ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৪০)

কু ঝিক ঝিক দিন

৪০
তেলিপাড়া লেনের বাড়িটা ছিল আমাদের কাছে এক আশ্চর্য জগত।চারকোনা বাড়ি,মাঝখানে বিশাল উঠোন।দোতলায় থাকতেন মায়ের মামা।এই মামা মায়ের দিদার নিজের পেটের ছেলে নন।কিন্তু ছেলের থেকে কম ছিলেন না।যতদূর মনে পড়ে বড়দিদা বলেছিলেন, বাড়িটা এই মামারই করা।
মামা দাদু ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রধান।দোতলার ঘরে ইজি চেয়ারে শুয়ে তিনি বই পড়তেন।আমার মা ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভাগ্নী। অবশ্য মামার বাড়িতে মায়ের অধিকার ও ভালোবাসা চিরস্থায়ী। ছোটোরা যেমন গেলেই খুকুদি খুকুদি করত,তেমনি বড়রাও খুকুকে চোখে হারাতো।
আমার দিদা জ্যেষ্ঠ কন্যা। তার বড় মেয়ে আমার মা,মায়ের বড় মেয়ে আমি।ফলে আমার প্রতিও ভালোবাসা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া।
মামা দাদুর বিয়ে হয়েছিল।তবে তাঁকে আমি চোখে দেখিনি।মায়ের মুখে শুনেছি, মামিদিদা পাড়ার রাস্তায় হাঁটছিলেন,সেই সময় একটি অল্পবয়সী ছেলে গাড়ি চালানো প্রাকটিস করছিল।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নবীশ সেই চালক গাড়ি নিয়ে মামিদিদার গায়ে উঠে পড়ে।তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হয়।
পুলিস এসে ছেলেটিকে এ্যারেস্ট করলে মামাদাদু মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।কোর্টে জানান,আমার স্ত্রী তো চলেই গেছেন,এখন এই বাচ্চা ছেলেটি কারাগারে থাকলে তার বাবা মায়ের জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে।এ জেলে থাকলে আমার স্ত্রী ফিরে আসবে না। তাছাড়া ইচ্ছে করে খুন তো করেনি।এটা একটা দুর্ঘটনা। নিয়তিই তাকে টেনে নিয়েছে।
এ হেন মামাদাদুর নিজের কোনও সন্তান ছিল না।বড় দিদার সন্তানদের ছেলে মেয়েরাই তাঁর সন্তান ছিল।তাঁর ছিল বিশাল লাইব্রেরি। তাতে পালি ভাষার মূল্যবান পুঁথি থেকে আধুনিক সাহিত্যের নানা সম্ভারে ঠাসা তাক আর বড় বড় কাচ লাগানো কাঠের আলমারি।রাহুল সংস্কৃত্যায়নের যাবতীয় লেখা আমি প্রথম সেখানেই দেখেছিলাম।
মামাদাদু তাঁর এই বিশাল গ্রন্থের সম্ভার আমার বাবাকে দিয়েছিলেন।আমাদের বাড়ির একতলার অংশটা পুরোই ভরে গেল সেই বইয়ে।
তেলিপাড়ার বাড়ি গেলেই আমি গিয়ে বসতাম তাঁর সামনে।আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে তিনি বলতেন,তোমার মার মতো মেধা আর সংস্কৃত, ইংরেজি ভাষায় এমন দখল আমাদের ইউনিভার্সিটিতে একজনও পাইনি আজ অবধি।ওর উচিত ছিল কলেজে পড়ানো।
আমি বললাম,মা তো স্কুলে পড়ায়।
স্কুলে আর কলেজে পড়ানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য। খুকুকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল।একটা মেধাবী ছাত্রী বিয়ের যাতাকলে পড়ে কেমন জীবন কাটাচ্ছে। মামাদাদুর মুখ গম্ভীর হয়ে যেত বলার সময়।
কিন্তু মা তো আমাদের নিয়ে খুশি।তাছাড়া মায়ের ছাত্রীরা মাকে খুব ভালোবাসে।আমি বললাম।
মামাদাদু কঠিন চোখে আমার দিকে তাকালেন।
এটা কোনও কথা হল!যে মেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়তে পারতো তাকে সাত তাড়িতাড়ি বিয়ে দিয়ে তিন তিনটে বাচ্চা দেওর ননদ…আর তোমার বাবা তো সংসার সম্পর্কে কিছুই বোঝে না।মাঝের থেকে খুকুর জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
আমার খুব রাগ হচ্ছিল এসব কথায়।তবু কথা ঘোরাবার জন্য বললাম,মা প্রেসিডেন্সিতে পড়ল না কেন?
