ডি গুপ্ত লেনের বাড়িটার নাম গায়ত্রী নিকেতন।এটা আমাদের বড় দিদা মানে বাবার দিদিমার নাম।তাঁর স্নেহে ও সব রকম সহায়তাতেই বাবার বড় হয়ে ওঠে।তাই বাবা বাড়ির নাম দিলেন তাঁর নামে।সাদা মার্বেল ফলকে দেওয়ালের গায়ে লেখা গায়ত্রী নিকেতন। ৯জুলাই,১৯৮৬ সন। পবিত্র রথযাত্রা। সেই রথযাত্রার দিন থেকে বাড়িতে অতিথি আসা যে শুরু হল, তার বিরাম ছিল না।মফস্বল থেকে আত্মীয় স্বজন,প্রতিবেশী,সাধু সন্যাসী,তান্ত্রিক, পান্ডা,পুরোহিত,কৃষক,ব্যবসায়ী তো লেগেই ছিল, এরসঙ্গে যুক্ত হল পাড়ার যেকোনো অনুষ্ঠানে নিচের ঘরগুলো ব্যবহার করার আবদার। আর বাবা সে আবদার সারাক্ষণ হাসি মুখে মেটাতেন। কিন্তু মুশকিল হত মায়ের আর আমাদের। যেমনি লোক হোক না কেন তাদের তদারকি তো করতে হবে!মা স্কুলে চলে গেলে আরেক অসুবিধা। আমাদের হয়তো ছুটি। বাড়িতে আছি,তখন কেউ এলেন।অমনি বাবা বললেন,খেয়ে যেও,দুপুর বেলা এসেছ,না খেয়ে কেউ যায় না। সেদিন হয়তো মা একটু কম করে রেঁধেছেন।কিংবা হয়তো কেবল মাছের ঝোল আর উচ্ছে চচ্চড়ি। ঝুমা এসব খেতো না।সে হয়তো সেদিন ভেবে রেখেছে দুপুরে লুচি বা পরোটা আর আলুভাজা ভেজে খেয়ে নেবে।অথবা চাউমিং বানাবে।অধিকাংশ দিন সে এসবই খেত।ভাত ডালে তার রুচি ছিল না।
এমন সময় অতিথি হাজির।আর বাবা বলে দিলেন খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।সেই সব দিনগুলোতে আমি খুব সিরিয়াস হয়ে যেতাম পড়ার ব্যাপারে।সোজা তিন তলার ঠাকুর ঘরে। তখন আমি বারো তেরো, চোদ্দও হতে পারি।আর বোন আমার থেকে ছোটো। তা স্বত্বেও তার ওপরেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি ঠাকুর ঘরে। এমন পড়া শুরু করলাম যে সেই সময় যদি স্বয়ং ভগবান এসেও দরজা ঠকঠক করতেন আমি তাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখতাম। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বোন ডাকত-দিভাই নেমে আয়।খেতে দিয়ে দে। তখন আমি বুঝতে পারতাম রান্না শেষ। এবার আমি বাকিটা সামলে নিতে পারব।
সত্যি, ওই টুকু সময়ের মধ্যে ঝুমা পোস্ত,একটা কিছু ভাজা,ভাত,ডাল,ডিম কিংবা ফ্রিজে মাংস থাকলে মাংস রেঁধে ফেলত। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল,একবার আজিমগঞ্জের বাড়িতে সবাই রয়েছি।মানে বাবারা চার ভাই,আমরা সবকটা ভাই দিদি,মা কাকিমারা।সেদিন ছোটকা আর আমার ভাইয়ের শখ হল ঝুমার হাতের রোল দিয়ে রাতের খাবার খাওয়া হবে।যথারীতি আমি রান্না ঘরে নেই। আর ঝুমা জানতও যে আমি এসবে ধারে কাছেও থাকব না। তাই সে একাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।কতটা ময়দা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না,কম করে চার কেজি তো হবেই সে একাই মাখল।তারপর শুরু হল রোল বানানো। এগরোলের ভিতরে সোয়াবিন দিয়ে। সেদিন আমি গুণে দেখেছি পুরো একশো কুড়িটা রোল সে একা বানিয়েছিল।
