সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিজয়া দেব (পর্ব – ৪)

অতিমারী

মুন্নির কত ভয়! এক জায়গায় তো সে কাজ করে না! সবাই কি আর মাইনে দেবে? দুটো বাচ্ছা ইস্কুলে মিড ডে মিল খেত! পড়াশুনাও যাই হোক কিছু তো হত! এখন ইস্কুলও বন্ধ হয়ে গেল! কবে খুলবে কেউ জানে না! ঘরের মরদটা প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরির কারখানাতে কাজ করত, ফ্যাক্টরিও অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল। কাজ নেই। চারটে প্রাণীর দু’বেলা দুমুঠো জুটবে কোথা থেকে? মরণ সময় এল? বড়লোক মরবে ভাইরাসে, গরীব লোক মরবে না খেয়ে? ঠিক ঠিক পুরা দুনিয়া শুনসান হো যায়গা, কোই নেহি রহেগা সির্ফ পের পৌধে সির্ফ সমুন্দর কে লেহেরে কে আওয়াজ…..

্যআক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সেবিকাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। করোনা টেস্টে পজিটিভ এসেছে। অগ্নির পাগলের মত অবস্থা, সেবিকার শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে দ্রুততম। একদম সময় পাওয়া গেল না। তীব্র অসহনীয় শ্বাসকষ্ট, আইসিইউ এ মাত্র দুদিন ছিল সেবিকা। অগ্নি কিছুই করতে পারল না, কিচ্ছু না। যেন চিকিৎসা করার কোনও সুযোগ পাওয়া গেল না, সেবিকা সব ছেড়েছুঁড়ে কেমন যেন নিঃশব্দে চলে গেল। একজন ডাক্তার, যাঁর চিকিৎসায় রোগী সেরে ওঠে, জীবনের আস্বাদ নেয় নতুন করে, সে কোবিডের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে মারা গেল। একই হাসপাতালে একজন স্বাস্থ্যকর্মীও মারা গেল।
আইসোলেশনে ছিল সেবিকা। আইসোলেশন! আইসোলেশন! সবার থেকে সবার আইসোলেশন। কেউ কারোর কাছে যাবে না। দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মৃত্যুর পর মৃতদেহকে আপনজন বিবর্জিত অবস্থায় পাঠানো হচ্ছে সৎকারে। কিছু করার নেই। কোবিড সবাইকে একা করে দিচ্ছে। মানুষ থেকে সরে যাচ্ছে মানুষ। চকখড়ি দিয়ে গোল গোল বৃত্ত এঁকে এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তের দূরত্বচিহ্ন মেপে দেওয়া হচ্ছে। শোকগ্রস্ত অগ্নি করোনাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেবিকার এই আচমকা হঠাৎ চলে যাওয়ার শোক সামলে ওঠার একমাত্র পথ রোগাক্রান্ত মানুষের সেবা। ডাঃ অগ্নি রায় করোনা প্রতিরোধে দিনরাত এক করে দিচ্ছে। ডাক্তারবন্ধুরা বাধা দিলেও শুনছে না অগ্নি। রোগীরা আইসোলেশনে। বাড়ির লোকজন এসে দেখাও করতে পারছে না। এভাবে বাবা মা ভাই বোন স্ত্রী সন্তান একা একা যুদ্ধ করছে। এক আশি বছরের বৃদ্ধ মোহনলাল মেহতা রোগের সঙ্গে লড়াই করে জিতে গিয়েছে। হুইলচেয়ারে বসে সবাইকে থামস আপ দেখাচ্ছে। সবাই সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, করোনাযুদ্ধে জয়ী হল এই অশীতিপর বৃদ্ধ আর তুমি পারলে না সেবিকা? অগ্নির চোখে জল আসে। এত অসহায় মানুষ? হয়তো একদিন এই অসহায়ত্ব কাটবে। মানুষের বুদ্ধির কাছে পরাজিত হবে এই মারণ ভাইরাস, শুধু এইমূহুর্তে ডাক্তার হয়ে সেবিকাকে পরাজিত হতে হল এই মারণ ভাইরাসের কাছে, এইটি বড় কষ্টের, বড় আফশোষের, বড় ক্ষতির।
