T3 || স্তুতি || শারদ বিশেষ সংখ্যায় বিজয়া দেব

রঙ্গিনীর দুর্গা

রঙ্গিনী পুজো এলে একটা আলাদা মানুষ হয়ে যায়। সে আর নিজের মধ্যে থাকে না। সে একসময় যাত্রাপালা করেছে। খুব ভালো গাইত ও চমৎকার মনমাতানো অভিনয় করতো। । এই পুজোতেই তার মনের মানুষের সাথে দেখা হয়েছিল। সেটা ছিল ষষ্ঠী পুজোর দিন। তাদের গাঁয়ে তখন একটাই পুজো হতো। এখন হয় চারটে পুজো। গাঁ যে খুব বড়ো হয়ে গেছে তা নয় কিন্তু। আজকাল কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। তাতে হয়েছে কি ছোট ছোট দল, ছোট ছোট পুজো। ঐ পুজো যেমনধারাই হোক, ডিজে আনতেই হবে আর ঐ ছেলে ছোকরাদের ও উঠতি বয়েসি মেয়েদের সাথে মায়েদেরও নাচতেই হবে। রঙ্গিনী নাচ জানে। যাত্রাপালায় সে কোমর দুলিয়ে নেচেছে। কত হাততালি। আর সেই নাচ দেখে পাঞ্চেত প্রধান মঞ্চে উঠতো, আর বলতো – রঙ্গিনী দেবীর নাচে তুষ্ট হয়্যে হামি পঞ্চাশ টাকা দিলম।
রঙ্গিনীর বুকটা গর্বে ফুলে উঠতো। তাদের যাত্রাদলের নামই ছিল রঙ্গিলা যাত্রাপালা। তার বাপমায়ের দেওয়া নাম আসলে রঙ্গিনী নয়। তাঁদের দেওয়া নাম ছিল তুলসী। ছোটবেলায় যাত্রাপালা তাঁকে টানত। খুব ভালো লাগা। আহা, সেই বিবেকের গান। বিবেক একটা চরিত্র থাকতো। বিবেক মানে মানুষের বিবেক। গান গেয়ে গেয়ে মঞ্চে উঠতো।
আহা, সেই সময়ের কথা কি ভুলতে পারে রঙ্গিনী। “রঙ্গিলা যাত্রাদল” একবার পুজোর সময় নামালো যাত্রাপালা “মহিষাসুরমর্দিনী”। সেটা করা হলো ইতিহাসের সেই সময় নিয়ে যখন অত্যাচারী ইংরেজদের তাড়ানোর জন্যে সারা দেশ উত্তাল। যাত্রাপালাটি মঞ্চস্থ হয়েছিল দুর্গাপুজোর সময়। সম্ভবত সেটা ১৯৬৮ কিম্বা ৬৯ সাল। আহা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দেবী দুর্গা দনুজদলনী, অশুভনাশিনী। তাই দেবীকে দেশমাতৃকা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। অসুরের চেহারা সাদামুখো অত্যাচারী ইংরেজের। বিবেকের কণ্ঠে সেই বিদেশি দ্রব্যবর্জনের ডাক, খোলা মঞ্চ, দুদিকের দর্শকের মাঝে গ্রীনরুম থেকে গান গাইতে গাইতে আসছে বিবেক-
” ছেড়ে দে রেশমী চুড়ি, বঙ্গনারী
৷ কভু হাতে আর পরো না।
৷ জাগো গো ও জননী, ও ভগিনী
৷ মোহের ঘুমে আর থেকো না। ”
তারপর চারণকবি মুকুন্দদাসের গান –
” ভয় কী মরণে রাখিতে সন্তানে
৷ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান
নিতে হয় মুকুন্দরে নিও রে সঙ্গে। ”
এই বিবেকের পার্ট যে দিত সেই ছিল রঙিনীর মনের মানুষ। নাম তার প্রকাশ। ওই যাত্রাপালারই অভিনয় করতে গিয়ে উভয়ের মন দেয়া-নেয়া হয়েছিল। তবে তারা বিয়ে করেনি।
প্রকাশ তাকে বুঝিয়েছিল – দ্যাখো আমরা শিল্পী, আমরা সংসারে ঢুকে গেলে এই কাজ কতটা চালিয়ে যেতে পারব কে জানে। আমি কিন্তু মুক্তপুরুষ থাকতে চাই, আর মনের মানুষটিকেও আগলে রাখতে চাই।
কথাটা রঙ্গিনীর খুব ভালো লেগেছিল। প্রকাশ আবার বলেছিল – আর একটা কথা, আমি জানি তোমার নাম তুলসী, যখন তুমি আর আমি একা থাকব, তখন তোমাকে আমি তুলসী বলে ডাকব।
