সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিজয়া দেব (পর্ব – ৭)

অতিমারী

কিছুক্ষণ এন জি ও নিয়ে কথা হবার পর অগ্নি বলে – ঐ পথশিশুদের খাওয়া দাওয়া হচ্ছে তো?
মরমী খুশি হল। দারুণ খুশি। যে কাজে তার আসা। ভাবতে খারাপ লাগছে যদিও। এমন উদ্দেশ্যমূলক দেখা করার জন্যেই কি সে এসেছে? না কি অগ্নির সাথে একা একা দেখা করার একটি সুপ্ত ইচ্ছেও ছিল? হয়তো।
-কে জানে! কথা তো এখানে নেই। টাকা তোলার উপায় নেই ব্যাঙ্ক থেকে। ও এ টি এম কার্ডটা রেখে যায়নি। পাসবুকটাও ওর কাছে আছে। আসলে তো জানে না ওভাবে আটকে যাবে। ধারণা করতে পারে নি।
-ওহো ।তাহলে তো খুব সমস্যা। আচ্ছা আমি একদিন যাচ্ছি আকাশদের ওখানে, তোমরাও এসো।
-তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাই অগ্নি!
-ধন্যবাদ তুমি কেন আমাকে দেবে! আমারও তো দায়িত্ব রয়েছে, তাই না? এরা তো না খেয়ে মারা পড়বে মরমী। দেখতে হবে ব্যাপারটা। অবশ্যই দেখতে হবে।
– স্বপ্নিল একদিন বাড়ি থেকে রুটি তরকারি নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। আমি কিছু করতে পারিনি।
মরমী মাথা নিচু করে বসে আছে।
-অপরাধী ভাবছ নিজেকে? আমি তোমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। সেবিকা আচমকা চলে যাওয়ায় আমার সব এলোমেলো হয়ে গেল। ডুবে গেলাম কাজে। প্রত্যয় এর ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। নাহলে ওদের খোঁজখবর নিতে আমি তো যেতে পারতাম।
-একদিন সময় বের করতে পারবে অগ্নি?
-বেশ আমি দেখছি। তোমায় জানাব।
এই সময়ে ফোনটা বেজে উঠল মরমীর। ইরামাসির নং থেকে। ভয়ানক দুঃসংবাদ। মাসি নেই। পৃথিবীটা কেমন যেন দুলে উঠল। অগ্নি মরমীর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে।
মরমী অস্ফুটে বলে – ইরামাসি।
তার হাত বলে – নেই।
কথা বলতে এত কষ্ট হয় মরমী জানত না। অগ্নি উঠে এসে মরমীর কাঁধে হাত রাখল। কে কার দুঃখে সান্ত্বনা দেবে!

