আমি অনেকদিন থেকেই আলোচনা করছি যে সনাতন সংস্কৃতি সত্যের খোঁজ করা ভুলে আজ কিছু ধারণা অবলম্বন করে শুধু বেঁচে রয়েছে। আমরা যা জানি না, সেগুলিই আজ আমাদের বিশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অজ্ঞান জ্ঞানকে সম্পূর্ণ ভাবে হরণ করেছে। অতএব, আমরা আজ যা করছি সেগুলি অস্বাভাবিক কিছু না। এই ক্রমেই আমরা সব সংজ্ঞা গুলিকেও বদলে দিয়েছি। আজ আমরা অনেকেই গুরু বলতেই তাঁকে সদগুরুর আখ্যান দিয়ে দেই এটা না জেনে যে গুরু আর সদগুরুর মধ্যে পার্থক্যটি কি।
যখন দুটি শব্দ আছে “গুরু” আর “সদগুরু” তার মানে নিশ্চয়, তার অর্থ বা অভিব্যক্তি ও আলাদা হবে। কিন্তু আমাদের জন্য তো এইসব জানার বা বোঝার প্রয়োজন নেই, কারণ যেখানে বিশ্বাস আছে, সেখানে সত্যের জন্য কোনো জায়গা নেই। কিন্তু তাও আমার কর্তব্য আমি করছি, যার পড়ার পড়বে। না পড়তে চাইলে, উপেক্ষা করবে।
একজন মন্ত্র গুরু নিশ্চয় সদগুরু হতে পারেন। কিন্তু এটা অনিবার্য না যে একজন সদগুরু তোমার মন্ত্র গুরু হবেন। একজন সদগুরু কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর গুরু হন না, তিনি জগৎগুরু হন।
গুরু – মাতা পিতার থেকে শুরু করে আমাদের শিক্ষকরা, এনারা সবাই আমাদের গুরু। কিন্তু আজকাল আমরা তাঁকেই গুরু বলে সন্মান বা মর্যাদা দেই যিনি আমাদের কানে মন্ত্র দেন বা মন্ত্র দান করেন। মানুষ আজ গুরু খোঁজেও একটি কারণের জন্যে। সেটি হলো…মানুষ একটি ধারণা বানিয়েছে যে ভগবান আছেন, এবং এবার সে এমন একজন কাউকে খোঁজে যে তার এই ধারণাটিকে সমর্থন জানিয়ে বলবেন, হাঁ ভগবান আছেন, তাঁর খোঁজ করো। মানুষ এমন একজনকে খোঁজে যে তাকে বলবে, চিন্তা করো না ভগবান আছেন। এই কথাটি যুগ যুগ ধরে অনেকেই বলে গেছেন বা বলছেন কিন্তু মানুষের চিন্তা আর দূর হয় না। মানুষের কষ্টের অবসান হয় না।
শাস্ত্র বলছে গুরু বাক্য সদা সত্য কিন্তু এটি শুধু মাত্র আমাদের বিশ্বাস হিসাবেই রয়ে গেছে, বাস্তব জীবনে জানিনা এই কথাটির সত্যতা কতটা কার্যকরী। কিন্তু মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করা মহাপাপ কারণ ধারণা ভাঙলে সবাই কষ্ট পায়। যুগ যুগ ধরে এতো আশীর্বাদ পেয়েও আজ মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। পৃথিবী আরো রসাতলে গেছে। গুরুকে আমরা শিব জ্ঞান করি…আমি বলবো, শুধু গুরু কেন, প্রকৃতির প্রত্যেকটি প্রাণী, প্রকৃতির প্রত্যেকটি বস্তুই শিব। তাই সবাইকে সন্মান করা আমাদের পরম কর্তব্য।
গুরু নিশ্চয় দেবতা, কারণ তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক মার্গ প্রশস্ত করেন। গুরু আধারে বীজ রোপন করেন কিন্তু তিনি সেই আধারের মালিক হন না। তোমার কর্মের মালিক ও তিনি হন না। তুমি তাঁকে নিজের ইহকাল ও পরকাল দুই সমর্পন করো। নিজের সম্পূর্ণ জীবন তাঁর চরণে সমর্পন করো। কিন্তু তাও অনেক সময়ই গুরুর মন পাওয়া যায় না। বিপদে পড়লেও গুরুকে কাছে পাওয়া যায় না কিংবা শুধু এইটুকু সান্ত্বনা নিশ্চয় পাওয়া যায় যে ঈশ্বর আছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিই কি সবকিছু ঠিক হয়ে যায়? সত্যিটা হলো সময় হলে সবকিছুই একদিন ঠিক হয়ে যায়…ঠিক যেমন রাতের পর দিন আসে…তেমন ভাবেই খারাপ সময়ের পরে ভালো সময় নিশ্চয় আসে।