– কেন?
-বড়ো ভালো লাগা নাম হে সুন্দরী। কে রেখেছিল নামটা?
– অতো কি জানি? মা বাবা দুজনেই হয়তো রেখেছিল।
-” তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায় তুমি করিও প্রণাম ” গেয়ে উঠল প্রকাশ।
তারপর বলল – কতদিন থেকে আমরা একসাথে অভিনয় করছি বলোতো। কিন্তু ভালো লাগল হঠাৎই। আরে যেখানটায় তোমার দিকে আমার মুগ্ধ চোখ পড়ল সেখানে মানে গ্রীনরুমের কাছে সেই ঝাঁকড়া তুলসী গাছের পাশে দাঁড়িয়েছিলে। মহড়া চলছে, আমি গাইলাম – ছেড়ে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী/ কভু হাতে আর পরো না। আর আমার চোখের সামনে একটা ছবি ভাসছে – দুরন্ত দেশপ্রেমী কত নারী বেরিয়েছে পথে, দুর্গাপূজার মৃন্ময়ী প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে যে গান গাইছে তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সে আর কেউ নয় – তুলসী। চওড়া লালপেড়ে খদ্দরের শাড়ি পরা, দেখতে লাগছে যেন সত্যিকারের বীরাঙ্গনা, সত্যিকারের দনুজদলনী।
সেই থেকে প্রতি পুজোর সময় তারা “মহিষাসুর মর্দিনী “করেছে। আর অসুর নাশিনী দেবীর ভূমিকায় সে, আর কেউ নয়। রণরঙ্গিণী রূপে বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতীকে দেবীর স্তুতি হয়েছে। স্ক্রিপ্ট তৈরি করতো সে নিজে। সবাই তার ওপরই ভরসা করতো। শেষবার যখন সে অভিনয় করে তখন বয়েসও বেড়েছে অনেকটা। শরীরে রোগব্যাধি বাসা বাঁধছে ধীরে ধীরে। সেইবার তার ইচ্ছে হলো এইবার দেবীকে উমারূপে দেখবে। প্রকাশ খুঁজে খুঁজে শাক্তপদাবলী জোগাড় করলো। তাতে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য , রামপ্রসাদ সেন, দাশরথি রায়, রূপচাঁদ পক্ষী, কাঙাল হরিনাথ কত কত কবির নাম। মাতৃসঙ্গীত যেমন আছে তেমনই আছে আগমনী গান। জগজ্জননীকে সন্তান রূপে দেখা। গানগুলো ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছে, বাবার কাছে শুনেছে, রেডিও তে শুনেছে রঙ্গিনী। দেবীপক্ষ শুরু হতেই শুরু হয়ে যেত আগমনী গান। তো সেইবার যে স্ক্রিপ্টটা সে তৈরি করল সেটি গানে গানে ভরে দেওয়া। প্রকাশ বলেছিল – আগেকার দিনে মানুষ ছোট মেয়েটাকে যে কোনও পাত্রে বিয়ে দিত। মায়ের মেয়ের জন্যে যে কষ্ট হতো তা আগমনী গানে ফুটে উঠতো। জগজ্জননীকে নিজের সন্তানরূপে কল্পনা করে মায়ের সন্তানের জন্যে হৃদয়ের সব আবেগ আর্তি আগমনী গানে এসে গেছে। তাই মা আমাদের বড় আপন। সেই যে গানটা – “শুনেছি নারদের মুখে উমা আমার আছে দুখে/ শিব শ্মশানে মশানে ফিরে ঘরের ভাবনা ভাবে না”। একটু গাও না তুলসী। মন ভরে শুনি। এবারের যাত্রাপালা হোক গানে গানে ভরপুর।
তো রঙ্গিনী স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিল আগমনী গানে গানে। আর দুর্গা সেজেছিল সাদাসিধে চওড়া লালপাড় শাড়ি পরে। কপালে বড়সড় সিঁদুরের টিপ।

