ডি গুপ্ত লেনের আমাদের নতুন বাড়িটার কাজ যখন শুরু হল,আমরা রোজ স্কুল থেকে ফেরার পথে একবার করে যেতাম।অবশ্যই বাবা মাকে না জানিয়ে।দৌড়ে দৌড়ে যেতাম।তখন লরি করে মাটি এনে জলা জায়গাগুলো ভরাট করা হচ্ছে। আমরা সেটা দেখতেই যেতাম।আর একমুঠো করে মাটি নিয়ে জলে ফেলতাম।ভাবতাম আমাদের হাতের একমুঠো মাটিতেই জল শুকিয়ে সাহারা মরুভূমির মতো হয়ে যাবে। তখনো এত পেপসি বা কোকো কলার যুগ আসেনি যে স্ট্র দিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরো জল নিঃশেষ হয়ে যাবে।
অবশ্য আমার মেজবোন নানা পন্থা রোজই আবিষ্কার করত,কিভাবে দ্রুত জলটা শুকিয়ে যেতে পারে সেই বিষয়ে।একবার তার এমনও মনে হয়েছিল যদি হনুমান থাকত তাহলে সমুদ্রে পাথর ফেলে যেমন ব্রিজ বানিয়েছিল তারা,তেমনি কিছু করা যেত।কিন্তু হায়!কলকাতা শহরে আর যাই হোক দল বেঁধে হনুমান পাড়া ঘুরতে আসত না।তাদের দেখা যেত ছুটির দিন ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে আসা একটা রোগা লোকের সঙ্গে, যার দুই হাতে দুটো চেনে বাঁধা বাঁদর বা হনুমান। একটা ছেলে একটা মেয়ে। সেটা অবশ্য বোঝা যেত তাদের পোশাকে।
মেয়ে হনুমানের একটা খেলা ছিল, লাজুক মুখে ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো,আর বলা আমাকে সাধি করবি?
আর ছেলেটা তখন একটা লাল ভেল তার মাথায় টেনে দিত।ব্যাস বিয়ে শেষ, তারপরেই তারা হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইত।আর মালিক সেই শীর্ণ চেহারার ছেলেটি বলত,লাগ ভেলকি লাগ-বান্দরের খেলা দেখে যা,এ আমার লাজবন্তী রানী আর রাজা বাদশা আছে।দেখে যা দেখে যা….হাতের ডুগডুগি টা তারপর জোরে জোরে বাজাতো।
আমাদের ইজ্জত কলোনির বাড়ির সামনেই কেবল জটলাটা হতো।কারণ বাবা ছাড়া আর কেউ তাদের বাচ্চাদের এসব খেলা দেখতে উৎসাহ দিতেন না।পয়সার অপচয়।
ছেলেটিও জানতো একমাত্র বাবুই টাকা দেবেন।তাই ডুগডুগি টা আমাদের বাড়ির সামনেই বেশি জোরে বাজত।
কিন্তু সেই বাঁদর দিয়ে যে জলাজমি ভরাট করা যাবে না,তা বোনও জানত।তাই সে পকেট ভরতি করে প্রায়ই পাড়া থেকে কুড়োনো পাথর এনে ফেলত,আমিও তার সঙ্গে থাকতাম।কারণ আমার যাবতীয় অকাজ কুকাজের সাক্ষী একমাত্র সেই। কাজেই আমারও দায় তাকে সাহায্য করা।
ধীরে ধীরে জায়গাটা ভরাট হল।বাড়ি বানানো শুরু হল।তখন আমরা ফেরার পথে ইঁটে জল দিতাম।পিছনে বানানো চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে। তার একটা কারণ ছিল,আমার দুই মামা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আর তারা রাস্তা বাড়ি এসব বানাতেন।দেখতাম যতটা গাঁথনি হয়েছে সেখানে পরদিন কামিনরা জল ঢালছে।তাতে নাকি যদি কোথাও ফাটা থাকা বোঝা যায়।
তবে আমরা জল ঢালতাম মজা করার জন্য, সেই জল ইঁটে যত না যেত,তার থেকে বেশি নিজেদের গায়ে ঢালতাম।ওটাই মজা।
দেখতে দেখতে দোতলা বাড়ি তৈরি হল।বাবা মাকে বলেছিলেন, তোমাকে বাড়ি বানাবার সময় গিয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করাতে হবে না,বাবা নিজেও যেতেন না।বাবা বলতেন,যেদিন গৃহপ্রবেশ হবে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে তুমি বাড়িতে ঢুকবে।
কিন্তু আমাদের কোনো বাঁধা ছিল না।তাই আমরা যখনই মন চাইত এক দৌড়ে সেখানে।
একতলা হবার পর যখন দোতলা হচ্ছিল তখন মনে আছে, আমি লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতাম,দেখতাম আমার চাপে বাড়ির ছাদ ফুটো হয়ে যাচ্ছে কিনা!আসলে পুরনো বাড়িতে আমার নাচের জায়গা ছিল কখনো তিনতলার ঠাকুর ঘর,কখনো ছাদ আর নয় খাট। বাড়িতে এর থেকে বেশি জায়গা ছিল না।
তাই আমি নতুন নাচ তুলে রাস্তা দিয়ে নাচতে নাচতেই বাড়ি ফিরতাম।নইলে ভুলে যেতে পারি।
অধিকাংশ সময় এ নিয়ে রাস্তার লোকেদের হাসি দেখেছি, বিশেষ করে আমার বয়সী কিংবা একটু বড় ছেলেদের। তবে প্রথম প্রথম হাসি,ঠাট্টা, টনটিং করলেও পরে বোধহয় তারা বুঝে গেছিল, ঘোষাল স্যারের বড় মেয়ের মাথায় ছিট আছে।তাই তারা আমাকে দেখলেই চিৎকার করত,হ্যাট গরু হ্যাট কিংবা ওই আসছে রুনু,এই বার নাচ হবে শুরু,হেলেদুলে আসছে,ঘুরে ঘুরে নাচছে…
আবার কেউ হয়তো সিটি মেরে গেয়ে উঠল-সোহাগ চাঁদ বদনি ধ্বনি নাচতো দেখি…
কিন্তু আমি তো তখন নিজেকে নিয়েই মগ্ন। সেই সময় যদি সত্যি গরুও আসত- আমি হয়তো খেয়ালই করতাম না,তখনো রাস্তায় এত গাড়ি ছিল না।রিক্সাও বেশিরভাগ হাতে টানা।তাই তেমন কোনো দূর্ঘটনা ঘটেনি।
আসলে আমার কাছে তখন সমস্ত রাস্তাটাই হয়ে যেত বিশাল খোলা মঞ্চ, সেখানে একটিই শিল্পী, সে আমি,বাকি সব দর্শক।আর দর্শক মাত্র কোলাহল কিছু হবে।তাতে শিল্পীর শিল্পে কোনো প্রভাব পড়ে না।সে তখন স্রষ্টা। আর স্রষ্টার একটিই মাত্র কাজ-শিল্প তৈরি। আমি সেটাই করতাম।
ডিগুপ্ত লেন থেকে ইজ্জত কলোনির সেই বিশাল মঞ জুড়ে তাই আমার সৃষ্টি চলত,ভাঙচুর হতো,সেখানেই তৈরি হত কত অমূল্য স্টেপ আর শীত গ্রীষ্ম বর্ষার মতো আমি নেচে যেতাম,নেচেই যেতাম যতক্ষণ না ইজ্জত কলোনির বাড়িতে এসে ধাক্কা খেতাম।