মেহেফিল -এ- কিসসা বিপুল জামান

সংগ্রাম

চেনা জানা পরিমণ্ডলে আমার শ্বশুরবাড়ি ‘উদার’ হিসেবে পরিচিত। তারা উদার, কারন তারা যৌতুক নেন নাই। তারা উদার, কারন বৌ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধ বলে জিনিসটা এই সংসারে অনুপস্থিত। তারা উদার, কারন তারা বিয়ের পরেও বৌকে পড়াশোনা করার অনুমতি দিয়েছেন, শুধু তাই না, বরং পড়াশোনা করার খরচও দেন। আমার স্বামী প্রতিদিন ভার্সিটিতে আমাকে ড্রপ করেন। এসবই উদারতা।
আমার মা-খালারা একত্রিত হলেই এসব কথা ওঠে। তারা আশা করেন এমন সোনার টুকরো সংসার দেখে তাদের মেয়েদেরও বিয়ে দেবেন। আমার অন্যান্য বান্ধবীরা এবং অন্যান্য সম্পর্কের বোনেরাও বলে, আমি খুব ভাগ্যবতী। আমার বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি দু’টোই সাপোর্টিং।  আমি তাদের কথায় হাসি হাসি মুখে সায় দেই।  ঠিক, দারুন সাপোর্টিং আমার চারপাশ, প্রতিবেশ।
কিন্তু আমি এতো উদারতা চাইনি। আমি চাইনি আমার শ্বশুরবাড়ি এতো উদার হোক, আসলে আমি চাইনি পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে আমার শ্বশুরবাড়ি হোক। আমি চাইনি আমার স্বামী ভার্সিটিতে সকালে ড্রপ করে আসুক।
আমি চেয়েছিলাম আমার পড়াশোনা শেষ করতে। আমি চেয়েছিলাম বিসিএস ক্যাডার হতে। আমি এডুকেটেড হোমমেকার হতে চাইনি, আমি চেয়েছিলাম ন্যাশন মেকার হতে।
আমার ফ্যামিলি এতো সাপোর্টিং যে আমি এতো আপত্তি জানানোর পরও তারা আমার বিয়ে পিছিয়ে দেয়নি। মেয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ে এটা নাকি শুনতে ভালো। মেয়ে ফাইনাল ইয়ারে এটা বললে নাকি মেয়ের বয়স বেশি শোনায়। বয়সী মেয়েদের এইদেশে বিয়ের বাজারে দর নেই। ফলে দর থাকতে থাকতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। যেদিন বিয়ে হলো তার নয় দিন পরে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। আমি অনেক বলেও বিয়ের অনুষ্ঠান ফাইনাল পরীক্ষার  পরে নিতে পারিনি।
সেসবের  পরও আমি পরীক্ষা দিতে গেছি। রেজাল্টের পর আমি পাশ করেছি জেনে সবাই ধন্য, ধন্য করতে এলো। এতোকিছুর মাঝেও পাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমি অনেক কষ্টে মুখে হাসি ধরে রাখলাম। কিন্তু আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, ‘আজ আমি টেনেটুনে পাস করেছি। কিন্তু গত দুই ইয়ারে আমি টপ করেছিলাম।’
সারাদিনের অভিনন্দন বার্তার পরে রাতে আসে, আসে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সময়। সে সময় পতিদেব বললেন, তুমি পাশ করবে সেটাই তো ভাবিনি। আমি বললাম, তোমার তো অবাক হওয়া উচিত আমি পরীক্ষা দিতে পারলাম কি করে সেটা ভেবে? কোনদিনতো আমাকে মাফ দাওনি। কোনদিনতো ভাবোনি রাত গেলে সকালে আমার পরীক্ষা আছে কি না।
তারপর যা আমাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রতিদিন করতে হয়, ব্লাউজ খুলে বললাম, কি হলো? আজ লাগবে না?
