।। বন্দে মাতরম ।। আজকের লেখায় চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

লখনউ-য়ের বাঘিনী বীরাঙ্গনা উদা দেবী

সিপাই বিদ্রোহ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের দাবি ছিল, এটি কেবল দেশীয় রাজা ও নবাবদের ক্ষমতা ধরে রাখার মরীয়া চেষ্টা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ভূস্বামী জমিদার, সেনাদের একাংশ, ব্রাহ্মণরা ও কিছু তৎকালীন বুদ্ধিজীবী। সমাজের একদম নিচের দিকে তাঁদের নজরই পড়েনি। ঝাঁসির রাণি লক্ষ্মীবাঈ, আর অযোধ্যার বেগম হজরত মহল ছাড়া নারীদের ভূমিকার তো প্রশ্নই নেই। সেই সময়ের নারীদের ভূমিকা কার্যত অনুল্লেখিতই রয়ে গিয়েছে। লক্ষ্মীবাঈ ছিলেন ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-র বিধবা পত্নী, যার পালিত পুত্রদের রাজা করায় আপত্তি জানিয়ে ব্রিটিশ তাঁর রাজ্য দখল করতে চেয়েছিল। আর, হজরত মহল হলেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-র পত্নী, যিনি রাজত্ব ব্রিটিশের হাতে তুলে দিয়ে তারস্বামীর মাসিক খোরপোষের ব্যবস্থাপনায় কলকাতায় চলে যাওয়া মানতে পারেননি। নাবালক পুত্র বিরজিস কদরকে নিয়ে অযোধ্যাতেই থেকে যান।
ইওরোপিয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে টমাস মেটকাফ যেমন, ১৮৫৭-র লড়াইকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে মানতে রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, নেহাত বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ। এরিক স্টোকস মনে করেছেন, দর্কচ্যূতি আর সামাজিক মান অবনমনের আশঙ্কায় প্রাচীনপন্থী সমাজের মুসলমান, ব্রাহ্মণ আর রাজপুতরা, যাদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল বেঙ্গল আর্মি, বিদ্রোহ করেছিলেন। এর সঙ্গে স্বাধীনতার স্পৃহার সম্পর্কই নেই। বামপন্থী ইতিহাসদিদ হিসাবে সুপরিচিত রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ও মনে করেছেন, সেই সময়ে জমির উপর দখল রাখা তালুকদার আর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পরস্পর নির্ভরতা থেকেই ঘটছিল এই বিদ্রোহ। আর গৌতম ভদ্রের মতে, এই বিদ্রোহে নিচু তলার মানুষের তেমন কোনও ভূমিকাই নাকি ছিল না।
বরং অর্থনীতিবিদ ডঃ মানস চৌধুরী মনে করেন, সিপাই বিদ্রোহই প্রথম ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা সর্বভারতীয় প্রতিবাদের স্বর তুলে এনেছিল। কারণ, তখন ব্রিটিশের একেকটি বাহিনীতে বহু জাতির, বহু রাজ্যের মানুষ একসঙ্গে থাকা, খাওয়ায় ও বাস করতে বাধ্য হচ্ছিল, যারা এতদিন আলাদা আলাদা স্বাধীন রাজ্যের রাজাদের প্রজা ছিলেন। এই সেনারা আসলে ছিলেন কৃষক। নীলচাষ ও অন্যান্য নানা কারণে এরা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সেনায় ঢুকেছিলেন। সেখানেই তাঁরা নিজেদের প্রথম ভারত নামের একটা দেশের নাগরিক বলে অনুভব করেন। জানতে পারেন, তাঁরা সবাই ইংরেজের কারণে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সেনায় পর্যবসিত হয়েছেন। তাদের উপর অত্যাচার তো আছেই, এখন ধর্মীয় পরিচিতিও নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। তাদের ক্ষোভ তাই হৃত সাম্রাজ্য বা সম্মান ফিরে পাওয়ার লড়াই ছিল না, ছিল ইংরেজের শাসন থেকে মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াস।
