সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ৯)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো
সুধাময় ছুটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন সুখরাজের সাথে। সুখরাজের এর নাতি উইলসন ইশকুলে পড়ে, একটা কাজে সে এসেছিল। সুধাময় ছুটিকে কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন না কেন সে এভাবে ইশকুল থেকে পালিয়ে এল।
৷ সুখরাজ রাস্তায় এসে জিজ্ঞেস করে -খোঁকি কি পড়?
ছুটি কথা বলতে চাইছে। ইশকুলে এত ভয় জড়ো হয়ে থাকে কে জানতো! বাবা কিছু জিজ্ঞেস না করায় সে একটু ভাবনায় পড়েছে বটে। ভেতরে একটা ছটফটানি আছে। সুতরাং তার মুখ দিয়ে এটাই বেরোল -ইশকুল খুব খারাপ।
সুখরাজ বলে – ইশকুল খারাপ? কেন? তুমি ইশকুল থিক্যে চইল্যে আইলে, ছুটি তো নাই হইল্য খোঁকি।
সুখরাজ একটু পরিচ্ছন্ন লোক। কথাবার্তা বেশ গোছানো। ছুটিদের কোয়ার্টারের বিপরীতে তার একটা ছোটো পান বিড়ি সিগ্রেটের তোলা বাক্স দোকান আছে। সকাল বিকেল সে বসে। আগে ফ্যাক্টরিতে কাজ করত, এখন তার ছেলে সুখন কাজ করে। টিলার ওপরে ছুটিদের কোয়ার্টার, নীচে পিচঢালাই সদর রাস্তা, তারপর অনেকখানি খোলা জায়গা। ওখানে এককোণে সুখরাজ এর বিড়ি সিগ্রেটের দোকান। আর টিলার অনেকটা নীচে সুখরাজ এর ঘর। সে লেবারলাইনে থাকে না।
ছুটি বলে – আর ইশকুলে যাবো না।
– সেইটো একটা কথা হইল্য। ইটা তো ঠিক বাত নাইখে। তুমি হইল্যে গিয়ে মাস্টারবাবুর বেটি। ইশকুল যাইতে হ্যবেক, পইড়তে হ্যবেক। তবেই না বড় মানুষ হ্যবেক।। এই দেখো তো, হামি লিখা পড়া নাই জানি, কাগজে কালো কালো লিখা থাকে, পইড়তে নাই পারি। মনে বড় কষ্ট হয় খোঁকি।
– আমি তোমাকে লিখতে পড়তে শেখাব।
– তুমি পারো? হামাকে শিখাই দিবে খোঁকি?হামি এখন শিখতে পাইরব?
ছুটি সুখরাজকে দেখে। একটু বুড়ো হয়েছে বটে সুখরাজ, তাতে কি? শেখানো যেতে পারে।
সুখরাজ একটু স্মৃতিকাতর হয়ে বলে – হামি পারি না, লেকিন হামার বাবা পাইরত।
ছুটি বলে – তুমি শিখলে না কেন?
– মার খাইলম ইশকুলে, পাইল্যে এলাম। আর নাই গেলম।
ছুটি চমকে ওঠে, ভাবে – তারও অমন লেখাপড়া হবে না? তবে সে মার খায়নি, হ্যাঁ খেতে পারতো।
-তাহলে তোমার বাবা তোমাকে শিখায় নাই ক্যানে?
-আরে খোঁকি বাবার সময় কোথা? ফ্যাক্টরিতে যাতে হবেক লাই? তুমাকে কি আজ মাস্টর মারল?
-নাহ।
– তাইলে পাইল্যে আইলে ক্যানে?
-পড়াশুনা করব না।
– উঁ কথাটা ঠিক নাইখে।
-তোমার মত একটা দোকান দেব।
হা হা করে সুখরাজ হাসে। বলে – সেটাও হবেক লাই।
-কেন?