আজ রাতে খাটের দূরত্বটুকু অতিক্রম করে এসে আমার শরীরে হাত দেয়া তার পক্ষে সহজ ছিল না। যেটা তার পক্ষে করা সহজ সে সেটাই করলো। ঠাস করে চড়  মারলো গালে। আমি একবারের জন্য গাল না ছূঁয়ে দেখলাম, না ব্লাউজের বোতাম লাগালাম, সে  অবস্থায় শুয়ে পড়লাম পাশ ফিরে। এখন বাবুর রাগ উঠেছে। তাই খাবে না। না খাক। রাগ পড়লে ক্ষিদে পাবে। হয়ত খেতে ইচ্ছে হবে। খাবার বাড়া থাকলো। ইচ্ছে হলে খাবে।
আমার বাবা পড়ার খরচ দিতে চেয়েছিল। আমার শ্বশুর ভালোমানুষি দেখিয়ে বলেছে, না,  না, বিয়ের পরে মেয়ে এখন আমাদের। নিজের মেয়ের পড়ার খরচ আপনার কাছ থেকে নিতে পারবো না। বাবা হৃষ্টচিত্তে ফিরে গেছেন। দশজনের কাছে বড় মুখ করে আমার শ্বশুরের, শ্বশুরবাড়ির সুখ্যাতি করেছে। বাবা চলে গেলে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বলেছে, ‘পড়ার টাকা নিলে যখন চাকরি করতে চাইবে তখন না করা যাবে না। আর আমরা টাকা দিলে তখন আমরা যা বলবো তাই হবে। টাকা নিয়ে মাথা বেচে দিতে পারবো না।’
আমার উদার শ্বশুর আমার পড়াশোনার খরচ দিয়ে ভবিষ্যতে আমার চলাফেরার রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার চাল চাললেন।
আমার স্বামী প্রতিদিন আমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসেন বটে কিন্তু সেটা তার সময় মতো। প্রতিদিন তাই প্রথম দিকের একটা দুটো ক্লাস মিস করিই। রাতের আদর ভালোবাসার পর ভোর রাতেও তার শরীর আরেক ছপ্পা জেগে ওঠে। সেটাও আমাকে মেনে নিতে হয়। সেই ক্লান্তি কাটিয়ে বৌয়ের হাতে বানানো নাস্তা খেয়ে যখন সাহেবের সময় হয় তখন আমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেন। যেই আমার নাইন্টি আপ এটেন্ডেস ছিল প্রথম দুই ইয়ারে সেই আমার ফাইনাল ইয়ারে জরিমানা দিয়ে এক্সাম দিতে হয়েছে।
তারপরও ক্লাসের বান্ধবীরা যখন বলে যে, ‘তুই খুব লাকি, হাবি প্রতিদিন তোকে পৌঁছে দেয়’ তখন আমি অনিচ্ছায়ও একটু হাসি, কিছু বলার ইচ্ছা করে না, শক্তিও পাই না।
ওদের সাথে কথাবার্তাতেই শুধু না, ক্লাসেও ক্লান্তিতে স্যাররা কী বলছেন বুঝতে পারি না, মাঝে মাঝে শুনতেও পারি না। এই নিয়েও রসিকতা হয়।
স্যার একদিন বললেন, নতুন নতুন বিয়ে হলে জামাইয়ের কথা মনে করে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া খারাপ বা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু বাড়ি গেলেই যেহেতু দেখা হবে আর এই ক্লাস যেহেতু আর দ্বিতীয় বার হবে না তাই জামাইয়ের ভাবনা রেখে ক্লাসে মনোযোগ দেয়াটাই ভালো নয় কি? আমি কান লাল করে বসে থাকলাম। আমার আরক্ত মুখোবয়ব দেখে সবাই আমার আর আমার জামাইয়ের সুখি দাম্পত্য জীবন মনে মনে খুব কল্পনা করে নিলেন।
মাস্টার্সের ফাইনালটা খুব ভালোভাবে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। মনে করেছিলাম এই ক’টা দিন বাড়ি থাকবো। শ্বশুরবাড়ির কারো কাছে আগে থেকে বলিনি। আগে মা-বাবা’র সাথে আলাপ করে তারপর ভেবেছিলাম জামাইকে জানাবো। এখন আমি দু’একটা কথা নিজে থেকে বলি, নিজে নিজে করি। কিন্তু মাকে বলতেই মা বলল, দেখ শর্মীকে বলে। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। মা বললেন, ওর ঘর, ও’কে বলতে হবে না!