স্বাধীনতার অনেক পরে শিক্ষার আলো দলিত সমাজে প্রবেশ করায় সেই সমাজের কথাগুলি ক্রমশ সামনে আসা শুরু হয়। শুরু হয় তাদের সমাজের নানা কিছু নিয়ে খোঁজখবর, অল্পবিস্তর গবেষণা। উঠে আসে অনন্যসাধারণ বেশ কিছু নারী চরিত্রের কাহিনি। এদের বলা হচ্ছে সিপাহি বিদ্রোহের বীরাঙ্গনা। বস্তুত এদের কাহিনি লক্ষ্মীবাঈ বা হজরত মহলের বীরত্বের চেয়ে কোনও অংশে কম তো নয়ই, বরং বহু ক্ষেত্রেই অনেক বেশি। এমনকি, সিপাই বিদ্রোহের অনেক নামি দামী পুরুষ চরিত্রকেও বীরত্বে এরা দশ কদম পিছনে ফেলে দিতে পারেন। তাদেরই একজন ছিলেন উদা সেবী।
উদা দেবীর জন্ম অবধের (এখন বলা হয় অযোধ্যা) রাজধানী লখনউ-এর উজলিয়া গ্রামের এক পাশি পরিবারে। এই গ্রামকে ‘জগরানী’ গ্রামও বলা হয়। পাশিরা দলিত। তাদের পেশা তাড়ি ও নানা নেশার পানীয় বানানো। তখন মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত, গ্রামীন দলিত মহিলাদের তো বটেই। অল্প বয়সেই উদা দেবীরও বিয়ে হয়ে যায় নবাবের বাহিনীর সৈনিক মক্কা পাশির সঙ্গে। উদা দেবী ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, গ্রামের মানুষের উপর ইংরেজের অত্যাচার। দেখে রাগ হয়েছে, মনের ভিতরে সেই রাগ পুষে রেখেছেন আর সুযোগ খুঁজেছেন প্রতিশোধের।
উদা দেবী সম্পর্কে প্রবাদ আছে—
“কোই উনকো হবসী কহতা, কোই কহতা নীচ অচ্ছুৎ
অবলা কোই উনহে বতলায়ে, কোই কহে উনহে মজবুত”
পাশি জাতির উদা এতটাই কৃষ্ণাঙ্গী ও মুখের আদল এমন ছিল যে, অনেকে তাঁকে মনে করতেন, তিনিও বোধ হয় হাবসি। নিচু জাতির তো ছিলেনই। অবলা ভাবতো কেউ কেউ, কিন্তু বাকিরা জানতেন, তাঁর শক্তি কী অপরিসীম।
স্বামীর সুবাদে পরিচয় হয় নবাব-ঘরণী হজরত মহলের সঙ্গে। হজরত মহল নবাবের বেগম হলেও তিনিও এসেছিলেন সমাজের নিচুতলা ব্রাত্য পরিবার থেকে। তিনিও ইংরেজের অত্যাচারের বদলা নিতে চান। উদার মনে ইংরেজ-বিরোধী ক্ষোভের আগুন তাঁর নজর এড়ায়নি। উদার সঙ্গে যেচে সখ্যতা করেন, সেই সুবাদেই উদার মনের কথাও জেনে যান। উদা এক পর্বে এসে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ফেলেন। হজরত মহল তাকেই দায়িত্ব দেন, নারী সৈনিকদের নিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করার। তখনকার দিনে রাণি ও বেগম সাহেবাদের দেহরক্ষী বাহিনী থাকতো। উদা সেভাবেই বাছাই করা লড়াকু মহিলাদের নিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করেন। বাহিনীতে হিন্দু ও মুসলমান নারীরা তো ছিলেনই, ছিলেন অনেক দলিত ও হাবসী মহিলাও, যাদের দাসী হিসাবে নবাবরাই আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসেছিল। দলিত ও হাবসিদের নেওয়ার পিছনে উদা দেবীর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এরা দলিত, গরু ও শুয়োর দুটিই খান, তাই এই পশুদের চর্বি মেশানো টোটার খোল দাঁতে লাটতে কাটতে আপত্তি নেই।
