|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় বাসুদেব দাস

জংশন

ভাস্কর ঠাকুরীয়া
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ

কাহিনির কোনো আরম্ভ, কোনো শেষ নেই। বহু মানুষের জীবনে বহু ঘটনাই একসঙ্গে ঘটে থাকে, তারই একজনের ঘটনারাজিতে কখনও অন্য একজনের ঘটনা কিছু সময়ের জন্য সহযাত্রী হয়ে এগিয়ে যেতে পারে।তারপরে আবার প্রতিজনের কাহিনিই এগোয় নিরলস ভাবে স্বাধীন হয়ে, ওদের নিজস্ব উচ্চ নিম্নস্বর থাকতে পারে, কিন্তু শেষ থাকে বলে বলতে পারিনা ঘটনারাজির একটি দিক নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে অন্য একটি দিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং এভাবেই খামখেয়ালি ভাবে একসঙ্গে বহু রসহীন ঘটনারাজি কাহিনির রূপ লাভ করার আগেই নিজ নিজ পথে এগিয়ে যায়। তাকে কেটেকুটে মানুষের রুচিবোধ অনুসারে একটা কাহিনি গড়ে বের করাটা কি যুক্তিকর? তার সত্যতার গভীরতা কত হবে?
জানালা দিয়ে রেলপথ বদলি করা দেখে রূপনাথ তাই ভাবছিল, ওরা কেবল যাচ্ছে, আর দিক বদলাচ্ছে জংশন গুলিতে বহু রেলের লোহা নির্মিত পথ একসঙ্গে হয়েছে আবার আলাদা হয়েছে। প্রতিটি ধাবমান যদিও, ওরা অনেকটাই নিঃসঙ্গ, ঠিক তার মতো আর প্রতি সময়ে প্রতি জনেরই নিজের নিজের বহু কাহিনি থাকে যার কোনো বিশেষ আরম্ভ নেই, শেষ নেই, একটা সময় যদি তাকে ধরে রাখতে যায় তাহলে সে হয়ে পড়বে বহু বিশৃঙ্খল ঘটনার সমষ্টি এবং তারই একটি বিশেষ ঘটনার অনুসরণ করা কথাটাও হাস্যাস্পদ, কারণ কোনো কাহিনি একা এগোতে পারেনা ঠিক এই রেলপথ গুলির মতো।
চিন্তার ঘূর্ণিপাকে ডুবে থাকার জন্যই রেলটি কোন সময়ে এসে তার গন্তব্য স্থান গোঁসাইগাঁও পেল সে বুঝতেই পারল না, স্টেশনের ফলকটা দেখেই ব্যাগটা নিয়ে সে নেমে এল। গোঁসাইগাঁওয়ে সে কখনও আসেনি। অন্তরঙ্গ বন্ধু যোগেনের বারবার অনুরোধের চাপে পড়ে সে তার জীবনের দিক পরিবর্তিত করতে পারা সিদ্ধান্তটা নেবার জন্য এখানে প্রথমবারের জন্য পা রেখেছে, কিন্তু স্টেশনে পা রেখে যোগেনকে দেখতে না পেয়ে সে বিব্রত অনুভব করল। স্টেশনটিতে বড় একটা গতিবিধি ছিল না। স্বভাবগতভাবে তারই এককোণে চুপ করে বসে থাকা একজন যুবতির দিকে তার চোখ গেল । অসহজ ভাবে সঙ্গে থাকা ছেলেটির হাতে হাত অপ্রস্তুতভাবে রেখেছে, ছেলেটিও তার আঙ্গুলগুলি খামচে চারপাশে সতর্কতার সঙ্গে চোখ বুলাচ্ছে যেন এখনি যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মেয়েটিকে মোটামুটি বোড়ো যুবতি বলেই মনে হচ্ছে , ছেলেটিকে দেখে কিন্তু তেমন মনে হল না। যদিও কানে কান ফুল , যত্ন না নেওয়ার জন্য পাটের রং ধারণ করা চুল ইত্যাদিতে আজকালের উচ্ছৃঙ্খল যুবক বললে চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে তা দেখে রূপনাথের সেরকমই মনে হল। মার্জিত পোশাক এবং কমনীয় মুখের মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটিকে ঠিক মেলাতে পারছিল না রূপনাথ।