– আরে তুমি তো লেড়কি। লেড়কি কি দুকান দেয়? উসব বিটামাইনসের কাম। তুমি লিখাপড়া করে মাস্টর হব্যে।
কথা বলতে বলতে তারা কোয়ার্টারের কাছে এসে পড়েছে। সুখরাজ তার হাত ধরে কোয়ার্টারের ভেতর নিয়ে এল।
বুধিয়া চ্যালাকাঠ চিরছে কুড়ুল দিয়ে। বুধিয়ার দিকে তাকিয়ে সুখরাজ বলে -খোঁকি পাইল্যে আইল ইশকুল থিক্যে।
বুধিয়া কুড়ুল ফেলে সোজা দাঁড়িয়ে ছুটির দিকে তাকায়। তারপর যেন সাংঘাতিক বিপদ ঘটেছে এমনি গলায় চেঁচিয়ে ওঠে – হে ঠাকরান, দেইখ্যে যা। খোঁকি ইশকুল লে পাইল্যে আইল।
ছুটি ছুটে ঘরে ঢুকে মাকে জড়িয়ে ধরে।আহা, কী চমৎকার মা মা গন্ধ।
বুড়ি মেনি ছুটিকে দেখে ছুটির পায়ে পায়ে ম্যাও ম্যাও শুরু করেছে।
মা শুধু বললেন – কী রে ইশকুল ভালো লাগেনি? বেশ তো বাড়িতে পড়। আর একটু বড় হলে নিজে থেকেই ইশকুল যাবি যখন নিজের ইচ্ছে হবে।
রাতে বাবা জিজ্ঞেস করলেন – কি হয়েছিল ছুটি?
ছুটি বলে – ইশকুল যাব না বাবা, বাড়িতে পড়ব।
কেউ তেমন কিছু বলল না, কিন্তু ছুটির আগের আনন্দটা তেমন করে আর রইল না। মাঝে মাঝে মণির কথা মনে পড়ে। দুপুরবেলাটা একটু যেন একা একা লাগে। চোখের সামনে সেই লাল ফ্রক পরা বেত হাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ছবি মাঝে মাঝেই ভাসে। সবাই যখন ইশকুল যায় তখন সে দাঁড়িয়ে দেখে, মনে হয় কোথাও কিছু সে যেন ফেলে এসেছে। কিছু একটা কোথাও ছিল, কিম্বা আছে। কিন্তু সে সেখানে নেই, কিন্তু সেটা কি? এই ঝিম ধরা দুপুরবেলা কেন আগের মত সরব নয়?
৷ দুপুরবেলা আগের মতই গুটি গুটি পায়ে আসে। তাদের কোয়ার্টারের লাগোয়া থানার সামনের ফুলবাগানে এক নতুন বদলি হয়ে আসা পুলিশ কাজ করছে আজ। ফুলবাগানের যত্ন করছে। গন্ধরাজ ফুলগাছের ডাল লম্বা কাঁচি দিয়ে কলম করছে। ছুটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। লোকটা খুব ফর্সা, হাত ফেটে যেন এক্ষুনি রক্ত বেরিয়ে পড়বে এইরকম।
লোকটা তাকে দেখে হাসল। বলল – কি নাম তোমার? আজ ইশকুল নেই?
-ছুটি।
-ও। আজ ইশকুল ছুটি। কীসের ছুটি?
– আমার নাম ছুটি।
হো হো করে লোকটা হেসে উঠল।
– ভালোই তো নাম। তাই ইশকুল ছুটি করে ঘরে থাকো? তুমি ইশকুল যাও না?
-না।
– কেন? পড়াশোনা ভালো লাগে না?
ছুটি ওসবের উত্তর না দিয়ে বলে – তোমার নাম কি?
-আমার নাম? লোকটা একটু ভাবল। তারপর বলল – আমার নাম গন্ধরাজ সিং।
-ইঃ! মজা করছ। গন্ধরাজ গাছের যত্ন করছ আর বলছ তোমার নাম গন্ধরাজ সিং!