অনিশ্চিতি। এই অনিশ্চিতিই এখন সময়ের মুখ। উদাসীন গাছপালার পাশ ঘেঁষে কালো জনহীন রাজপথের ওপর দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে যাচ্ছে, তীব্র হুটারের শব্দে সচকিত হয়ে পড়ছে গৃহবন্দি মানুষ। কে যায়? যে গেল সে কি আর ফিরে আসবে? ডা. অগ্নি রায় ভাবে, সে আক্রান্ত হল না তো আজও, দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছে সে, কাজ যেন তার মনের জোর বাড়িয়ে দিচ্ছে, পুরো হাসপাতালটাই তো যুদ্ধক্ষেত্র, মানুষ বনাম ভাইরাস। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আজকাল যেমন তেমন করে ঘুমিয়ে পড়ে অগ্নি। কেউ এসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয় না। কেউ বলে না, আমরা দুজনেই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, ক’টা দিনের জন্যে ঘুরে আসি চলো। সেবিকা ও সে দুজনেই ব্যস্ত থাকত, যখন দুজনেই কাজে কাজে ভারি ক্লান্ত তখন খুব কাছাকাছি এসে তো ভাবত অন্তত ক’টা দিনের জন্যে ঘুরে আসা যাক! এখন? নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার কোনও কিছু নেই। ইচ্ছে করলেও কিছুদিনের জন্যে সে কোথাও যেতে পারবে না। টেলিভিশন জুড়ে একটিই সংবাদ পরিবেশিত হয়ে চলেছে লাগাতার আক্রান্তের সংখ্যা কত মৃতের সংখ্যা কত। স্বপ্ন আসে লাগাতার, সেবিকা আসে। বলে – তুমি এবার থামো। বিশ্রাম নাও। আজ রাতে তো খাওনি। ওরা তোমাকে খাওয়ার জন্যে ডাকতে এসেছিল। তোমাকে ঘুমাতে দেখে ফিরে গেছে। উঠে মুখে কিছু দাও। ঘুম ভেঙে যায়। সেবিকা ও তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেওয়ালে। সে সেবিকার ছবিতে আজও মালা পরায়নি। সে বিশ্বাস করে না সেবিকা নেই, করবেও না। আচ্ছা সে কি রাতে কিছু খায় নি? মনে করতে পারছে না। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। এ বাড়ির কাজ করে লোকজন সে ঘুমিয়ে পড়লে ডাকবে না। এরকমই এদের ওপর নির্দেশ দেওয়া আছে। অগ্নি উঠে গেল ডাইনিং এ। টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া। সামান্য কিছু খাবার মুখে দিল, বেঁচে থাকতে হলে খেতে হবে বৈকি।
ঘড়িতে রাত দুটো। এত রাতে অ্যাম্বুলেন্স নির্জনতাকে খান খান করে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীটা রোগাক্রান্ত গোটা গোলকটাই যেন হাসপাতাল। দরজা খুলে ব্যালকনিতে এল অগ্নি। এক ভয়ংকর শীতল চোখ যেন অন্ধকার ভেদ করে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছে। এই কিছুদিন আগে যে সেবিকা তার পাশে ছিল আজ সে কোথাও নেই। আর কোনদিন সেবিকা ফিরে আসবে না আর কোনদিন সেবিকার স্পর্শ সে পাবে না। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? সত্যিই কি এটা ঘটে গেছে অগ্নির সাথে?
