T3 || বাণী অর্চনা || বিশেষ সংখ্যায় বিজয়া দেব

বীণাপাণি

প্রায় রাতে একটি স্বপ্ন আসে আজকাল, একটি ইশকুল, সামনে খোলা মাঠ, একটি দশ এগারো বছরের কিশোরী ছুটছে। শ্বেতবসনা হংসবাহিনী দেবী সরস্বতীর আরাধনা আজ। বিদ্যার দেবী সরস্বতী বন্দনা করছে মেয়েটি। সুমিষ্ট তার স্বর- প্রকাশো জননী নয়ন সমুখে প্রসন্ন মুখছবি /বিমল মানস সরসভাষিণী /শুক্লবসনা শুভ্রহাসিণী /বীণাগুঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী কমলকুঞ্জাসনা…
– কী রে, এত বেলা অবধি শুয়ে আছিস। উঠতে হবে না? আজ যে সরস্বতী পুজো। হ্যাঁ রে বীণা, কালরাতে মরদটা জ্বালিয়েছে খুব? যা দেহ বাপরে। তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়েছে জানিস!- টুনটুনি দাঁড়িয়ে দরজায় ।
বারবনিতাদের পাড়া। এখানে সরস্বতী পুজোর গন্ধ কোথায়? বীণা অর্থাৎ বীণাপাণি বিছানা ছাড়ে। এলোমেলো বিছানাটাকে ঝেড়েঝুড়ে ঠিকঠাক করে। এখন এই বিছানাই তার বেঁচে থাকার ঠিকানা। এই বিছানা প্রতি সকালবেলায় নতুন নতুন গন্ধ ছাড়ে। কখনও কাঁচা পারফিউম কখনও সস্তার আতর কখনও বাসি বেলফুলের গন্ধ। আচ্ছা, কে তার নাম রেখেছিল বীণা ? বাবা না কি মা? জিজ্ঞেস করা হয়নি। কেন জিজ্ঞেস করেনি সে? হয়ত মাথায় আসেনি। একটা সুখী, সুন্দর, অমলিন শৈশব, একটি কৌতূহলী কৈশোরে সে আনমনা হয়ে বেঁচে ছিল। বীণাপাণির হাতের বীণা ছিল সে? আর সেই সুন্দর ইশকুলটি? প্রাঙ্গণে সারি সারি ফুলগাছ। টিফিন পিরিয়ডে গাছে জল দেওয়া, গাছের পরিচর্যা শিখিয়ে দিতেন গৌরস্যার। শিক্ষক গৌরহরি দাস। কীভাবে মাটিকে তৈরি করতে হয় কীভাবে সার মেশাতে হয় কীভাবে কোন গাছকে ছেঁটে দিলে ফল ফুল আসে কীভাবে ঝারি দিয়ে শাখাপত্র ভিজিয়ে জল দিতে হয়… আর সরস্বতী পুজো করতেন সরোজস্যার। সরোজ ভট্টাচার্য। সরোজস্যারের বোঁদে মিষ্টিটা খুব পছন্দের। মিষ্টির তালিকায় বোঁদে থাকবেই। একা একা হাসছে বীণা। যখন মিষ্টির লিস্টি হচ্ছে তারা মুখিয়ে অপেক্ষায় থাকত কখন সরোজস্যার বোঁদে বলবেন। আর যেই স্যার “বোঁদে” বললেন তারপর কী কষ্ট করে যে ছাত্র ছাত্রীরা হাসি সামলাত। সেটা বিস্ফোরিত হত আড়ালে এসে। হো হো হা হা হি হি… সহপাঠী বিকাশ তো মুখশ্রী গম্ভীর করে সরোজস্যারকে নকল করে বলত – “আর “বোঁদে”? “বোঁদে” লেখা হয় নি?” – তারপর আরেক চোট হাসি। পুজোর প্রস্তুতির দিনগুলো ছিল সবচেয়ে চমৎকার, আলপনা দেওয়া হত দিদিমণিদের নির্দেশে। সিনিয়র মেয়েরা আলপনা দিত। ফুল বেলপাতা ইত্যাদির জন্যে যে টিম ছিল সেখানে থাকত সে। মাধুরী দিদিমণি কাজের জন্যে ডাকতেন আর বলতেন – তোকে ডাকতে খুব ভালো লাগে রে। বিশেষ করে এই দিনে। কে তোর নাম রেখেছে বীণা? বাবা না মা? বলে মিষ্টি সুরে আবৃত্তি করতেন – “তুমি মানসের মাঝখানে আসি /দাঁড়াও মধুর মূরতি বিকাশি/ কুন্দবরণ সুন্দর হাসি বীণা হাতে বীণাপাণি।” তোর মধ্যে কেমন একটা পবিত্র ভাব আছে রে। হাসলে তোকে আরও পবিত্র দেখায়। সরস্বতী পুজোর দিনে তোকে খুব মানায়।”