রূপনাথ যোগেনের কোনো খবর না পেয়ে স্টেশনের একটা পিসিওতে ঢুকে তাকে ফোন করবে বলে এগোতেই পেছনে শব্দ হওয়ায় সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল মেয়েটির সঙ্গে থাকা যুবকটি প্রাণ হাতে করে নিয়ে স্টেশনের অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে এবং পেছনে পেছনে অন্য একজন হাতে রিভলভার নিয়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। স্টেশনে অসংযতভাবে ফেলে রাখা একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছেলেটি পড়ে গেল এবং তখনই তা দেখে তেড়ে যাওয়া ছেলেটির হাতের রিভলভার গর্জন করে উঠল এবং মেয়েটির চোখের মণির সামনে জলের আস্তরণ একটা জমা হয়েছিল যদিও সে কিন্তু স্থির হয়ে বসে রইল ।
* * * *
সকাল থেকে বোন সবিতার অস্বাভাবিক মতিগতি দেখেই সিদ্ধেশ্বরের কিছু একটা সন্দেহ হয়েছিল। যখন ভাত খাওয়ার পরে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তখন তার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল, সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে তার খোঁজে তল্লাশি চালাল।
– না কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।
কাজের মেয়েটাকে দুটো চড় কষাতেই তার মুখ থেকে সত্য কথা বেরিয়ে পড়ল’ সবিতা প্রতিবেশী একজনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল।অবোড়ো হলেও কথা নেই, কিন্তু জন এবং ওদের ঘরের প্রত্যেকের চোখের মণি সবিতা?
জনের নামটা শুনলেই তার শরীরে বিছা হাঁটতে থাকে। তার পোশাক-আশাক, বেপরোয়া চাহনি, সঙ্গের বন্ধু, কাণ্ডকারখানা গুলি। ঘরটা সম্ভ্রান্ত এবং পড়াশোনায় ভালো হওয়া ছাড়া তার গায়ে আর কোনো ভালো গুণ সে দেখতে পেল না।
সিদ্ধেশ্বর জিপ গাড়িটা নিয়ে জনের প্রত্যেকটি সম্ভাব্য গুপ্তস্থান, বন্ধুর ঘরে খুঁজে দেখল, না তাদের একজনেরও দুপুর থেকে কোনো খোঁজখবর নেই।
জনের পিতা কথাটা শুনে বিতস্তদ্ধ। জনের অভিযোগ তার কাছে ছোটকথা। এই নাকি কোনো রিক্সাওলাকে মেরেছে, খুকুরি নিয়ে রাজপথে কাউকে রণহুঙ্কার দিচ্ছে, মদ খেয়ে অশ্লীল কথাবার্তা বলছে– এইসব আজকাল তার কাছে সাধারণ কথা হয়ে গেছে; কিন্তু কারও মেয়ে নিয়ে? অতি নিরীহ স্বভাবের মানুষটি ছেলের উপরে শাসনের লাগামটা কখনও ধরতে পারেনি। সিদ্ধেশ্বর অপহরণের কেস দিয়ে সকলকে জেলে ভরাবো ইত্যাদি নানা গালি দিয়ে চলে গেল, নিরীহ স্বভাবের মানুষটি কেবল বসে রইল।
নিজের ছেলে কী করেছে, কোথায় আছে তিনি কিছুই জানেন না। সিদ্ধেশ্বর সবিতার কথা ভাবল, পিতার পাকা চুল তোলা,সে গরমে বাড়ি এসে পৌছালে কাঁচের গ্লাসে ফ্রিজের জল খাওয়া, মায়ের ভাজাটা মাঝেমধ্যে নাড়িয়ে দিয়ে আর টিউশন কলেজের বাইরে তার যে কোনো আলাদা জীবন একটা থাকতে পারে সে এখনও ভাবতে পারে না। মাঝেমধ্যে যখন এখানে সেখানে সে শুনে যে টিউশন থেকে আসার সময় জনের সঙ্গে কথা বলে আসে তখনও সে ওদের কথা বিশ্বাস করেনি। এক বার সে বোনকে বিরক্ত করায় জনকে শিক্ষা দেবে বলে স্থির স্থির করায় জণ প্রায় এক মাসের জন্য শহর থেকে উধাও হয়ে গেল। তার বন্ধু বর্গের খবর পাওয়ার নেটওয়ার্ক বড় ভালো।