বিয়ের আগে আমি আর শর্মী একঘরে একখাটে ঘুমাতাম। আমার বিয়ের পরে শর্মী তার মতো করে ঘর সাজিয়েছে। সে ঘরে কি তবে আমি এখন শুধু আগুন্তক?
মা’র কথা আমি উড়িয়ে দিলাম। শর্মী আবার আপত্তি করবে কেন? মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, শর্মীকে আমি বলছি। বাবা কোন আপত্তি করবে নাতো? মা রান্নাঘর থেকে যেন কথা এড়াতেই বললেন, শর্মীর সাথে আগে কথা বল।
ব্যাপার কি ভাবতে ভাবতে আমি শর্মীর ঘরে ঢুকি। বললাম, আবার আমরা একসাথে থাকতে পারবো। মজা হবে, বল? শর্মী খুব অবাক হয়ে বলল, একসাথে থাকবো মানে? আমি আস্তে করে বললাম, মাস্টার্সের পরীক্ষা এখান থেকে দেব ভাবছি।
তুমি থাকবে কোথায়? এখানে? আমার নিজের পরীক্ষা, আরো অনেক ঝামেলা আছে, এখন আর একসাথে থাকা যাবে না। কি সব বলো না তুমি?
শর্মীর প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝি আমি আজ আমার ঘরে অনাকাক্ষিত। সবখানে এধরনের প্রতিক্রিয়া পেতে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, ভেবে দেখ বিয়ের পরে এ ঘর যখন তোরও থাকবে না তখন তোর কেমন লাগবে? কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। এতোদিনে জেনে গেছি আমি প্রতিবাদ মানেই সম্পর্কের অবনতি। আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, না মানে, মনে করেছিলাম আর কি পরীক্ষার আগে দু’য়েকদিন থাকবো। তেমন কিছু না।
আমার পরীক্ষা তো, তাই বললাম আর কি। দু’একদিনের জন্য কিছু না, কিন্তু এখান থেকে পরীক্ষা দিতে গেলে আমারই হয়ত পড়া হবে না। তুমি কিছু মনে করো না আপা।
না,  আমি শর্মীর কথায় কিছু মনে করি না। কিন্তু আমি ভাবতে থাকি তাহলে আমি কী করবো। পরীক্ষায় আমাকে ভালো করতেই হবে। অনার্সে প্রথম দুই ইয়ারে রেজাল্ট ভালো ছিল বলে সব মিলিয়ে রেজাল্ট একটা হলেও মাস্টার্সে রেজাল্ট ভালো করতে ভালো পরীক্ষা দিতেই হবে। আমার সাপোর্টিং বাবার বাড়িতে কোন রকম আশ্রয় না পেয়ে আমি নিরুপায় হয়ে আমার উদার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসি।
সেই রাতেও পতিদেব আমাকে ভালোবেসে(!) টানে নিজের দিকে। উত্তেজনার আতিশয্যে টের পায়নি সে যে আমি সক্রিয় নই। নিজের মতো নিজেকে সন্তুষ্ট করে গভীর ঘুমে যখন সে নিমগ্ন তখন আমি নিজেকে পরিস্কার করি। একটু পানি খাই। তারপর সাইড ল্যাম্পের আলোতে পড়তে বসি। আমি সবকিছু হারিয়ে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁচেছি যে, আমি কিছুতেই আমার অবশিষ্ট থাকা আমাকে হারাতে পারি না। যাদের আমি আপন, স্বজন ভেবেছি তারা একে একে দূরে সরে গেছে। অর্জিত বিদ্যাই হতে পারে এমন বন্ধু, সহায় যা কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে। এই শক্তির অভাবে আমাকে যা কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।  আর আমি তা মেনেও নিয়েছি। আমি শিক্ষিত হোমমেকার হবো, না শিক্ষিত ন্যাশনমেকার সে সিদ্ধান্ত আমার হবে। কিন্তু আমি যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই তাহলে আমাকে তাদের সিদ্ধান্তের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমি তা চাই না।
আর তাই উদার শ্বশুরবাড়ি বৌ আর সাপোর্টিং বাবার বাড়ির মেয়ে এই আমি স্বামীর শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে এই ক্লান্ত শরীরেও নিজের সংগ্রামের জন্য নিজেকে তৈরি করি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।