অতীশ আজকাল খুঁজে চলেছে মহামারির ইতিহাস। মানবসভ্যতা কতবার কীভাবে মহামারীর কবলে পড়েছে, কতবার বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে সাহিত্যে তার হদিস পাওয়া মেলে।
অতীশ খুঁজে বের করে নিজের বইয়ের আলমারি ঘেঁটে, রোজ ডাইরি লেখে, রাতে বিপাশা ও কথাকলিকে শোনায়। ব্যালকনিতে বসে তিনজন। সেই ভিক্ষুকটি ওপরের দিকে তাকায়। দড়িতে বেঁধে কিছু খাবার নামিয়ে দেওয়া এখন রোজকার রুটিন।
অতীশ ডাইরি পড়ে –“ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্যান্ডেমিক জন্ম দিয়েছিল “কোয়ারেন্টাইন” শব্দটির, সাড়ে ছ’শো বছর আগে। নরওয়ের ইতিহাসবিদ ওলে বেনেডিক্টের মতে সেই সময়ে ইউরোপের জনসংখ্যা ছিল প্রায় আটকোটি। এরমধ্যে পাঁচ কোটি মানুষ ব্ল্যাক ডেথের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। একটি উপন্যাস ১৩৪৮ সালে লেখা, জিওভান্নি বোকাচ্চিওর “ডেকামেরন”। উপন্যাসে উঠে এসেছে ব্ল্যাক ডেথের ভয়ংকর উপসর্গগুলি। প্লেগরোগ ইউরোপে মহামারীরূপে দেখা দিয়েছিল। প্লেগের জীবাণুর নাম “ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস”। এখন সারা পৃথিবী আক্রান্ত অচেনা ভাইরাসে। করোনা ভাইরাস – সার্স কোবিড 2। আমরা কখনও “লকডাউন”শব্দটি শুনিনি। আমরা “কোয়ারেন্টাইন” শব্দটির সাথেও পরিচিত নই। শরৎসাহিত্যে যদিও এর উল্লেখ আছে – “…. পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে, কিন্তু ভোর হইতে না হইতেই লোকদের চোখেমুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। চারদিক হইতে একটি অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল – কেরান্টিন। খবর নিয়া জানিলাম কথাটা “কোয়ারান্টিন”। তখন প্লেগের ভয়ে বার্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট/দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলো কুঁড়েঘর তৈয়ার করা হইয়াছে, ইহার মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করিবার পর তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। “ আলবেয়ার কাম্যুর “দ্য প্লেগ” উপন্যাসটিতে আমরা দেখছি প্লেগের ভয়াবহতা। আলজিরিয়ার ওরান শহরে ডাক্তার বার্ণাড রীউ হাসপাতালে দেখতে পেলেন একটি মরা ইঁদুর। ধীরে তা সংখ্যায় বাড়তে শুরু করল। হাসপাতালে উপছে পড়ছে রোগীর সংখ্যা। শহরের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হল ———”
বিপাশা মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠল – আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না। আমি যাই। মনে হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তুমি ওসব ডাইরি তোমার কাছেই রাখো।
অতীশ বলে – আরে ইতিহাস জানবে না?
-হয়ত জানাটা উচিত। কিন্তু আমি সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রত্যাশার জন্যে চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি… আর তুমি আছ ইতিহাস নিয়ে…
কথাকলি চুপ। তার বাড়ির জন্যে খুব চিন্তা হচ্ছে। একটা প্রগাঢ় অস্বস্তি নিয়ে চলতে হচ্ছে। মরমী জানিয়েছে আকাশদের কথা। অভুক্ত শিশুগুলোকে কে দেখবে? এদের খাওয়া জুটছে না।
ভিক্ষুকটা উপরের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। বিদিশা হঠাৎ যেন রাগ করে বলে উঠল – মেয়েটার আমেরিকায় যাওয়ার এত কী ছিল! দেশে যা আছে তা নিয়ে বেশ চলা যেত!
অতীশ মৃদু হাসে। বলে – ওসব প্রসঙ্গ ছাড়ো! তুমি আমি দুজনেই চেয়েছি ও বিদেশে যাক। এখন এসব কথা তুলে অশান্তি বাড়ানোর কোনও মানে হয় না।
বিপাশা চুপ করে যায়। কথাটি তো সত্যি। সে তো আপ্রাণ চেষ্টা করেছে একমাত্র সন্তানকে তার যতটুকু আছে যা কিছু আছে উজাড় করে দেওয়ার। সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে সোনালী স্বপ্ন দেখেছে, হয়তো অতীশের চাইতেও বেশি। এখন এক গভীর সংকট, জীবন – মৃত্যুর দোলায় দুলছে গোটা পৃথিবী… প্রতিদিনের অস্থির মুহূর্ত… ঘরবন্দি অসহায় সময়…মেয়েটা চোখের সামনে নেই এত অসহায়… এত অসহায়… উফ… নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখা যাচ্ছে না… নিজেকে নিয়েই নিজের সংকট.. সে যেন আরও বড়…. মায়েদের বড় কষ্ট বড় কষ্ট… এই কষ্ট কেউ বোঝে না…
কথা বন্ধ করে অতীশ চুপচাপ উঠে যায়। অতঃপর বিপাশাও। কথাকলি একা বসে থাকে। খুব ভয় করে তার। কোনও কোনও কাজ এতই ভুল হয় যা না তো মেনে নেওয়া যায় না তো শোধরানো যায়। তার এই ঝুঁকি দিল্লি আসার কাজটাও এমনি এক ভুলভাল কাজ।
হাতে মোবাইল বেজে উঠল।
মা। মা এত রাতে! ঘুমোয় নি মা?
-কী হল মা? রাত একটা বাজতে চলল যে!
-ঘুম আসছে না রে, থেকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ।
বলতে না বলতেই একটা অ্যাম্বুলেন্স গেল চারপাশের নৈঃশব্দ খানখান করে।
-শুনতে পাচ্ছ?
-হ্যাঁ।
-কী যে হবে! খুব ভয় হচ্ছে তোর জন্যে।
-ভয় করো না মা। কেউই তো ভালো নেই। শুধু কি আমরা?
সত্যিই তো কেউই ভালো নেই। তাদের চাইতেও তো ভয়ানক পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা। মিডিয়াতে দেখাচ্ছে ছোট্ট অবুঝ শিশু তার মৃত মায়ের আঁচল ধরে টানছে। বাড়ি ফেরার পথে খাদ্যাভাবে রাস্তাতেই তার মা প্রাণ হারিয়েছে। মহারাষ্ট্রে ইস্পাত কারখানার কিছু শ্রমিক মধ্যপ্রদেশে নিজের গাঁয়ে ফেরার পথে রেললাইন ধরে হাঁটছিল। ক্লান্ত দেহে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা ট্রেন বন্ধ আছে এই ভেবে। ভোররাতে মালগাড়ি এসে তাদের দেহ পিষে দিয়ে চলে গেল। তেলেঙ্গানা থেকে বারো বছরের একটি মেয়ে ছত্তিশগড় নিজের বাড়িতে ফেরার পথে মারা গেল তিনদিন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে…. এছাড়াও আরও কত…
কত কথা বলে যাচ্ছে কথাকলি মায়ের কাছে গভীর রাতে। দুজনের চোখে ঘুম নেই। পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা আকাশদের কথা পলাশ ড্রাইভারের কথা নিজেদের কথা…
অতীশ এসে বলে – কার ফোন? দিদি? দে ফোনটা দে…
নিখাদ রাতে গুপ্ত পৃথিবীর আলো যেন অণুজীবের রহস্য নিয়ে খেলা করে। মানুষের অসহায় ছটফটানি দেখে মৃদু হাসে।

ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নিল দেখে দরজায় পলাশ। কী করে এল!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।