অবশ্য ওরা সকলেই সিদ্ধেশ্বরকে এখনও সমীহ করে চলে, কারণ শহরটিতে এখন ও তার একটি নাম আছে।’ ওরা যদি ডালে ডালে আমিও পাতায় পাতায়– সিদ্ধেশ্বর মনে মনে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। এই জন নামের ছেলেটির গলাটা মুচড়ে ফেলতে ইচ্ছা হল তার।
‘ মা কসম, সে যদি সবিতার দাদা না হত, তার কী হাল করতাম– বলে দিলাম আমি।’– পৃথিবীর প্রতিটি কথাতেই মা কসম লাগিয়ে বলিউডি ভঙ্গিতে কথা বলার স্বভাবটা বহুদিনের। ছোট শহরটির অন্ধকার ভেদ করে ১৯৭৭ মডেলের ফিয়াট গাড়িটা চালিয়ে লোহিত এগিয়ে চলল‌। পেছনের সিটে জন নিরলসভাবে বসে সিগারেট টানছে আর সবিতা বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার নিজের শহরটি, ঘরটা এবং মা বাবা কে কখন দেখতে পাবে তার ঠিকানা নেই। লোহিতের কাছে বসে অমৃতের তার দিকে তাকিয়ে মনে হল তার দুগালের অশ্রুবিন্দু নিচের দিকে নেমে আসছে।
লোহিতরা কিছু একটা উল্টাপাল্টা হওয়ার সম্ভাবনার জন্যই ফিয়াটটা দুই নাম্বার প্ল্যান হিসেবে তৈরি রেখেছিল এবং এখন বিপদের সময় ওটাই ওদের আসল সহায় হয়ে পড়ল। ওদের একসঙ্গে দেখতে পেলেই জন এবং সবিতা কোথায় যাবে কী করবে শহরের প্রত্যেকে জানে, যার জন্য জন দোষ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ওদের দুজনকে স্টেশনে রেখে বাইরে পাহারা হিসেবে অপেক্ষা করছিল ।য়ারুল স্টেশনের ভেতরে দূরে দূরে ওদের সুরক্ষার দায়িত্বটা এবং অজয় দীপকরা দুরে দুরে সবিতার দাদা সিদ্ধেশ্বর কী করে, কোন দিকে যায় তার আভাস নিচ্ছিল । কোথাও কোনো বিসঙ্গতি দেখা দিলেই ওরা বাইক , সাইকেল এবং পিসিও এর মাধ্যমে একে অপরকে খবর দেবার কথা ঠিক করে রেখেছিল ।
সিদ্ধেশ্বর সমগ্র শহরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ানোয় জনের গুপ্তচররা ততটা চিন্তা করছিল না, কিন্তু যখন সে পুলিশে অপহরণ করা বলে কেস দেওয়ার কথাটা জানতে পারল এবং তারপরে পকেটে বস্তুটা নিয়ে স্টেশনের দিকে তুফানের গতিতে এগিয়ে গেল তখনই তাদের চিন্তা বাড়ল।
অজয় আর দীপক সংক্ষিপ্ত পথে স্টেশনে দৌড়ে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষনে সিদ্ধেশ্বর হাতে খোলা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জনের পেছনে দৌড়াচ্ছে। কারু গায়ে গুলি লাগল না এবং সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকা সুরক্ষা কর্মী সিদ্ধেশ্বরকে জাপটে ধরল।