– আরে না না! আমার নাম গন্ধরাজ! কী করব, বাবা মা ঐ নামই রেখেছে।
লোকটা মণিপুরি। চেহারা ও কথা বলায় বোঝা গেছে। কিন্তু তার কাছে মিথ্যে নাম বলে মজা করছে।
– তোমার নাম বলো।
লোকটা গন্ধরাজ ফুলগাছটার কলম করার কাজ শেষ করে গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। হাসতে হাসতে বলে – আর কোন নাম নেই আমার। নামে কি? কত নাম হয় মানুষের। এই যেমন – সুখী দুখী পাঁচি পচা কড়ি জ্বালা ছুটি গন্ধরাজ… বলে হা হা করে হাসে। তবে একটু তো নামের ব্যাপার আছে, এই যেমন ছুটি ইশকুল ছুটি করে ঘরে থাকে, গন্ধরাজ, গন্ধরাজ ফুলগাছের যত্ন করে।
ঠিক ঐ সময়েই ওদিক থেকে কেউ ডাকল – এই গন্ধরাজ, এদিকে আসো, আজ আর বাগানের কাজ থাক।
গন্ধরাজ ইশারা করে ঐদিকে দেখিয়ে বলে – এইবার ঠিক আছে তো, আমার নামটা?
বলে হাসতে হাসতে দ্রুত চলে যায়।
সত্যিই তাহলে ওর নাম গন্ধরাজ। শেষের কথাগুলো একটু তো ভাবনায় ফেলে দিল, ছুটি নামের জন্যে সে ইশকুল পালিয়ে এলো? নাহ, মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু এত মারধর কেন হয় ইশকুলে? বেত কেন হাতে থাকে?
মা শুনে হাসলেন। বললেন – শোন তাহলে একটা গল্প। একটা লোক তার মনে খুব দু:খ। বাবা মা তার নাম রেখেছে ঠনাঠন দাস। একদিন সে এক ফকিরের কাছে গিয়ে বলল – বাবাজি, আমার মনে বড় দু:খ। আমার নামটা বড় বিচ্ছিরি। বাবা মা আমার নাম রেখেছে ঠনাঠন দাস।
ফকির তখন পথ দিয়ে যাচ্ছে, বলল – চল আমার সাথে। ফকির যাচ্ছে, ঠনাঠনও যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল রাস্তায় একটা লোক পড়ে আছে আর জল জল বলে কাতরাচ্ছে। ফকির সামনে গিয়ে তার কমন্ডলু থেকে একফোঁটা জল দিল লোকটার মুখে, লোকটার মুখের কাছে ঝুঁকে বলল-ক্যায়া নাম তেরা বেটা?
লোকটা খুব কষ্ট করে বলল- অমর। বলেই সে মরে গেল। ফকির একটা শ্বাস ফেলে পথ চলতে লাগলো। আরও কিছদুর গিয়ে দেখল – একটা জলার পাশে জলে কাদায় হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে একটা খুব রোগা লোক ঘাস কাটছে। ফকির তার সামনে গিয়ে বলল- তেরা নাম ক্যায়া হ্যায় বেটা। লোকটা বলল – ধনপত। তারপর আরও কিছু পথ হাঁটার পর দেখল একটি মেয়ে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। কেন সে মাছ ধরছে জিজ্ঞেস করায় সে বলল – এই মাছ সে সামনের হাটে নিয়ে বিক্রি করে যা পাবে তা দিয়ে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করবে। আজ তার খাওয়া হয়নি। ঘরে কিছু নেই, হাতে টাকা নেই। ফকির জিজ্ঞেস করল – তেরি নাম ক্যায়া হ্যায় বেটি? মেয়েটি বলল – তার নাম লছমী।
ফকির মুচকি হাসল। তারপর ঠনাঠন দাসের কাঁধে হাত রেখে বলল – অমর জো মরতা হ্যায়, ধনপত কাটতা হ্যায় ঘাস, মছলি ধরতা হ্যায় লছমী মাঈ, আচ্ছা হ্যায় ঠনাঠন দাস। নামমে ক্যায়া হ্যায় বেটা?
গল্প শেষ করে মা হাসলেন। ছুটি মাকে জড়িয়ে ধরল-কী সুন্দর গল্প! সে তো ঠনাঠন দাস আর ফকিরের সাথে সব ঘুরে এল, সব দেখে এলো।
ক্রমশ