঘুম দিচ্ছে
মানুষেরা ভুলে যায়
অথচ মানুষ সুতো বুনতেই শিখেছিল পরিত্রাণের রাতে
চরকা খেয়ে চলে গেল উইপোকায়
।। ৮।।
যেটুকু উপায় হয় সেটুকুও কাঙালকে দিয়ে দিলে
আমার ভিক্ষাবৃত্তি ঘুচে যাবে?
পরমার্থ চিন্তায় দেহে কী পেরেক গুঁজব?
সৈনিকের বল্লমের সামনে দাঁড়াব নিরস্ত্র নগ্ন আমি?
আমার শরীর থাকতে নেই?
আমার গায়ের আঁশটে গন্ধ আমি বৃক্ষটিকে দিয়ে যাব না খানিক?
ঘাসের ওপর উদোম শোব না আমি নক্ষত্ররাতে বারবার?

আমি কি পোড়ো বাড়িটির মতো দর্শনীয় আখ্যান হয়ে যাব শেষমেষ?
সূর্যাস্ত ঘোষণা হয়ে আছে?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।