য়ারুলের উপস্থিত বুদ্ধির জন্যই স্টেশনে হুলুস্থুল লেগে থাকা অবস্থায় কেউ লক্ষ্য না করায় সে জন এবং সবিতাকে স্টেশনের বাইরে বের করে আনল, এদিকে লোহিতরা ততক্ষণ পর্যন্ত কী ঘটেছে জানতে পেরেছিল বলেই তৎক্ষণাৎ ওদের ফিয়াটে উঠিয়ে শহরের বাইরের দিকে রওনা হল। তখন সন্ধ্যা অতিক্রম করে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। অঞ্চলটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, এদিকে সিদ্ধেশ্বর পুলিশ স্টেশনে কিডন্যাপিং এর কেস দিয়েছে, এরকম অবস্থায় একটি মেয়ে নিয়ে মধ্যরাতে হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এদিকে সিদ্ধেশ্বর যে এই অঞ্চলটিতে ওদের থাকতে পারার সম্ভাব্য স্থান গুলি খানাতল্লাশ করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
চিন্তার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে ওরা হাইওয়ের অন্ধকার অতিক্রম করে এগিয়ে চলল। সিদ্ধেশ্বরকে পুলিশ ধরেছে ঠিক, কিন্তু তার পক্ষে পুলিশের হাত থেকে নিমেষের মধ্যে বেরিয়ে আসাটা খুব একটা বড় কথা নয়। সে কথাটা ওরা প্রত্যেকেই জানে। ভাবা মতো গুয়াহাটিতে গিয়ে জন এবং সবিতার বিয়েটা রেজিস্টার করে না নেওয়া পর্যন্ত ওদের একজনেরও শান্তি নেই। কোন মুহূর্তে যুবতি অপহরণকারী বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, কোন সময়ে সিদ্ধেশ্বর বন্দুকের কুন্দায় মাথাভাঙ্গে তার ঠিক নেই।
অমৃত সবিতার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল ‘ কী কারণে তার মতো সরল একটি মেয়ে জনের মত অস্থির একটি ছেলের কাছে সারা জীবন সঁপে দিতে উদ্যত হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। এখন তার কথা আলাদা, ওরা শৈশব থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে, যৌবনের প্রতিটি কর্ম, অপকর্ম একসঙ্গে করার সময় ওদের মধ্যে করণীয়তার অলিখিত একটি অভিধান কবেই তৈরি হয়ে গেছে। অবশ্য জনের কর্মরাজিতে এক আবেদন আছে এবং পাগলামি গুলো বাদ দিলে সে যে অসাধারণ প্রতিভাশালী সেটাও সবাই একমুখে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু জীবনসঙ্গী রুপে জন, তাও সবিতার সঙ্গে। অমৃতের বুকটার হামহাম করে উঠল। সবিতাকে দেখলেই তার কিছু একটা হত। ভালোই হল সে তার মনের কথা কাউকে বলল না। জন না হয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে যদি ঘটনাটা ঘটত তাহলে তো সে নিশ্চয় মনে মনে চুপ করে থাকত না । ঠিক তখনই একটা মিলিটারি চেকপোস্ট থেকে টর্চের তীব্র আলো এসে ওদের সবার চোখ মুখ ধাঁধিয়ে দিল, একজন তীক্ষ্ম হুইসেল মেরে ওদের থামার নির্দেশ দেওয়ায় লোহিত গাড়িটা থামিয়ে দিল।

  • * * *
    পুলিশ যে ওদের খোঁজে তার ভাড়া ঘরে এসে পৌঁছাবে তা প্রফুল্ল ভাবতেই পারেনি। এমনিতেই সে ধর্ম সংকটে পড়েছিল। সে গুয়াহাটিতে থাকে বলে জনদের বিয়ের জন্য উকিল ঠিক করা, থাকার জায়গা ঠিক করা, সমস্ত দায়িত্ব তার উপরে পড়েছে। এদিকে সবিতার বাড়ির সঙ্গে ওদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। সবিতার মা-বাবা তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে। তারা যখন জানতে পারবে সবিতার এই কাজে সেই প্রধান সহায়ক, সেই ওদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, কোর্ট