হাতের মোবাইলটা ঘাঁটতে গিয়ে দেখল হোআটস অ্যাপে মরমীর ম্যাসেজ – “অগ্নি, খুব খারাপ খবরটা শুনেছি টেলিভিশন সংবাদে। খুব খাটছ শুনতে পাচ্ছি। করোনাযুদ্ধে নেমেছ। শুভকামনা রইল। তুমি জয়ী হও। সান্ত্বনা জানাবার ভাষা নেই। সুস্থ থেকো।‘’
উত্তরে অগ্নি লিখল – “বড় একা লাগছে।‘’ এরকম লেখার ইচ্ছে তার ছিল না। মনে হল সে নয়, আর কেউ যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল।

কোবিড নাইন্টিন ভাইরাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা মরণপণ গবেষণায় যখন লিপ্ত, তখন বাতাসে গুজব ছড়াচ্ছে প্রচুর। শক্তিধর দেশগুলো এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে বলছে ছড়ানো হয়েছে। একে অপরকে দোষারোপ করছে। আবার বিশ্বস্বাস্হ্য সংস্থা মানুষকে নিজের নিরাপত্তার জন্যে যা কিছু নির্দেশাবলী দিয়েছে তা পালন করতে গিয়ে কিছু মানুষ অবুঝ শিশুর মত আচরণ করছে।
বিপাশা দরজাটা খুলতেই মুখে মাস্ক লাগানো এক মহিলাকে ফস করে সরে যেতে দেখলেন। মনে হল যেন অনু। অনু ও আশা দুটি মেয়ে বছর দুই হল রুদ্রপ্রতাপ সিং এর ফ্ল্যাটে ভাড়াটে হিসেবে আছে। রুদ্রপ্রতাপ সিং দিল্লির অভিজাত এলাকায় বিশাল ফ্ল্যাট নিয়ে ওখানেই শিফট করেছে। অনু ও আশা নার্সিং পেশার সাথে যুক্ত। রুদ্রপ্রতাপ যখন এই আবাসনে ছিল তখন শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মায়ের সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব নিয়েছিল যে মহিলাটি তারই মেয়ে অনু। আশা তার সহকর্মী। অণুর মা দিল্লিবাসিনী নয়, মেয়েদুটো নার্সিং হোস্টেলে জায়গা না পাওয়ায় অণুর মা রুদ্রপ্রসাদকে বলেকয়ে ফ্ল্যাটটা ভাড়ায় নিয়েছে। অনুরা দরকারে সবাইকে সাহায্য করে। এখন সারাদিন হাসপাতালে আপ্রাণ খাটাখাটুনি করছে। মারাত্মক খাটুনি, সারাদিন কোবিড রোগীকে সামলানো সহজ কাজ নয়, পিপিই কিটে মাস্কে আপাদমস্তক ঢেকে এরা দিনরাত এক করছে অথচ ফ্ল্যাট থেকে রুদ্রপ্রসাদের কাছে ফোন গেছে এদেরকে আবাসন থেকে সরানো হোক। সারাদিন এরা কোবিড রোগীর সঙ্গে আছে, তাদের থেকে আবাসনে ইনফেকসন ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। অথচ দরকারে রাতবিরেতে এদের সাহায্য নিয়েছে এই আবাসনের মানুষ। ব্যাপারটা চূড়ান্ত অমানবিক ও স্বার্থপরতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল।
বিপাশা ডাকল – অনু?