নবাব শর্ত মেনে কলকাতায় গেলেও হজরত মহল যাননি। ইংরেজের মাথাব্যথা ছিলই। ইংরেজ ইতিমধ্যেই অযোধ্যার অনেকটা অংশ, বিশেষ করে ‘লখনউ রেসিডেন্সি’, অর্থাৎ নবাবদের বাসস্থান এলাকা দখলে নিয়েছিল। এর মধ্যেই ছিল সিকন্দ্ররবাগ, যেখানে ছিল ব্রিটিশ গ্যারিসন। ১৮৫৭-তে ব্যারাকপুরের পর ঝাঁসি, মীরাট, কানপুরে বিদ্রোহ করেছেন সেনারা। সমস্ত শক্তি নিয়ে বেগমের ছাতার তলায় একজোট হওয়া বিদ্রোহীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীকে ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন চিনহাটে আক্রমণ করে। ৬০০০ বিদ্রোহী সেনার সামনে মাত্র ৬০০ ব্রিটিশ সেনা খড়কুটোর মত উড়ে যায়, পরাজিত ব্রিটিশ বাহিনী আশ্রয় নেয় লখনৌ রেসিডেন্সিতে। সেই যুদ্ধেই মারা যান উদা দেবীরস্বামী মাক্কা পাশি। ব্রিটিশ বাহিনীর বিদ্রোহী ভারতীয় সেনারা রেসিডেন্সি ঘেরাও করে। শুরু হয় বিখ্যাত লখনৌ অবরোধ। রেসিডেন্সিতে তখন ব্রিটিশের ছোট একটা বাহিনী মজুত। তাদের বার বার আত্মসমর্পণের হুমকি দিলেও তাঁরা সেখানেই থেকে যায়। বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে যোগ দেন হজরত মহলের সেনারাও।
পর্দানসীন মুসলিম নারী বলে হজরত মহল রাণি লক্ষ্মীবাঈর মতো যোদ্ধবেশ ধারণ করেননি। কিন্তু পর্দার আড়াল রেখেও সেই সময় হজরত মহল বিদ্রোহী সেনাদের কাছে গিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন, শুধু উদা দেবীদের নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর ভরসায়। বিদ্রোহীরা রেসিডেন্সি ঘিরে রাখলেও সেখানে হামলা চালায়নি। ভেবেছিলেন, খাদ্য সঙ্কট হলে ব্রিটিশ সেনারা আত্মসমর্পন করবে। আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার কৌশল তাদের জানা ছিল না বলেই আশা করেনি পিছন থেকে ব্রিটিশ ফৌজ আসতে পারে।
দীর্ঘ কয়েক মাস ঘেরাটোপে থাকা ব্রিটিশ সেনাদের মুক্ত করে লখনউ পুনরুদ্ধারে নভেম্বর মাসে জেনারেল কলিন ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে ৯৩ হাইল্যান্ড রেজিমেন্ট গোমতী নদীর দুক্ষিণ তীর ধরে সিকন্দর শাহর প্রাসাদ সিকন্দর বাগের দিকে এগোতে থাকে। সিকান্দর বাগে দু পক্ষের সেনার ভীষণ যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহী সেনাদের অরসা ছিল তীর-ধনুক আর তলোয়ারে। কারণ, গরু আর শুয়োরের চামড়া মেশানো টোটা তাঁরা ব্যবহার করবেন না। সেটাই ব্রিটিশের সুবিধা করে দেয়। এক পর্যায়ে যুদ্ধ হয়ে হাতের নাগালে। সিকান্দর বাগে নিহত হন দু পক্ষের মিলিয়ে ২০০০ এর বেশি সৈনিক। শোনা যায়, তাঁর মধ্যে ৬০০-র মতো ছিল ব্রিটিশ সেনা।
১৮৫৭-র জুন থেকে নভেম্বর চলে অবরোধ। স্বামী মক্কা পাশির মৃত্যুর পর থেকেই প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছিলেন। আহত বাঘিনী উদা। দিনটা ছিল ১৬ নভেম্বর। নিজের বাহিনীকে সিকন্দরবাগ রক্ষার নির্দেশ দিয়ে উদা দেবী দুটি স্নাইপার পিস্তল আর বিপুল সংখ্যক গুলি নিয়ে সিকন্দর বাগের রাস্তায় একটি উঁচু বটগাছে উঠে পজিশন নিলেন। সেই পথে ব্রিটিশ সেনারা এলে কিছু বুঝে উঠবার আগেই উদাদেবীর শব্দহীন স্নাইপার পিস্তলের গুলিতে এঁকে এঁকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকল। একাই সংহার করলেন ৩২ জন (কারও কারও মতে ৩৬ জন) ব্রিটিশ সেনা। ব্রিটিশ সেনানায়করা বুঝতেই পারছিলেন না, গুলি আসছে কোথা থেকে।
