T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় বিজয়া দেব

যেমনটা হয়ে থাকে

অনেক বাধাবিপত্তির মাঝে ঘুরে আসা গেল শেষ পর্যন্ত। মনটা তাই আনন্দে ভরে আছে। বাড়িতে শ্বশুরমশাই একপ্রকার শয্যাশায়ী বলা চলে। বছর তিনেক ধরে প্রায় একই রকম অবস্থা। শাশুড়ি নেই। আমার এ বাড়িতে আসার আগেই তিনি গত হয়েছেন। বাড়িতে আমি, আমার সাত বছরের ছেলে তাতাই, স্বামী রজত আর বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই।
ঘুরে বেড়ানোর শখ আমার চিরকাল। যেখানে খুশি, শুধু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া চাই। এই চারদেয়ালের বাঁধন যে বড় কঠিন, এইটি বিয়ের পর আমি টের পেলাম।
বিয়ের আগে একটা বেসরকারি অফিসে চাকুরি করতাম। ছুটির দিনগুলোতে কয়েকজন সহকর্মী মিলে এদিক ওদিক ঘুরে আসতাম। এখন আশ্বিনের শুরু। এমনি এক আশ্বিনের শুরুতে কয়েকজন সহকর্মী মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম এক গাঁয়ে। শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে। পুজো তখন খুব কাছাকাছি। গাঁয়ের পাশে এক মাঠ প্রান্তর। কাশফুল ফুটেছে। মালিনীর, মানে আমাদের এক সহকর্মীর গাঁ গঞ্জ একদম পছন্দ ছিল না। বারবার বলছিল – ঈস কী দেখতে যে তোরা এলি! পচা ডোবা?
অথচ কী যে অদ্ভুত ভালো লাগছিল আমার। ঐ সহকর্মীরা এখন আর আমার কাছে নেই। সবাই চাকুরিতে আছে। আমার বিয়ে হয়েছে আমার নিজের বাড়ি থেকে অনেকদূর বড় শহরে। নিজের বাড়ি মানে আমার বাবা মা যেখানে আছেন, যেখানে আমি বড় হয়েছি।
আমার স্বামী রজত একটা কর্পোরেট অফিসে উঁচু পদে চাকুরি করে। দেখতে ভালো। তাই দেখে বাবা মা অস্থির হয়ে আগেভাগে আমাকে বিয়ে দিলেন কী জানি এমন জাঁকালো পাত্র হাতছাড়া হয়ে যায়! বিয়ের পর রজত আমাকে আর চাকুরিতে যেতেই দিল না। আমি চাকুরি খুঁজতে চেয়েছিলাম নতুন করে এই বড় শহরে।
রজত বলল – কী দরকার। তুমি রোজ রোজ অফিস যাওয়া আসা করলে ঘর তার ছন্দ হারাবে। তুমি আমি বাবা সবাই ছন্নছাড়া হব। তারপর আমাদের কোলে যখন ছোট্ট শিশুটি আসবে তখন ওর যে কী কষ্ট হবে ঈসস। ওসব ভেবে দেখতে হবে তো।
রজত দেখতে ভালো, দীর্ঘ সুঠাম দেহ।রাগারাগি করার স্বভাব নেই। ঠোঁটে হালকা হাসি লেগেই থাকে। জোরে হাসে না। ছকবাঁধা রুটিন তার। তুমুল পরিপাটি। দেশে বিদেশে যখন তখন যেতে হয় তাকে অফিসের কাজে।
রজত বলেছিল – আমার সাথে ঘুরে ঘুরে পৃথিবী দেখবে তুমি। চাকুরি করলে তো ইচ্ছেমতন যেতে পারবে না।
তখন শ্বশুরমশাই মোটামুটি সুস্থ ছিলেন।
তবু আমি বলেছিলাম – কী করে সেটি হবে? বাবা তো আছেন।
রজত বলেছিল – আরে মানদামাসি আছে না?