মেয়েটি ফিরে না তাকিয়ে বিদ্যুৎগতিতে লিফটের ভেতর ঢুকে গেল। অথচ অনু খুব ভদ্র, সবসময় সৌজন্য দেখায় মুখোমুখি হলে। হয়তো ভয়ে সরে গেছে। সে তো জানে না বিপাশা তার সঙ্গে কী ব্যবহার করবে এই পরিস্থিতিতে! সত্যিই তো, এই ঘোর বিপদে মেয়েদুটি যাবে কোথায়! খুব খারাপ লাগল বিপাশার। ভয় আর আতঙ্কে মানুষ হয়ে উঠেছে স্বার্থপর অমানবিক। ভয় ভয় আর ভয়। টেলিভিশনে সোস্যাল মিডিয়াতে ক্রমাগত নানা প্রচারে ভীত মানুষ আজ দিশেহারা। ভয় ভয় আর ভয়। নিজের হাতকে ভয় দরজার হাতলকে ভয়, লিফটকে ভয়, বাইরে যেতে ভয়, হোম ডেলিভারির বস্তুকে ভয়, বাজার থেকে আসা তরিতরকারিকে ভয়, ফ্রিজকে ভয় সর্বোপরি মানুষে ভয় অথচ এই ঘোর অসময়ে মানুষকে তো মানুষের কাছেই যেতে হয়। এই ফ্ল্যাটের কেউ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেলে অনুদের হাত থেকেই সেবাশুশ্রূষা নিতে হবে। অনুরাই বাঁচাবার জন্যে প্রাণপাত করবে।
ব্যাপারটা কিন্তু সহজে মিটল না, দিনদুয়েক পর আবাসনের মিসেস মালকানির ফোন এল। হোআটস অ্যাপে সবার স্বাক্ষর নেওয়া শুরু হয়েছে। এটা খুবই জরুরি, আবাসনের সবার স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারটা তো ভাবতেই হবে ইত্যাদি।
কথাকলি গোটা ব্যাপারটা দেখছিল আর ভাবছিল কোবিড কি মানুষকে এমনি অমানুষ করে দিল না কি মানুষ ভেতরে ভেতরে এমনই স্বার্থপর, কোবিড সেটাকে চিনিয়ে দিচ্ছে? মামা কি এই হোআটস অ্যাপ এর এই অমানুষিক দাবিতে সিগনেচার দেবে?
না, অতীশ দিল না। বরং স্পষ্ট করেই সবাইকে জানিয়ে দিল – কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এই ঘোর বিপদে যারা মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে লড়াই করছে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
দু’দিন পর রাত আটটা হবে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কথাকলি ও বিপাশা, দেখল অনু ও আশা বেরিয়ে যাচ্ছে, দুটো ট্রলি সুটকেস ও বেশ বড় একটা ব্যাগ।
বিপাশা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল-কোথায় যাচ্ছ অনু? আশা? ওরা ফিরে তাকাল। হাত নেড়ে টা টা করল। তারপর সুটকেস ব্যাগ টেনে আবাসনের চত্বর পেরিয়ে গেল।
কোথায় গেল ওরা? কোথায় যাবে?
বিপাশা মিসেস মালকানিকে ফোন করল। বিপাশা জিজ্ঞেস করল- ওরা কি চলে গেছে আবাসন ছেড়ে? কোথায় গেল?
মিসেস মালকানি বলল – তোমরা তো আমাদের দাবিতে সই করলে না। তবে ওতে কিছু হয়নি। রুদ্রপ্রসাদজি আমাদের কথা শুনেছে। না শুনে পারবে? এই বিপদে কথা না শুনলে আমরা কি ওর কথা শুনব? জরুরত তো সবারই আছে। সমঝে বুঝে চলতে হবে সবাইকে। কোথায় গেছে জেনে আমাদের কী হবে? যেখানেই যাক না কেন, ওদের আবাসন ছেড়ে যাওয়াটা খুব জরুরি ছিল ইত্যাদি।
বিপাশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এই গোটা ব্যাপারটা কথাকলিকে ভয় ধরিয়ে দিল। একটা অচেনা কষ্ট বুকের ভেতর পাকিয়ে উঠছে। সবকিছু কেমন অচেনা, লকডাউনে অনেকটা প্রদূষণহীন এত ঝকঝকে আকাশ সবুজ গাছপালা যেমন অচেনা তেমনি অচেনা পালটে যাওয়া পরিবেশ পাল্টে যাওয়া লোকজন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।