বেশ বিরক্তি না তিনি বললেন,তোমার দাদুকে জিজ্ঞেস করো।তিনি তো সেভেন থেকেই বিয়ের সম্বন্ধ দেখছিলেন।ভাগ্যিস খুখু ছোটো খাটো আর রোগা ছিল,তাই পাত্ররা রাজী হচ্ছিল না এতটুকু বাচ্চাকে বিয়ে করতে।অবশ্য ওই একটাই ভাগ্য যে তোমার বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়ে অন্ততঃ পড়াশোনাটা করতে পেরেছে।নইলে যে কি হত কে জানে!
এসব শুনে একদিন দিদাকে বললাম,তোমরা কেন মায়ের বিয়ে এত তাড়াতাড়ি দিলে?আর আমার মা এত সুন্দরী, তাও পাত্রপক্ষ কেন পছন্দ করছিল না?
দিদা বলল,বিয়ে হল সাত জন্মের সম্পর্ক। কার সঙ্গে হবে তা পূর্ব নির্ধারিত।তোমার বাবার সঙ্গে হবে তা লেখা ছিল।তাই হয়েছে।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম,বিয়ে না হয় পূর্ব নির্ধারিত, কিন্তু মাকে পড়াশোনা না শিখিয়ে বিয়ে দিলে কেন?
পড়াশোনা তো শিখিয়েছি।তোমার মায়ের কলেজে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়েছে।বেশি বয়স হয়ে গেলে অন্য মেয়েদের বিয়ে কবে দিতাম?তাছাড়া আমার কোনও ছেলে মেয়েকেই পয়সা দিয়ে পড়াতে হয়নি কখনো।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম,বিনা পয়সায় পড়া যায়?
হ্যাঁ। এরা তো সবাই সব সময় প্রথম হত।স্কলারশিপ, বৃত্তি এসব পেয়েই পিউ পাশ করেছে।এমনকি তোমার দুই মামাকেও ইঞ্জিনিয়ার বানাতে টাকা লাগেনি।তারাও স্কলারশিপ পেয়েছে।
তাহলে কেন আরও পড়ালে না?
দিদা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিতেন,নিজে এতগুলো বাচ্চার মা হও তখন বুঝতে পারবে।
এ বিষয়ে আমার তখন কোনও পরিস্কার ধারণা ছিল না মায়েরা ঠিক কি কি কষ্ট ভোগ করে।আমার কাছে মা মানে একটা নিরাপত্তার বলয়,জ্বর হলে যে মাথায় জলপট্টি লাগায়, কড়া শাসনের গন্ডী অথচ খোলা আকাশ।পড়ার সময় কোনও ছাড় নেই, কিন্তু বাকি সময় যা খুশি করার ছাড়পত্র।মা মানে তেল,হলুদ,মশলার সঙ্গে ধূপ,ট্যালকম পাউডার,বসন্ত মালতী স্নোএর গন্ধ। তার বাইরে আর কিছু ভাবতে রাজি ছিলাম না।
দিদার কথা শুনে তখনি ভেবে নিলাম,দুত্তোর মা হওয়া যদি এত ঝামেলার তবে মা হয়ে কাজ নেই। এমনিতে দুই বোনকে সামলাতেই দিন কেটে যায়,আর কি দরকার বাচ্চার!
কিন্তু একটা জিনিস মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল, আমার মা পৃথিবীর সেরা মেধাবী আর শিক্ষিত মা।বাবাও কথায় কথায় বলত,তোর মায়ের মতো হাতের লেখা, পড়াশোনায় ভালো,নির্ভুল বানান,আর ব্যাকরণে এত পন্ডিত দেখা যায় না।মায়ের স্কুল ও কলেজ জীবনের যত বন্ধু, শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম পৃথিবীর সেরা মা আমারই।
মামাদাদু এক বসন্তের বিকেলে সেই ইজি চেয়ারে বসে বই পড়তে পড়তে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,আমাদের সাত পুরুষেও কেউ খুকুর মতো হতে পারবে না।
সেই মুহূর্তে আমি, এক বারো তেরো বছরের মেয়ে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলাম আমি মায়ের মতো হতেও চাই না।কি হবে মায়ের মতো হয়ে!এত বড় সংসারের দায়িত্ব আর তার সঙ্গে স্বাধীনতার বারোটা বাজাতে আমি রাজি নই।
সেই সময় আমার পায়ে সরসে ফুল লাগানো থাকত।সারাক্ষণ উড়ে বেড়াতাম ডানা মেলে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।নেহাত মানব জন্ম নিয়েছি মা বাবা ঈশ্বরের কাছে আমাকে চেয়েছিলেন বলে,নইলে পরীর মতো ঘুরে বেড়ানোটাই আমার একমাত্র কাজ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।