সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ৪০)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো
-কি রে বুধুয়া, রুটি চিবোচ্ছিস?
বুধুয়া ঘোলাটে চোখ তুলে দেখল, ফিটারবাবু।
-এ ব্যাটা আপনার বাড়িতে কাজ করে?
-ঘাস দেয়।
– আমার বাড়িতেও দেয়। ব্যাটা বুদ্ধির ঢেঁকি। হেসে উঠল ফিটারবাবু।
ছুটি তাকিয়ে বুধুয়ার দিকে। আজ সকালে এসেছে লাকড়ি চিরে দিতে। লাকড়ি মানে জ্বালানি কাঠ। ওটা খানিকটা সেরে তারপর ঘাস আনার কাজ।
-গতকাল তুই ঘাস বড্ড কম এনেছিস। কালী আর ধলীটা খাওয়ার পর বাচ্ছা দুটোর জন্যে কিছু থাকে নি। আজ বাড়িয়ে আনবি বুঝলি? আরে বেশি করে ঘাস কাটবি, আছিস তো জোয়ান মদ্দ। এখনই কাজে ফাঁকি দিলে বুড়ো বয়েসে করবিটা কি? -ফিটারবাবু বলে।
ছুটি দেখল বুধুয়া শব্দ করে চায়ে চুমুক দেয়, একটুকরো রুটি ছিঁড়ে রুটির মাঝখানে রাখা নুনের একচিমটি নিয়ে মুখে দেয়। পাশে রাখা কাঁচা লঙ্কাটা তুলে দাঁতের কোণে কেটে ফিটারবাবুর দিকে তাকায়। ফিটারবাবুর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। বুধুয়া মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ফিটারবাবু চলে গেছে, বুধুয়া লাকড়ি চিরছে। উঠোনের একপাশে ডালায় শুকোতে দেওয়া হয়েছে খোসা ছাড়ানো কাঁচা হলুদ। ছুটি ততক্ষণে পড়ার ঘরে ঢুকে অঙ্কের খাতা খুলে বসেছে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বুধুয়াকে। ল্যাকপেকে হাত পা দিয়ে সে কাজ করে যাচ্ছে।
আজ বুদ্ধপূর্ণিমার ছুটি। এক একটা অঙ্ক কষেই সে বুধুয়াকে দেখছে। এবার অবাক হয়ে দেখল বুধুয়া কুড়ুলটা ফেলে এসে ডালা থেকে একমুঠো হলুদ তুলে তার ছেঁড়া লঝঝরে প্যান্টের পকেটে গুঁজছে। উত্তেজিত হয়ে ছুটি চেয়ার ঠেলে সরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বুধুয়া চোর? না বলে নেওয়াটাই তো চুরি। কিন্তু চোর যা নেয় লুকিয়ে নেয়। এ তো দেখা যাচ্ছে দিব্যি অতি সহজভাবে হলদি পকেটে ঢোকাল। লুকোছাপার কোনও ব্যাপার নেই। ছুটি একছুটে রান্নাঘরে গেল। মা রান্না করছেন। ছুটি কাছে গিয়ে প্রবল উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছে। মা রান্না ফেলে দাঁড়িয়ে গেলেন – কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? মা- র মুখে চিন্তার ছায়া।
ছুটি কথা বলতে গিয়ে হাঁফাচ্ছে। ঠিক করে কথা বলতে তার সময় লাগলো। তারপর বলল – মা বুধুয়া….
– হ্যাঁ বল। বুধুয়া কি? – মা-র মুখ থেকে ভয়ের ছায়াটা এক লহমায় সরে গেল। আবার রান্নায় মন দিয়ে বললেন – ধুর! এতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি? যা, পড়গে যা।
– কিন্তু বুধুয়া যে চুরি করল?