আমি এটা কোথাও বলার চেষ্টা করছিনা যে গুরু ভক্তি বা গুরুর ওপরে বিশ্বাস রাখা উচিত নয়, কারণ আমি ও একজন গুরু। কিন্তু গুরু তত্বকে জানতে হবে। গুরু কোনো জাদুগর নন, যে নিজের জাদুর ছড়ি ঘুড়িয়ে সবকিছু ঠিক করে দেবেন। গুরু শাস্ত্র জ্ঞান দেবেন, সাধনা শেখাবেন, ঈশ্বর এর কাছে পৌঁছানোর সরল মার্গ প্রদর্শন করবেন। তিনি আমাদের পাপ এবং পুণ্যের কথা বোঝাবেন এবং আধ্যাত্মিক মার্গে চলতে হলে আমাদের করণীয় বা ওকরণীয় কি কি সেগুলি বলবেন। জপ ধ্যান পূজা-পাঠ শেখাবেন। এবং বিভিন্ন মন্ত্র দান করে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন সমৃদ্ধ করবেন। তাই শাস্ত্র বলছে, ইষ্ট, মন্ত্র ও গুরু অভিন্ন। মানুষ কখনো গুরু হতে পারেননা তাই গুরু হলেন স্বয়ং শিব। এই হলো গুরুর যথাযথ বর্ণনা। শাস্ত্রে শুধু মাত্র গুরুর বর্ণনা আছে, কিন্তু সদগুরুর বর্ণনা সেই ভাবে চোখে পরে না কারণ তৎকালীন সমাজে অধিকাংশ গুরুই সদগুরু ছিলেন, যা আজ পাওয়া দুর্লভ।
এবার আলোচনা করি সদগুরু কে নিয়ে। সদগুরু মানে সত্যিকারের গুরু বা সৎ গুরু। দেখা যাক গুরু ও সদগুরুর মধ্যে পার্থক্যটা কি।
– এটি বাধ্যতামূলক নয় যে একজন সদগুরু শাস্ত্রজ্ঞানী হবেন।
– এটি ও বাধ্যতামূলক নয় যে তিনি সব রকমের পূজা-পাঠ বা ধর্মানুষ্ঠান জানবেন।
– একজন সদগুরু কোনো দিনই তোমাদের মিথ্যা ধারণা গুলিকে সমর্থন করবেন না।
– তিনি কোনো দিনই তোমাকে সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন না।
– সদগুরু সর্বদা ত্যাগী প্রকৃতির হবেন। মানে…তাঁর ভৌতিক সুখের কোনো লালসা ও অভিলাষা থাকবে না। তিনি শুধু মাত্র জীবন ধারণ করার জন্যই ভোজন গ্রহণ করবেন।
– সদাচারী হওয়ার সাথে সাথে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, মৃদুভাষী, সরল, ক্রোধ অভিমান ও অহংকার রোহিত হবেন। আন্তরিকতায় তাঁর হৃদয় পূর্ণ থাকবে।
– নিজের শিষ্যদের জন্য তিনি ২৪ ঘন্টা ৭ দিন উপলব্ধ থাকবেন।
– তাঁর নিজের কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা থাকবে না।
– তিনি একজন দ্রষ্টা হবেন।
– তোমার মনের সব সাজানো ধারণা গুলিকে তিনি তছনছ করে দেবেন।
– তোমাকে সত্যর সাথে পরিচয় করানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হবে।
– শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দিয়ে না, যুক্তি, তর্ক ও বিজ্ঞান দিয়ে তিনি সবকিছু বোঝাবেন।
– তিনি তোমাকে শেখাবেন যে নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে যা কিছু আছে, সব কিছুই খালি গল্প।
– তুমি ইহলোক এর কথা বললে তিনি বলবেন…ব্যবহারিক বুদ্ধি দিয়ে বিচার করো। তোমাকে না আমি খাওয়াচ্ছি, না পড়াচ্ছি আর না তোমার ভৌতিক সুখের যোগান দিচ্ছি…তাহলে ইহলোক আমাকে দিয়ে লাভ কি। তিনি তোমাকে কর্মযোগ শেখাবেন। কি ভাবে তোমাকে প্রেরণা দিয়ে জীবনে প্রতিষ্টিত করতে হয়, যাতে জীবনে তুমি ভালো থাকো, সেই প্রচেষ্টা সর্বদা করবেন।