মানদামাসি আমার শাশুড়ির আমলের মানুষ। অনেক বয়েস। রান্নাবান্না প্রথম প্রথম ও-ই করত। আজকাল তার হাঁটুব্যথা। তবু কাজে কিছু কিছু সাহায্য করে।
যাই হোক, বিয়ের পর একটা হানিমুন হয়েছিল সিঙ্গাপুর। আর একবার হায়দরাবাদ থেকে পন্ডিচেরি। একবার সাউথ গোয়া। ঐটুকুই। এরপর তাতাইয়ের জন্ম। আর এরপর শ্বশুরমশাইয়ের স্ট্রোক। ব্যস সেই থেকে আর বাড়ি থেকে বেরোনো গেল না। রজতের অফিস ট্যুর যথারীতি চলছে।
উঁচুপদে চাকুরি করা স্বামীদের নাকি এই অফিসট্যুরের একটা ভেতর-কাহিনি থাকে। মানে অফিস ট্যুরের সাথে সাথে এরা চৌকস মোহময়ী প্রাইভেট সেক্রেটারি অথবা অন্য কোনও মহিলাকে নিয়ে সংগোপনে অভিজাত হোটেলে রাত্রিযাপন করে দায়িত্বপূর্ণ কাজের ক্লান্তি অপনোদন করে। গল্প উপন্যাসে চলচ্চিত্রে এই বিষয়টি হরহামেশা পাওয়া যায়। তখন দেখা যায় এদের পকেট থেকে সুগন্ধি মেয়েলি রুমাল কিংবা লন্ড্রিতে শার্ট কাচতে দেবার সময় লিপস্টিকের দাগ কিংবা শার্টে একখানা লম্বা চুল কিংবা প্যান্টের পকেটে ভুলে ফেলে রাখা আরও গূঢ় বস্তু পাওয়া যায় আর এসবের সূত্র ধরে গার্হস্থ্য অশান্তি ইত্যাদি শুরু হয়। এগুলো প্রথাগত কাহিনি। গল্প এবং বাস্তব। রজতের অফিস ট্যুরে হয়ত এমনি অনেক গল্প আছে। গল্প হলেও সত্যি। তবে আমি কি ঐসমস্ত ক্লু খুঁজব রজতের শার্টে কিংবা প্যান্টের পকেটে? ভাবি এসব। তবে ক্লু হাতে না আসার জন্যে খুব সন্তর্পণে চলি। এই আড়াই হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটবাড়ি আমার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে, সেখানে এসব গল্পছুট গল্প আমাকে অন্য বৃত্তে ছুঁড়ে দেবে এটা ভালো করেই জানি। এক্ষেত্রে সবাই বলবে জানাটা জরুরি। আমিও দ্বিমত নই। কিন্তু রজতের ব্যাপার নিয়ে ভাবতে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি আসে আমার। রজত অনেকদিন থেকেই অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেছে বললে ভুল হবে না। ও একটা অভ্যাস আমার প্রাত্যহিক যাপনে। ওর সাথে আজকাল তেমনভাবে কথাবার্তাও হয় না। মাঝেমাঝে সে তাতাইয়ের ও বাবার খোঁজখবর নেয়। মাঝেমাঝে শরীরী নৈকট্য দাম্পত্যের, অভ্যাসের।
আসলে বিয়ে একটা অভ্যাস। একটি অভ্যাসে বাঁচা। বিয়ের পর জীবন থমকে দাঁড়িয়ে যায়। পাহাড় সমুদ্র দূরে সরে যায়। সকাল বিকেল আর আগের মত মৌনমুখর থাকে না। তবু বিয়ের জন্যে কত কী!
এই ছড়ানো ফ্ল্যাটবাড়ির আনাচকানাচে, খাঁজখোপের অন্ধকারে , শ্বশুরমশাইয়ের হুইলচেয়ারে, তাতাইয়ের পড়াশুনোয় ইস্কুলে, খেলাধুলোয়, মানদামাসির হাঁটুব্যথায় আটকে গেছি আমি নিজের অজান্তেই। সন্ধ্যা কখন যে ঘনায়, রাত কখন যে আসে, রজত কখন যে ফেরে, কখন যে আমরা ঘুমোতে যাই কে জানে! এত রুটিন! এত রুটিন! মাঝেমাঝে বাড়িতে ডাক্তার আসে শ্বশুরমশাইকে দেখতে। কিছু কিছু শ্বশুরমশাইয়ের শরীরসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব আমাকে তৈরি করে রাখতে হয়, মাঝেমাঝে তাতাইয়ের ইস্কুলে গার্জিয়ান মিট থাকে, তাতাইয়ের উন্নতি অবনতি সংক্রান্ত বিশ্লেষণ খুব সিরিয়াসলি করতেই হয়, ছেলের ভবিষ্যৎ তৈরি করার তোড়জোড় করি। রজতের তো সময় নেই। রজত ছুটছে। রজতের সময় মুঠো গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিনটাই যদি আটচল্লিশ ঘন্টার হত রজতের জন্যে! বোধহয় ভালই হতো।
রজতের সাথে মন খুলে কথা বলা, হাসিঠাট্টা মজা কোনও কিছুই আজকাল আর হয় না। তাতাইও একটু গম্ভীর প্রকৃতির। বাবার সাথে তার তেমন করে কথাবার্তা হয় না। কোনও রবিবারে হঠাৎ মনে হলে রজত তাতাইকে নিয়ে বেরোয়। তবে সেটা কালেভদ্রে। রজতের পার্টি থাকে। মুখে বলে – তুমি যেতে পারতে। কিন্তু তাতাই, বাবা…। আমি বলি – না না আমি কী করে যাবো!