এখন রঙ্গিনী থাকে একা। প্রকাশ চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। তারপর সে অভিনয় দিয়েছে ছেড়ে। বলে বলেও কেউ তাকে অভিনয় করাতে পারেনি। সে প্রকাশের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। তার মনে হয় দিনরাত যেন প্রকাশ তার কাছে ছায়ার মতো থাকে।

পুজো এসে গেছে। কিন্তু কোথাও এখন এতটুকু শান্তি নেই। আর মনের মানুষটাকে হারিয়ে রঙ্গিনী এখন তার ছায়া নিয়েই থাকে। সে পুরনো সেই স্ক্রিপ্টগুলো বের করে বিবেকের গাওয়া গানগুলো গায়। আর সেই গানে ভরা স্ক্রিপ্টটা যখন মঞ্চস্থ হলো আগমনী গান শুনে মায়েদের চোখে আঁচল। আহা কী যে চমৎকার সেই যাত্রাপালা হয়েছিল, ভুলবার নয়। পুরনো আলমারির ভেতর থেকে সে সেই স্ক্রিপ্টটা বের করে গুনগুন করে। আজকাল গলা খারাপ হয়ে গেছে। আগমনী ও বিজয়ার গানে ভরপুর। কোনওটা কমলাকান্তের, কোনওটা রামপ্রসাদের। রঙ্গিনী গুনগুন করে – “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরি / উমা বুঝি আমার কাঁদিছে/ উমার যতেক বসনভূষণ / ভোলা সব বুঝি বেচে খেয়েছে।”….
তারপর ঐ গানটা, কেন যে এতো চোখে জল আসে। মনে হয় প্রকাশ তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে – গিরি এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না / বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনব না, / যদি এসে মৃত্যুঞ্জয় উমা নেবার কথা কয়/ এবার মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া / জামাই বলে মানব না।

-ও দিদিভাই ঘরে আছো?
কতগুলো মেয়ের গলা।
– আছি রে। আসছি।
খুব তাড়াতাড়ি সে আলমারি খুলে স্ক্রিপ্ট গুছিয়ে রাখে। বেরিয়ে দরজা খুলে দেয়। একসাথে আট দশটা মেয়ে। আজকাল তার তেমন খোঁজখবর কেউ নেয় না। রাস্তায় দেখা হলে একটুখানি কুশলমঙ্গল বিনিময়। কেউ কেউ আবার তাকে দেখলে স্মৃতিচারণ করে। ঐটুকুই।
– কি ব্যাপার বলো তো। বসো সবাই। হঠাৎ তোমাদের এই অচল আধুলিকে মনে পড়ল যে?
মেয়েগুলো একযোগে বলে ওঠে – মোটেই না। তুমি কতো গুণী মানুষ আমরা বুঝি জানি না। তুমি অভিনয় ছেড়ে দিলে কেন? ওটা ধরে রাখলে তো ভালো। কাজের ভেতর থাকবে। একটি মেয়ে বলে – মা বলেছে, তুমি প্রকাশজ্যেঠুকে খুব ভালবাসতে। ও মারা যাওয়ায় অভিনয় ছেড়ে দিয়েছ, কিন্তু এটা ঠিক নয় দিদিভাই।
– আচ্ছা আচ্ছা, এবার বলো তোমরা কি কাজে এসেছ?
– আমরা এবার মহিষাসুর মর্দিনী নাটক করছি। মা এবার রপরঙ্গিনী। তোমাকে দুর্গা সাজতে হবে।
– থিয়েটার তো কখনও করিনি রে। তাছাড়া আমার আগের গলাও নেই।
– তুমি রিহার্সালে আসো আজ। আর এই স্ক্রিপ্টটা মৌরিফুল লিখেছে। বলে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বলল – এই হচ্ছে মৌরিফুল। তুমি স্ক্রিপ্টটা পড়ে দেখবে। আর তুমি হবে আমাদের অসুরনাশিনী দুর্গা। তোমার কোনও বারণ শুনব না।
কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে – ফিরিয়ে দিও না। তুমি পারবে। আমি আছি গো সবসময় তোমার পাশে। তোমার মনের মানুষটি।
রঙ্গিনী মেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্ক্রিপ্টটা হাতে নেয়। বলে – কোথায় তোদের রিহার্সাল? ক’টার সময়?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।