সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১০)

ঢেপ্সির প্রেমকাহিনী

দশম ভাগ

আমি গঙ্গার ধারে এসে বসেই আছি। কিন্তু অনির দেখা নেই। বসে থেকে থেকে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছি। এমনিতেই আমার মাথা গরম ছিল বার তিনেক ফোন করলাম কিন্তু অনি ফোনটা কেটে দিলো। প্রায় এক ঘন্টা পর অনি এলো। অনির একহাতে জুঁই ফুলের মালা আরেকহাতে কতগুলো চাঁপা ফুল। দেখলাম একটি ছেলে ওকে বাইকে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। মুখ কাঁচুমাচু করে বললো ” মহারানী আপনার জন্য ফুল জোগাড় করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। আপনার এই অনুগত দাস কে দয়া করে ক্ষমা করুন।” অতগুলো ফুল দেখে আমার রাগ তখন গলে জল হয়ে গেছে। যখন শুনলাম ফুলগুলো আমার জন্য তখন তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবার জোগাড়। কিন্তু খুশি প্রকাশ করিনি অনির সামনে। অনি আমাকে আলতো করে ধরে পরম যত্নে পরিপাটি করে আমার খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা পরিয়ে দিলো। আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম।
পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে। মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক নাম না জানা পাখির দল কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। গঙ্গার জলে অস্তগামী সূর্যের প্রতিফলনের প্রভাবে চিকচিক করছে। পাশের কালীমন্দিরে বেনেবৌ সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখাচ্ছে। তার পরনে লালপাড় সাদা শারী, হাতে প্রদীপ বড় মায়াবী লাগছে তাকে। কখন যে অনির হাতটা চেপে ধরেছি আনমনে বুঝতেই পারিনি। অনি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। চাঁপাফুল গুলো হাতে দিয়ে বললো এই চাঁপার সুবাস যেমন আটকে রাখা যায় না তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে তেমনি তোমার গুণাবলির ও প্রকাশ ঘটুক। আমি চাঁপা ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বললাম আমার গুণ বিশেষ কিছুই নেই। আমি একটা সাদা পাতা। তুমি তোমার মতো করে অক্ষর বসিয়ে নাও। অনি বললো বেশ তাই হবে। আমার উপন্যাসের নায়িকা তবে তুমি। সন্ধে বেশ ঘনিয়ে এসেছে। স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। আশেপাশের চায়ের দোকানের খালি বেঞ্চগুলো ভরে উঠতে শুরু করেছে। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম হাত ধরে। খানিক দূর এগিয়ে এসে সামান্য একটু অন্ধকার মতো জায়গায় অনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে‌ বললো “ভালোবাসবে আমায়? হবে তুমি আমার?” নিজেকে কোনোভাবেই বাহুডোর থেকে মুক্ত করতে পারলাম না। জড়িয়ে ধরে‌ ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে অনি বললো”পাগলী কাঁদছো কেন আমি তো আছি তোমার পাশে”। আমার থুতনিটা ধরে দুকলি গেয়ে উঠলো
“আমার কাছে তুমি মানে সাত রাজার ধন
আমার কাছে তুমি মানে অন্যরকম
আমার কাছে তুমি মানে আমার পোষা পাখি
তাই দিনে রাইতে চোখ বুজিয়া তোমায় আমি দেখি”…
বাড়ি ফিরে এলাম। আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হলো। মা তখন‌ও ফেরেনি। কিছুক্ষন পর ফিরলো। সন্ধ্যা থেকে আমার মনমেজাজ ভালোই আছে। অজয়ের মায়ের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। বাবা বাড়ি ছিল না তাই আমি আর মা একসাথে শুয়েছিলাম। রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে বাবা মাকে ফোন করে জানালো “ঢেপ্সীর বাবা মারা গেছে আধঘন্টা আগে।” শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। মা রাতেই দাদুর সঙ্গে ঢেপ্সীর বাড়িতে চলে গেল। আমি এতো বড়ো বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। ভীষন ভয় করছিল আমার। অনিকে ফোন করলাম। অনির ফোন সুইচট অফ। ঢেপ্সী আর ওর মায়ের জন্য মনটা ভীষন খারাপ লাগছিল। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি। ভোরবেলা প্রায় তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে মা বাড়ি এলো। আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম। একটু চা করে দিলাম মা আর দাদুকে। মা বললো ” ডেডবডি আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যেতে পারে।”