– তুমি পরলোকের কথা বললে তিনি বলবেন…মরার পর কে কোথায় যাবে, সেটা কি তুমি জানো? তুমি ও জানো না, আমি ও জানি না। তাই এই সব অবাস্তব কথা চিন্তা করে সময় নষ্ট করো না।
– তিনি ভগবানের অস্তিত্ব বাদ দিয়ে আগে তোমাকে তোমার প্রাকৃতিক অস্তিত্ব বোঝানোর চেষ্টা করবেন।
– তিনি তোমাকে তোমার জীবন এর পরিপূর্ণাতাটিকে বুঝতে সাহায্য করবেন।
– আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে তোমার সম্পূর্ণ জীবনকে বদলানোর চেষ্টা করবেন, যাতে তুমি ভালো থাকতে পারো। পরমানন্দে থাকতে পারো।
– তিনি তোমাকে ঐশ্বরিক সত্তা কে বুঝতে সাহায্য করবেন। তিনি তোমাকে সেই ঐশ্বরিক সত্তা কে অনুভব করাবেন।
– তিনি তোমাকে তোমার জীবনের সব দিক গুলি বুঝতে এবং জানতে সাহায্য করবেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ হবে তোমাকে অন্তর থেকে খুশি রাখা।
– তিনি তোমাকে মিথ্যে বন্ধন থেকে মুক্ত করবেন।
– তিনি তোমাকে সমাজের এবং শাস্ত্রের অযুক্তিকর চিন্তাধারার থেকে মুক্ত করবেন।
– তিনি তোমাকে বারবার বোঝাবেন যে স্রষ্টাকে জানতে গেলে সবথেকে আগে তাঁর সৃষ্টিকে জানতে হবে।
– একজন সদগুরু শুধুমাত্র ধর্ম আলোচনা করবেন না। তিনি সমাজ, অর্থনীতি, মানব জীবনের প্রয়োজন, রাজনীতি সবকিছু নিয়ে কথা বলবেন এবং তোমাকে এসবকিছুর মহত্ব বোঝাবেন।
– তিনি শাস্ত্রের গল্প গুলির থেকে তোমাকে বের করে বাস্তবিক জীবনে অনুভব ও অনুভূতির দ্বারা তোমাকে ঐশ্বরিক সত্তার সমীপে নিয়ে যাবেন।
– সদগুরু ধর্মের থেকে কর্ম এবং কর্ম দ্বারা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সেখান। তিনি তোমাকে কোনোদিন ও বলবেন না যে বসে আড়ম্বরের সাথে পূজা-পাঠ করো। কারণ তিনি জানেন পূজা-পাঠ শুধু মাত্র একটি প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ মাত্র, সম্পূর্ণ কিছু নয়। তাই তিনি সত্যের খোঁজ করতে সেখান। তুমি কেন বা কিসের জন্য এইসব ধর্মানুষ্ঠান করছো, তার প্রকৃত কারণ কি, সেটি বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করবেন। এবং অযুক্তিকর জিনিস গুলিকে তোমার মনের থেকে উপড়ে ফেলবেন।
– তিনি তোমাকে প্রশ্ন করতে শেখাবেন। নীরবে চুপ-চাপ কোনো কিছু কোনোদিন ও মেনে নিতে দেবেন না। তিনি তোমার মধ্যে অজ্ঞানতা জাগবেন, যাতে তুমি জ্ঞান পাওয়ার জন্য, নতুন নতুন জিনিস জানার জন্য, প্রকিতকে জানার জন্য, সৃষ্টিকে জানার জন্য সর্বদা উতলা হয়ে থাকতে পারো। তিনি তোমার মনের থেকে সব দুর্বলতা, অন্ধবিশ্বাস ও নিরাশা দূর করে দেন। তিনি তোমাকে অনুভব দেন…গল্প না।
– সবথেকে বড় গুণ যা একজন সদগুরুর মধ্যে থাকে, সেটি হলো পুরাতন জগতের সাথে আধুনিক জগতের এবং বেদ বিজ্ঞানের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের অদ্ভুত মেল্ বন্ধন ঘটান।
আরো অনেক কিছুই লেখা যায়, কিন্তু সদগুরুর গুণের বখান করতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে, কিন্তু তা বলে শেষ করা যাবে না। তাই আজ এখানেই বিরাম টানলাম। সদগুরুকে জানতে হলে আদি যোগী, আদি গুরু সদাশিব কে অতিঅবশ্য জানতে হবে।