রেজিস্ট্রেশনে সাহায্য করে এমনকি মেয়ের পক্ষ হয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে, তখন ওরা তাকে কী বলে ভাববে? অন্যদিকে জন তার শৈশবের বন্ধু। তার সব পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দেয় না, এইক্ষেত্রে জনের খুব একটা ভুল আছে সে কথাও সে বলতে পারে না। যদিও সে প্রেমে বিশ্বাস করে না অনেক অনুনয়ের পরেও যদি ভালোবাসার মেয়েটিকে বাড়ি থেকে অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে তো এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে এবং বন্ধু হিসেবে প্রফুল্লদেরও তাকে সাহায্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। সম্পূর্ণ ঘটনাটাই ছোটখাটো থ্রিলারের মতো মনে হল তার– সবিতার বেরিয়ে আসা, রেলওয়ে স্টেশনে সিদ্ধেশ্বর হাতে রিভলভার নিয়ে জনকে শিশুপালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, রেলের আশা ছেড়ে পুরোনো ফিয়াটখানায় করে রাতের অন্ধকার অতিক্রম করে গুয়াহাটিতে আসা, সেখানে মিলিটারি চেকিঙে সবিতা প্রসববেদনার অভিনয় করা থেকে শুরু করে আজ গুয়াহাটিতে কোর্ট ম্যারেজ এবং তারপরই নবপরিণীতা পত্নী সহ জনকে পুলিশ ধরে আনা সমস্তটুকু।
    শেষে অবশ্য সবিতার জবানবন্দি, বয়সের সার্টিফিকেট ইত্যাদি পাওয়ার পরে পুলিশ ওদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
    এখন জন-সবিতা দুজনেই সুখী, কেবল মনটা খারাপ লাগছিল অমৃত এবং প্রফুল্লের আলাদা আলাদা কারণে, পুলিশ চৌকিতে সিদ্ধেশ্বর প্রফুল্লের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাওয়া ছাড়া অন্য কিছু বলেনি। হয়তো দুদিন পরে জন, সবিতার কাছে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবিতা, জনের দুজনেরই বাড়ি নিজের জামাই- বৌমাকে সাদরে বরণ করে নেবে, কিন্তু সবিতার বাড়ি যে প্রফুল্লের এই বিশ্বাসঘাতকতাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে তা মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল ।
  • * * *
    রেলস্টেশনে বিদায় দেবার সময় যোগেন বারবার রূপনাথকে আবার লেখা আরম্ভ করতে উপদেশ দিয়েছিল। জানালা দিয়ে রেলপথগুলির গতি লক্ষ‍্য করে সে পুনরায় একই কথা ভাবতে লাগল। মানুষের কোনো কৰ্মই চারপাশের পরিবেশ থেকে মুক্ত নয় । কিন্তু এই পৃথিবীতে নিজের সঙ্গের অন্তরঙ্গ একজনেরও চিন্তাধারার প্রকৃত রূপটি একজন জানতে পারেনা। প্রত্যেকেইতো প্রতিটি সময় আলাদা আলাদা কাহিনিতে পৃথক পৃথক ভূমিকা নিয়ে আছে, একজন মানুষ এই একটি কাহিনিতে হয়তো নায়ক হয়ে রয়েছে, কিন্তু অন্য একজনের কাহিনিতে তিনি খলনায়্‌ক, কারও কাছে হয়তো বহুরূপী, কারোর শুভাকাঙ্খী, গোড়া বিহীন পরজীবীর মতো প্রত্যেকের নানা কাহিনি এগিয়ে চলেছে। কোনো ভালো-মন্দ লক্ষ‍্য না করে এবং শেষ না করেই। একটা কাহিনির সৃষ্টি সে কীভাবে করবে যদি তার প্রকৃতই