বাবা ছটার দিকে ফোন করলো ওরা সবাই বডি নিয়ে ঢুকছে। মা তাড়াতাড়ি করে চলে গেলো। আমাকে কিছুতেই সাথে নিলো না। আমি আর দাদু বাড়িতে। অনিকে ফোন করে বললাম ও যেন শ্মশানে যায়। অনি তখন ঢেপ্সীদের বাড়িতেই ছিলো। ভোরবেলা বাবা মা দাহকাজ শেষ করে শশ্মান থেকে বাড়ি ফিরলো। ওদের মুখেই শুনলাম ঢেপ্সী মুখাগ্নি করেছে। আর অজয় শ্মশানে নাকি আকন্ঠ মদ্যপান করে ভীষন বাজেরকম মাতলামি করেছে। মা বাবা এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ঢেপ্সীদের বাড়ি গেলাম আমি আর মা। আমাকে দেখে ঢেপ্সী জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলো। কাকিমা ঘন ঘন জ্ঞান হারাচ্ছে। ওনাকে সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি ঢেপ্সীকে বললাম “কাঁদিস না। কি আর করবি বল। তুই এতো ভেঙে পড়লে হবে বল!? মাকে আগলে রাখ।” আমরা থাকতে থাকতেই অজয়ের মা বাবা এলো। অজয়ের মা একটু লোকদেখানো করে দিদি চুপ করুন কিছু হবে না আমরা সবাই পাশে আছি করে রান্নাঘরে চলে গেল চা করতে।
বাড়ি এসে “কালের মন্দিরা” উপন্যাসটা নিয়ে পড়তে বসলাম। রিমা ফোন করে খবর দিলো ওর বিয়ে ফাইনাল হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে মিনিট দশেক মতো গল্পগুজব করে আবার পড়তে শুরু করলাম। রাত্তিরে অনি ফোন করে ওর জীবনের ভাঙাগড়ার কথা বলছিল। অনি কলেজ টপার ছিল। ওর ভীষণ ইচ্ছে আমি যেন এম‌এ কমপ্লিট করি। আমি ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেছিলাম খেয়াল নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে একটু টুকটাক কাজ করছি হঠাৎ একজন ফোন করে বললো “তুমি দীপা? তোমার নম্বর অনিরুদ্ধ দিয়েছে। আমরা আমাদের ইনস্টিটিউটের জন্য একজন দক্ষ টিচার খুঁজছি। অনিরুদ্ধ তোমাকে সাজেস্ট করেছে। তুমি প্লীজ আমাদের সঙ্গে আজ একবার দেখা করো সকাল দশটার মধ্যে। তোমার এই নম্বরে ঠিকানা মেসেজ করে দিলাম।” বাড়িতে আপাতত পরীক্ষার পরে বসেই ছিলাম তাই বাবাকে জানিয়ে ওখানে গেলাম। ওনারা যথারীতি আমাকে সিলেক্ট করলেন। টিচিং প্রফেশনের মধ্যে জড়িয়ে গেলাম। বেশ এনজয় করছিলাম ব্যাপারটা। আশ্চর্যজনকভাবে এই ইনস্টিটিউটে জয়েন করার এক সপ্তাহের মধ্যে আরোও দুটো টিউশন পেলাম। স্বভাবতই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবে রোজ একবার করে ঢেপ্সীদের বাড়ি যেতাম নিয়ম করে। ঢেপ্সীও বেশ ভালো ব্যবহার করতো, ঝগড়াঝাটি মান অভিমান ছিল না। আমি ভাবলাম ও সবকিছু ভুলে গেছে, আবার আগের মতো সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
ঢেপ্সীর বাবার শ্রাদ্ধের দিন বাড়ি ভর্তি লোকজন। আমাদের পরিবারের ও সবাই সেখানে উপস্থিত। দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া হচ্ছে হঠাৎ করে অজয় তেড়ে এসে বলা নেই ক‌ওয়া নেই সকলের সামনে আমার মাকে এক চড়। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আমার মা কাঁদতে আরম্ভ করেছে। অজয়ের মা বাবা আমার মা বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেছে। ঢেপ্সীর মা, কাকা তাড়াতাড়ি করে ছুটে এসে বলছে তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে অজয়। দাদা বৌদি ভীষন ভালোমানুষ। ওনারা কখনো চুরি করতে পারেন না। অজয় চিৎকার করে বলছে না আমি নিজে দেখেছি ওই জানোয়ারের বাচ্চা খাবার সরিয়ে রাখছে। ঢেপ্সীর কাকা এবার তেড়ে গেলো অজয়ের দিকে। আমার মায়ের হাত দুটো ধরে ঢেপ্সীর মা বারবার ক্ষমা চাইতে শুরু করলো‌। আমার বাবা কাকিমাকে বললো ” বৌদি অতীতে দাদার সাথে আমার একটা ছোট্ট ভুলবোঝাবুঝি হলেও আপনারা আমাদের আত্মীয়সম। আপনাদের এই দুর্দিনে তাই মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারিনি। কিন্তু এই অপমানের পর আর এই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। আপনি আপনার যখন ইচ্ছা আমার বাড়িতে যাবেন। আপনার ভাইয়ের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা আপনার জন্য কিন্তু এখানে আর নয়।” বাবা বেড়িয়ে চলে এলো। আমি আর মাও সাথে সাথেই চলে এলাম।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।