সেই বীণাপাণি পথ হারাল। যৌনতা সুখ দেয়, আবার ভয়ঙ্কর সর্বনাশ করে। সে মফস্বল অঞ্চলে বড় হয়েছে। অবশ্য বড় আর হলো কই! সদ্য কৈশোর পেরোনো একটি নরম মেয়ে। চোখে কত কৌতূহল। পৃথিবীটা তখন তরতাজা, সজীব। নিত্যনূতন হাওয়া। নিত্যনূতন লোকজন। এক যুবক একদিন পথে তার পিছু নিয়েছিল। কী অমোঘ আকর্ষণ তার । কত কী স্বপ্ন দেখাত ঐ যুবক। সে সব ভুলে গেল। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, বাবা মা আদরের ছোটভাই। কিচ্ছু ভাবে নি, ভাববার ক্ষমতাই ছিল না। অতঃপর চেতনা যখন ফিরল তখন সে এই যৌনপল্লীতে বিক্রি হয়ে গেছে।

বীণা দেখল তাকের ওপর রাখা সেই শ্বেতশুভ্র বীণাপাণির ছোট্ট মূর্তি। কবে জানি সে এক মেলা থেকে কিনে এনে রেখেছিল মনেই পড়ে না। প্রতিবছর এইদিনে সে সরস্বতীর পায়ে ফুল দেয়।
অঞ্জলি দিতে ইচ্ছে হয় কিন্তু কীসের ভয়ে সে মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু অঞ্জলির মন্ত্র যে তার কাছে ভীষণ ভালো লাগার। তার জীবনের ছোট্ট পরিধি যে আটকে আছে ইশকুলের সেই সরস্বতী পুজোর দিনগুলোতে। বাকিটা মানে এই বহুপরিচর্যার জীবনটা তো জীবন নয়। বিক্রি হয়ে যাওয়া যৌনদাসীর স্থবির কালসমষ্টি। সেই পবিত্রভাবের বীণাপাণি তো আর বেঁচে নেই। সে কবে কতযুগ আগে এক ভুলপথের বাঁকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু কীসের এক মধুর ধ্বনি এরই মাঝে সে কেন শুনতে পায়। কাউকে কখনও বলে নি সে। “নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি অমৃত মুরতি বুকে বাণী…” কীসের বাণী? কী সেই বাণী যা নিরন্তর এই অপবিত্র দেহের অন্তরে রিনরিন করে? সে কেন তখন নিজেকে পবিত্র বোধ করে?
-চলো তুমি ও আমি অঞ্জলি মন্ত্র বলি।
টুনটুনি। স্নান করে এসেছে হলুদ শাড়ি পরে। হাতে একমুঠো সাদা লালের নয়নতারা ফুল। সরস্বতীর পায়ের কাছে রেখে বলে – আমার একটি অঞ্জলি মন্ত্র মনে আছে – জয় জয় দেবী চরাচরসারে…
বীণা টুনটুনির মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে – না আমাদের বলতে নেই।
-কেন বলতে নেই?
বীণার চোখে অশ্রু টলটল করছে।
টুনটুনি বলে – আমি বলবই।
বীণা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অদূরে রাজপথে শাড়ি পরে ছোট ছোট মেয়েরা ইশকুল চলেছে। কী সুন্দর পরিচ্ছন্ন সকালটা আজ।
বীণাকে টুনটুনি পেছন থেকে বলে – আজ তোমার ঘরে নাকি নতুন বাবু আসছে গো। হরিমতী মাসি বলাবলি করছে।
বীণা তীব্রস্বরে বলে ওঠে – না। একদম না।
টুনটুনি বলে মুখ বাঁকিয়ে বলে – ইঃ। খুব তো সাহস! জানা আছে! আমি কিন্তু অঞ্জলির মন্ত্র বলে এসেছি। কেন বলব না? আমি কোনও পাপী তাপী নই। পাপী তাপী কেন হব?
বীণা ভাবছে – পালিয়ে গেলে কেমন হয়? চুপচাপ? একা একা?
নিভৃতে এখনও যে এক বীণার ঝংকারে অমৃতসুরের ঝর্ণাধারা রিনরিন নিরন্তর বয়ে চলেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।