পরে এক ব্রিটিশ সেনাপতি লক্ষ্য করেন যে, গুলি এসে বিধেছে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে, নিচের দিকে ঢুকেছে। ওঁই রকম উচ্চতায় ওখানে এই বটগাছটিই আছে। তখন তাঁর নির্দেশে সেই বটগাছ লক্ষ করে হাজারে হাজারে গুলি ছোঁড়া শুরু হয়। হঠাতই বটগাছ থেকে সম্পুর্ন পুরুষের বেশে সজ্জিত একটি প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পরে। দেহটি দেহ গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পরে ব্রিটিশ সেনাপতি লক্ষ করেন যে, সেই বিদ্রোহী সেনা আসলে এক নারী। তাঁর সঙ্গে তখনও একটি গুলিভরা স্নাইপার পিস্তল ও ম্যাগাজিনে গুলি রয়ে গিয়েছে। পরে সিকান্দর বাগের নিহত সৈনিকদের দেহ সনাক্ত করতে গিয়েও অনেক হিন্ধু, মুসলমান ও দলিত (হাবসি) নারীর লাশ পাওয়া যায়।
সিকান্দর বাগের সেই যুদ্ধের বর্ণনায় ডব্লিউ গর্ডন আলেকজান্ডার লিখেছেন, “এছাড়াও…এমনকি ওখানে… মরদেহের মধ্যে কিছু আমাজনের নিগ্রোর লাশও পাওয়া যায়, যাদের শুয়োর বা অন্য কোনও প্রাণির চর্বি মেশানো কার্তুজ ব্যবহারে সমস্যা ছিল না। এরা ধর্মে মুসলমান হলেও রাইফেল নিয়ে লড়ছিলেন। হিন্দু আর মুসলমান সেনাদের হাতে ছিল তলোয়ার। ওরা লড়ছিলেন জংলী বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায়। তাঁদের মৃত্যুর পর জানা যায়, তাঁরা ছিলেন মহিলা।” আর, ‘রেমিনেসেন্সেস অফ গ্রেট মিউটিনি’ গ্রন্থে উইলিয়াম ফোর্বস সিয়ান্দর বাগ দখলের ভয়াবহ যুদ্ধে উদা দেবীর ভূমিকা প্রসঙ্গে লিখেছেন, তাঁর সঙ্গে ছিল দুটি পুরনো ধাঁচের ক্যাভালরি পিস্তল, যার একটি তখনও গুলিভরা অবস্থায় তাঁর বেল্টে ঝুলছে আর তাঁর গুলির থলেটি তখন অর্ধেক ভর্তি। গাছের উপর যেখেন থেকে তিনি গুলি চালাছিলেন, সেই জায়গাটিও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নির্বাচন করে সুরক্ষিৎ করা হয়েছিল। তিনি একাই দু ডজনের বেশি সেনাকে হত্যা করেছেন। (“She was armed with a pair of heavy old-pattern cavalry pistols, one of which was in her belt still loaded, and her pouch was still about half full of ammunition, while from her perch in the tree, which had been carefully prepared before the attack, she had killed more than two -a -dozen men ” )
পাসি উদা দেবী যুদ্ধক্ষেত্রেই স্বামীর ঘাতকদের অনেককে হত্যা করে সিকন্দর বাগে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধে বীরাঙ্গনা’র মৃত্যু বরণ করেন। আজও পাশি সমাজের মানুষ প্রতি বছর ১৬ নভেম্বর সিকন্দর বাগের রাস্তায় সেই বটগাছ যেখানে ছিল। সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান পাশি বাঘিনী উদা দেবীকে। দেড়শো বছরের পরেও উদা দেবী বেঁচে আছেন। সিনাদর বাগে স্থাপিত হয়েছে উদা দেবীর একটি মূর্তি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।