রজত খুব স্বস্তির সঙ্গে ফিটফাট বেরিয়ে যায়। একদিন রজতের ছোটবোন রাই এসে হাজির। বাবাকে দেখতে এসেছে। রাই সরকারি পদস্থ অফিসার। বিয়ে করেনি এখনও। তার সহানুভূতিতেই হঠাৎ করে তাতাইকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে এলাম পাহাড় থেকে। ফিরে এসে দেখলাম তাতাই দাদুর সাথে উচ্ছ্বাসে গল্প জুড়ে দেয় যখনতখন। বেড়ানোর গল্প ।এই ছবিটি একেবারে নতুন সবার কাছে। আমার শ্বশুরমশাই খুব খুশি। অসুস্থ মানুষটারও মুখে আলো ফোটে।
রাই চলে গেছে। তবে একমুঠো সবুজ ছড়িয়ে গেছে আমার চারপাশে। আর বলে গেছে-মানদামাসিকে বলেকয়ে বুঝিয়ে গেছি। আর বাবার জন্যে একটি নার্স রেখে গেলাম। তাতাইকে নিয়ে মাঝেমাঝে বেরিয়ে পড়ো। জীবন কতভাবে চারপাশে ছড়ানো। তুমি যেমন তাকে চাও সে-ও তেমনি তোমাকে চাইছে। নিজেকে বঞ্চিত করো না বউদি।
আমরা খুব আনন্দেই ছিলাম, রাই আমাকে ও তাতাইকে নিয়ে পাহাড়ি শহরে ঘুরল। হ্যাঁ, শ্বশুরমশাইকে দেখভাল করার জন্যে একজন নার্সকে বহাল করে গেল।
এরপর আমি তাতাইকে নিয়ে গেলাম রাইয়ের কোয়ার্টারে যেখানে রাই গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরি করছে। রাই বারবার ফোন করছিল। গেলাম। তাতাইয়ের খুব আনন্দ।
খুব ভালো ক’টা দিন কাটিয়ে ফিরে এসে যখন ঘরে ঢুকলাম তখন শুনতে পেলাম শ্বশুরমশাই ক্ষীণস্বরে ডাকছেন। ব্যাগটা রেখে প্রায় ছুটেই ওনার ঘরে ঢুকে দেখলাম উনি বাথরুমে যাবেন, আমাকে দেখে যেন মনে বল পেলেন। আমি তখনও রাস্তার কাপড় ছাড়িনি। মানদামাসি আজকাল কানে কম শোনে। উনাকে সাহায্য করলাম আমি । জিজ্ঞেস করলাম নার্স কোথায়। উনি অভিযোগ করলেন – নার্সটিকে প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। এই সময়ে তাতাই আমাকে ডাকল।
আজ রবিবার। আমি যে ফিরব বাড়িতে জানাই নি। রজত আজ বাড়িতে। তাতাই আমাদের শোবার ঘরে দরজায় টেনে নিয়ে এল। একটি লাইভ নীলছবির চরম দৃশ্য আমাকে আমার সদ্য সাত বছর পেরোনো তাতাই তর্জনি তুলে দেখাল। আমি তাতাইকে টেনে সরিয়ে নিয়ে এলাম। তাতাইয়ের বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ।

আমার এতদিনকার অভ্যাসের ইমারত তাসের ঘরের মত ধুলোতে মিশে যেতে লাগল। এই প্রথম আমি অনেক দূরের সামুদ্রিক কল্লোল অথবা বিশাল গর্জনে তুষারপাতের আওয়াজ শুনতে পেলাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।