এবং সেই রোল যে-কোন বড় রেস্তরাকে হার মানাবে। বাবার দৌলতে বড় বড় হোটেল,রেস্তরার খাবার খেতে অভ্যস্ত ছিলাম।তাই স্বাদ চিনতে ভুল হবার কথা নয়। কাকিমারা বলেছিল,এত ময়দা মাখলি,দেখবি পড়ে থাকবে। রাত বারোটায় যখন খাওয়া শেষ হল তখন দেখা গেল এতটুকু ময়দাও পড়ে নেই। বোন আসলে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসত।আমি এর উল্টো। ঘর সাজাতে আমার দারুণ লাগত।অবশ্য খেতে দেওয়ার দায়িত্বও আমারই ছিল। যাহোক মানুষের পাশাপাশি আমাদের বাড়িতে জল ঝড়ের দিনে পশু পাখিদের ও অবাধ আশ্রয় দেওয়া হত। একবার এমনই এক বর্ষার সময় গোয়ালাদের গোয়ালঘরে হাঁটু অবধি জল।সেই জলে গরু মহিষ দাঁড়িয়ে। বাবা নির্দ্বিধায় আমাদের নিচের ঘরগুলো খুলে দিলেন গরুমহিষের জন্য। সারাদিন তাদের হাম্বা হাম্বা, গোবর আর খড় বিচুলির গন্ধে বাড়ির অবস্থা যে ভয়াবহ হয়ে উঠল তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু বাবা সিদ্ধান্তে অটল।যতক্ষণ না জল পুরো নামছে ওরা এখানেই থাকবে। ক্রমশ আমাদেরও মায়া পড়ে গেল।গরুগুলোকে আদর করতাম,খেতেও দিতাম।কিন্তু গোবরগুলো বড় বিরক্তিকর। তাও সহ্য হয়ে গেল একদিন।ওদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল।আমরা আমাদের মতো কথা বলতাম,আর তারা যেন উত্তর দিত চোখে আর গায়ে শিং লাগিয়ে। তাদের দেহ চিকন কালো,সাদা,ছোপ ছোপ.. সেই গানটা গাইতাম নেচে নেচে শ্যামলী আমার গাই,তুলনা তাহার নাই। কঙ্কনানদীর ধারে/ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে–/ দূর্বাদলঘন মাঠে তারে/ সারা বেলা চরাই, চরাই গো।দেহখানি তার চিক্কণ কালো,/ যত দেখি তত লাগে ভালো/ কাছে বসে যাই ব’কে/ উত্তর দেয় সে চোখে / পিঠে মোর রাখে মাথা–গায়ে তার হাত বুলাই, হাত বুলাই গো॥
কঙ্ক না নদী তখন বাইরের জমা জল,আমাদের একতলায় জমে থাকা খড় বিচুলি ঘাস মাঠ হয়ে যেত। আর জমে উঠত গল্প।
সন্ধ্যে হলে গোয়ালারা নিচেরই একটা ঘরে গান জুড়ত।সচরাচর রামলীলা বা কৃষ্ণ ভজন গাইত। অনেক শব্দই বুঝতে পারতাম না।তাদের অধিকাংশেরই ভাষা ছিল ভোজপুরি কিংবা বিহারী।গানের মানে না বুঝলেও ভাবভঙ্গি ও সুর শুনে আন্দাজে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যে দুটো গানের কিছু লাইন শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছিল।তার একটি ছিল – মাইয়া মোরি/ম্যায় নেহি মাখন খায়ো/ভোর ভায়ো গাইয়ান কে পাছে তুনে মাধুবন মোহি পাঠাইয়ো/চার প্রহর বাংশি বাট ভাট যো সাঝ পারে ম্যায় ঘার আয়ো/ম্যায় কাব মাখান খায়ো। সেই ভজন গাওয়ার সময় তাদের সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় যেন মিলিয়ে যেত।মনে হত সবটুকু দিয়ে তারা কৃষ্ণর সাধনা করছেন। আমিও একসময় তাদের সঙ্গে গাইতে গাইতে শিখে গেলাম- জগমে সুন্দর হ্যায় দো নাম চাহে কৃষ্ণ কহ ইয়া রাম বোলো রাম রাম রাম বোলো শ্যাম শ্যাম শ্যাম। মাখন বৃজমে এক চুরাওয়ে এক দের ভিলনিকে খাওয়ে প্রেম ভাবছে ভারে আনোখে দোনো কে হ্যায় কাম। এ ভজন কার লেখা – সুরদাস,রামদাস,নাকি মীরাবাঈ এসব তাদের জানা ছিল না।আমিও জানতে পারিনি।তবে সেই গান গাওয়ার সময় তালি বাজিয়ে যে সুরের ঝংকার আমি দেখতাম, তাতে মনে হত স্বয়ং কৃষ্ণ তার গরুদের নিয়ে সেখানে বাঁশি বাজিয়ে উপস্থিত। আর এরা প্রত্যেকেই তার পায়ে নিজেদের সমর্পণ করে দিয়েছে। সমপর্ণ মানে প্রশ্ন না তুলে নিজেকে তাঁর সাধনায় মগ্ন করা- তাদের এই বোধটা তখন থেকেই আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করল।