কোনো শেষ না থাকে, কোনো বিশেষ আরম্ভ আছে বলেও বলা যায় না। এরকম সত্যের প্রতি অনুরাগ হলে কাহিনির সৃষ্টির পরিকল্পনাই বৃথা এবং তার থেকে একটা নীতিকথার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা তেমনি হাস্যকর কথা। আগে এই সমস্ত চিন্তা মনে আসেনি বলে সেই কিছু একটা ভেবে লিখতে শুরু করেছিল। শেষ করতে পেরেছিল। কিন্তু সেইসব শেষ কি আসলে শেষ হয়? তারপরও বহু ঘটনা ঘটতে পারে?And they lived happily even after কেমন মিথ্যা কথা এটা?
    এখন সেই জন্যই তার জন্য লেখা কাজটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে বর্তমানে তার রেলের কামরাটির ঘটনাগুলি লিখতে পারে কিন্তু সেটি তার নিজের বাইরে তার পাশে বসে থাকা জনের বিষয়ে কিছু জানে, প্রদীপ নিজের কাহিনিই বা কী? ওরা কী ভাবছে? সেইসব না জেনে তাদের বিষয়ে লিখলে কি সেই প্রকৃত অর্থে কথাগুলি ফুটিয়ে তুলতে পারবে ?– না পারবেনা ।
    তার এই যাত্রাটি বিষয়ে সে লিখবে কি? এখানে লেখার মতো আর কি থাকল? বন্ধু যোগেনের বারংবার অনুরোধে সে যোগেনের কাছের প্রতিবেশী একটি মেয়েকে দেখতে এসেছিল। সে ভেবেছিল এবার বিয়েটা করা যেতে পারে না হলে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে করে মানুষ কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলবে। কিন্তু সে দেখতে যাবে শুনতে পেয়েই মেয়েটি তার প্রেমিকার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। রূপনাথ মেয়েটিকে দেখতেই পেল না। যোগেন বেশ লজ্জা পেল। মেয়েটি কাজটা না করলে হয়তো মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত, তখনও হয়তো মেয়েটি সুখীই হত। না হতেও পারে। সেই কথাটিই মেয়েটি যে ছেলেটির সঙ্গে পালিয়ে গেল তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভালোবাসা নামের জিনিসটা যে সারা জীবন একইভাবে ভালবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারে রূপনাথ তা বিশ্বাস করে না। কিন্তু এসব কি একটি কাহিনির সম্বল হতে পারে? তারমতে পারে না।
    রেলগাড়িটি এসে একটি জংশন পেল। রূপনাথের মনে হল বহু দিক থেকে বহু রেলপথ এসে জংশনটির বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং কয়েকটি যুক্ত না হলেও একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে।
    ——–
    লেখক পরিচিতি -১৯৭৬ সনে অসমের গুয়াহাটি শহরে ভাস্কর ঠাকুরীয়ার জন্ম হয়। পেশায় চিকিৎসক শ্রী ঠাকুরীয়া বর্তমানে অল ইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স ,পাটনার মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক।‘যাত্রা’লেখকের অন্যতম গল্প সংকলন।‘সিংহদ্বার’ উপন্যাসের জন্য শ্রী ঠাকুরীয়া মুনীন বরকটকী পুরস্কার লাভ করেন। অসমের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখকের গল্প প্রকাশিত হয়ে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।