– সে আমি দেখব’খন। তুই যা।
ছুটি একটু দমে গেল। প্রবল উত্তেজনাটা কেমন যেন চুপসে গেল। মা কেন কথাটায় সেভাবে কানই দিলেন না। কে জানে কী। তাহলে বোধহয় মা- কে বলেছে।
পড়ায় আর মন বসছে না। দেখছে কাঠ চিরতে চিরতে বুধুয়ার পকেট থেকে দু’ চারবার হলদি পড়ে যাচ্ছে দু’ চারটা। আবার অতি কষ্টে ওগুলো ঢোকাতে গিয়ে প্যান্ট আরও খানিকটা ফেঁসে গেল। এইসময়ে মা এলেন। ছুটি একলাফ দিয়ে পড়ার টেবিল ছেড়ে ছুটে এলো। মা বিরক্ত হয়ে বললেন – এই তোর পড়া? বলছি না মন লাগিয়ে পড়তে? ছুটি মায়ের আঁচল নাড়ে। কী চমৎকার মা মা গন্ধ। মা-র দিকে তাকিয়ে তোষামুদে হাসে। উহু, বুধুয়ার ব্যাপারটা না দেখে সে যাচ্ছে না। ইশারায় সে বুধুয়ার প্যান্টের পকেট দেখায়।
মা বললেন -কি রে বুধুয়া, পকেটে হলদি কোত্থেকে এলো?
বুধুয়া হলুদ দাঁতে হেসে বলে – ঐখান থিকে লইলি। – বলে দিব্যি শুকোতে দেওয়া হলুদের ডালা দেখায়।
মা-ও একটু অবাক হয়ে বললেন – তোর হলদি চাই বলিস নি তো!
-মা বইলেছে।
– তোর মা?
– হঁ।
– কি বলেছে?
– বইলেছে ‘হে বুধুয়া ঘরে হলদি নাইখে। আইজ হলদি ছাড়াই তরকারি খাতে হবেক। এইখানে আছে তো লিয়ে লিলাম। হামদের অনেক দিন চইল্যে যাবেক।
– আমাকে বলবি তো?
ছুটি আগ বাড়িয়ে বলে – না বলে জিনিস নিলে কি বলে বলতো?
বুধুয়া হলুদ -সাদা চোখে তাকিয়ে রইল। মা ছুটিকে কিছু বলতে ইশারায় বারণ করলেন।
মা বললেন – এভাবে আর নিস না বুধুয়া। কিছু চাই আমাকে বলবি।
ছুটি বলে – ওগুলো প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ডালায় রাখ।
মা রেগে ছুটিকে বললেন – বেশি পাকামো হচ্ছে? তখন থেকে বলছি মন লাগিয়ে পড়তে?
বুধুয়া বলে – রাইখ্যে দিব ঠাকরান?
-না না নিয়ে যা। কিন্তু আর কিছু না বলে নিস না।
ছুটি বলল – কিন্তু মা….
– একটাও কথা নয় ছুটি। নিজের কাজে যা। আর বুধুয়া মনে থাকবে তো? না বলে আর কোনওদিন কিছু নিবি না। ঠিক আছে তুই এখন লাকড়ি একপাশে গুটিয়ে ঘাস আনতে যা। না হলে দেরি হয়ে যাবে।
বুধুয়া লাকড়ি গোছাতে লাগলো। তারপর চলে গেল।
বিকেলে ছুটি কোয়ার্টার এ ঢোকার সিঁড়িটাতে পা ঝুলিয়ে বসে সুখলালের বাক্স দোকানের বিক্রি বাটা দেখে। পেছনে কারখানায় তখন সারাদিনের চা পাতা তোলার ওজন চলতে থাকে। পাতিবাবুর গলার স্বর এখান থেকেও শোনা যায়। যাই বলুক পাতিবাবু, ছুটির কানে শুধু দশ শব্দটিই আসে। যেমন দশ দশ দশ দশ এইরকম। পাতি ওজন শেষ হয়ে গেলে শ্রমিকরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে। এই সময়ে বুধুয়াকে দেখা গেল মাথায় দু’বোঝা ঘাস নিয়ে আসছে, কিছু দেখা যাচ্ছে না তার, শুধু লিকপিকে দুটো পা ছাড়া। মনে হচ্ছে ঘাসের বোঝার দুটো পা গজিয়েছে। কাছে আসতেই ছুটি ডেকে উঠল -এই বুধুয়া! ঘাসের বোঝায় একটা কম্পন উঠল।
ক্রমশ