সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ২২)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

উইলসন ইশকুলে ভর্তি হয়ে গেল ছুটি। বাবার ইশকুল, ‘নাই কোন চিন্তা/ ভালো আছে মনটা’।
ক্লাসে গিয়ে একেবারে প্রথম বেঞ্চে প্রথমেই বসল সে। সামনেই টেবিল চেয়ার। বাবা এসে এখানে বসবেন, রোল কল করবেন। সে বলবে -প্রেজেন্ট স্যার।
বাবাকে ‘স্যার’ বলবে। সে যে কী দারুণ ব্যাপার হবে। জানালার বাইরে চা গাছের প্রান্তর একবারে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু শিরীষ গাছ, সবুজে সবুজ, যতদূর চোখ যায় এই সবুজের সারির শেষ দেখা যায় না। সামনে বিশাল বিস্তারিত সবুজ ঘাসে ঢাকা খেলার মাঠ, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ইশকুল কম্পাউন্ড, এরপর মাটির রাস্তা, তারপর আবার সবুজ চা গাছের সারি, তারপর নীলাভ পাহাড়, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা নানা আকৃতির শীর্ষদেশ, উঁচু নীচু –এত নীল, যেদিন স্বচ্ছ আকাশ, সেদিন আকাশ পাহাড়ে মাখামাখি। কিন্তু প্রথমদিনের প্রথম ক্লাসে বাবা এলেন না, এলেন জগমোহন স্যার। স্যার বিহার অঞ্চলের লোক। রোলকল উনিই করলেন। ছুটির মনটা একটু দমে গেল। স্যার বিজ্ঞান পড়ালেন। ছুটি কিছু শুনল, কিছু শুনল না। সে শুধু ক্লাসের তার সহপাঠীদের দেখছিল। তার মনটা আজ উদ্বেল, উৎফুল্ল। তার পাশে যে মেয়েটি বসেছে সে শ্রমিকের মেয়ে, নাম জ্যোৎস্না, তারপর বসেছে মণি, তারপর লীলা, সে-ও শ্রমিকের মেয়ে। বাকিদের ভালো করে দেখা হয়নি। জগমোহন স্যার এবার ছুটিকে বললেন – তুমি দাঁড়াও।
ছুটি দাঁড়িয়ে বলে – আমি?
-হ্যাঁ। বলো একটু আগে কি পড়িয়েছি?
-বিজ্ঞান।
-কোন চ্যাপ্টার?
-বিজ্ঞান কি এবং কেন?
-তারপর?
-তারপর তো চ্যাপ্টার পড়ছি শুনছি আর বুঝছি।
-হুঁ। খুব শয়তান হয়েছ। চারদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস আর কি ভাবছিস? আজ প্রথম দিন, কিছু আর বললাম না। সামনের দিনে কিন্তু স্কেলের বাড়ি খাবে।
পিরিয়ড শেষের ঘন্টা পড়ল। যাক বাবা, রেহাই পাওয়া গেল।
জগমোহন স্যার জয়েন করেছেন খুব বেশিদিন হয়নি। ছুটিদের কোয়ার্টারে মাঝেমধ্যে যান। হাসিখুশি মানুষ। যুবক বয়েস।
প্রথম পিরিয়ড শেষ হল। পাঠশালায় তো পিরিয়ডের বালাই ছিল না। শুধু টিফিনের জন্যে আধঘন্টার একটা বিরতি ছিল। এখানে পিরিয়ডের ব্যাপার আছে, ব্যাপারটা ভেবে নিজেকে একটু অন্যরকম লাগল তার। এই একটু বড় হয়ে যাওয়া, উইলসন ইশকুলের ছাত্রী সে, নিজেকেই একটু অন্যচোখে দেখতে শেখা, বেশ লাগল। সেকেন্ড পিরিয়ডে সুধাময় এসে ঢুকলেন। এখন আর রোলকল নেই, ইস, ছুটির বাবাকে প্রেজেন্ট স্যার বলা হল না। বাবা অঙ্ক পড়ালেন। এবারে খুব মন দিয়ে ক্লাশ করল ছুটি। থার্ড পিরিয়ডে আবার জগমোহন স্যার পড়ালেন ইতিহাস, ফোর্থ পিরিয়ডে হেডমাস্টারমশাই ড্রয়িং ক্লাস নিলেন। ইশকুলের নিয়মকানুন নিয়ে ছাত্রদের কিছু বোঝালেন।
৷৷ টিফিন পিরিয়ডে দুরন্ত সুন্দর সবুজ মাঠে উন্মুক্ত ছোটাছুটি। চওড়া বারান্দায় ক্যারম খেলা চলছে, চলছে লুডোখেলা। ছেলেরা মাঠে হাডুডু খেলছে, ফুটবল খেলছে। ছুটিরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলা দেখল। ক্লাস সিক্সের মেয়েরা। লুডো খেলছে ক্লাস ফাইভের মেয়েরা। ক্লাস ফোর এর জন্যে কিছু নেই? মণি বারবার করে বলতে লাগলো -সুধাময়স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর না ছুটি, আমরা কি খেলব?
এইসময় জগমোহন স্যার বেরিয়ে এসে ডাকলেন – ক্লাস ফোর, আজ তোমাদের লাইব্রেরি ডে। বই নিয়ে যাও এসে। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়াও। আজ সোমবার। সোমবার তোমাদের বই নেওয়ার দিন। ক্লাস রুটিনে লেখা আছে, দেখে নিও।
স্যার একে একে বই দিচ্ছেন আর সই করিয়ে নিচ্ছেন। ছুটি একটু দেখেশুনে নিল “আধুনিক রবিনহুড”। বেশ পুরনো বই। বইয়ের পাতার গন্ধ নিল, পুরনো বইয়ের গন্ধ। পুরনো বই ও নতুন বইয়ের গন্ধ আলাদা আলাদা হয়।

গতকাল সহপাঠীদের সবার তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। শোভনা, ও পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্ট এর মেয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরের দিকে ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিল। তাছাড়া মুন্নি, প্রীতি, লীলা, জ্যোৎস্না, ঝুমু, মণি। এখানে ঝুমু, মণি ও ছুটি ছাড়া বাকিরা সব শ্রমিকদের মেয়ে।
ছেলেদের মধ্যে রয়েছে কিষণ কৈরি, বাসুদেব লোহার, রঞ্জন, পাপাই, রামশরণ আরও সব। এখানেও শ্রমিকদের ছেলেরাই সংখ্যায় বেশি। এরমধ্যে বাসুদেব লোহারকে দেখে অবাক হল ছুটি। গায়ে মাথায় বড়সড়, অনেকটা লম্বা। ক্লাস ফোরে এত বড় ছেলে, দেখলেও কেমন জানি ভয় ভয় করে। চোখদুটো এত লাল কেন? মাথায় চুপচুপে তেল, কিষণের মাথায়ও তেল চুপচুপে, কানের পাশ দিয়ে হালকা গড়িয়ে পড়ছে। মণিকে কথাটা বলল ছুটি। মণি বলে – ওদের সবসময়ই ঐরকম। তুই তো প্রাথমিকে একদম আসিসনি। তাই লক্ষ করিসনি। মণি ও ছুটি মুখে হাত দিয়ে হেসে নিল একচোট যাতে শোভনা লীলা ওরা বুঝতে না পারে। কিন্তু বাসুদেব লোহারকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ল ছুটি। এত বড়সড়? চোখদুটো এত লাল? কেন?

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *