সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (অন্তিম পর্ব)

গ্যাস চেম্বার

অন্তিম পর্ব

– তুই কি উন্মাদ হয়ে গেছিস? মুহুর্তের মধ্যে শিথিল হয়ে গেল রণজয় । আমি বােঝাতে পারলাম না, ভূপাল আসলে একটা মানসিক অবস্থার নাম। যার মধ্যে পড়লে মানুষের আর বেরােবার উপায় থাকে না। রণজয় বলল, আমি ক্লান্ত । আর সত্যি নিতে পারছি না । আমি বললাম, আমিও। বলে আবার আদর করতে শুরু করলাম রণজয়কে। আমার শরীরে কোথাও একটা চাপ লাগছিল । তবুও ওকে আমারই তৈরি করা ফাঁদ থেকে বের করতে চাইছিলাম । রণজয় আবারও জেগে উঠল । শরীরের নিয়মেই । আর এইবার শেষ স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছল আমাদের ভালােবাসা। সেই মুহুর্তেও আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সব তরল ট্যাঙ্কের ভেতর ঢুকে তাপ সৃষ্টি করেছিল বলেই, তরল বদলে গিয়েছিল গ্যাসে । আচ্ছা পেটের ভেতর যে আছে সেও তাে জলেই আছে? জলটা যদি গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে যায় কীভাবে বাঁচবে সে? রণজয়, সব কিছু পাওয়ার ক্লান্তিতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে আলগা হয়ে শুয়ে পড়ল। আর বহুদিন পর অনেকটা তৃপ্তি আর একাগ্রতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাথরুমে গেলাম। বাথরুম থেকে সােজা হেঁটে গেলাম কিচেনে । ভার্মা যেরকম দৃঢ়তার সঙ্গে ট্রেনটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেরকমভাবেই গ্যাসের নবটা অন করে দিলাম । – কী বলছ সুলগ্নাদি? শিউরে উঠলাম। – আমাকে দিযে কেউ পুরােটা করিয়ে নিল জানিস। আমার সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল ইউনিয়ন কারবাইডের লাভে রনজযের যেরকম শেয়ার আছে, এই ক্ষতির মধ্যে আমার শেয়ার আছে । ইউনিয়ন কারবাইডের লাভটা রণজ্য ভােগ করেছে। তাহলে অত মৃত্যু, অত ক্ষত, অত কান্না আমি ভােগ না করে যাই কোথায় বল তাে! আমিও তাে একজন শেয়ারহােল্ডার। – তারপর? – গ্যাস অন করে চলে এলাম । রণজয় শুয়ে ছিল । টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বড় সিগারেট বের করে ওর ঠোঁটে দিলাম । আর রান্নাঘর থেকে নিয়ে আশা দেশলাইযের বাক্সটা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখলাম। রণজয় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, কী করছ?
– অনেকদিন তােমাকে সিগারেট খেতে দেখি না। – কিন্তু এখন, তােমার সামনে খাওয়া উচিত না । রণজয় বলল। – তুমি খাও তাে । তােমাকে সিগারেট খেতে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।। রণজয় সিগারেটটা ঠোঁটে নিয়ে বলল, আমি আমার ওপরে সমাজের কোনাে মালিকানা আছে, স্বীকার করি না । আমি বললাম, আমার ওপর তােমার আর তােমার ওপর আমার মালিকানা স্বীকার করাে তাে? – করি। কারণ সেটা ইমােশনাল ওনারশিপ । রণজয় একটু জোর দিয়ে বলল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আবেগেরই মালিকানা হয়। সেই মালিকানায় তুমি যদি আমাকে বাঁচাতে চাও, আমি তােমায় মারতে পারব না কেন? আলাদা করে তাে মারছি না, সঙ্গে নিয়ে মরতে যাচ্ছি। রণজয় আমার ফিসফিসানি খেয়াল করল না। বলল, কীসের একটা গন্ধ লাগছে? – এটা ঘামের গন্ধ, রক্তের গন্ধ, আমাদের না জন্মানাে বাচ্চার গন্ধ । তুমি গন্ধটা ফিল করাে । আমার বুকের মধ্যে ফিল করাে রণ । আমি ওর গালে ঠোট ঘষতে ঘষতে বললাম । রণজ্য সিগারেটটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে আমার বুকের মধ্যে মুখ ডােবাল । তারপর মুখটা তুলে আবার সিগারেটটা ঠোঁটে নিল । আমি দেশলাই বাক্স থেকে একটা কাঠি বের করে রনজয়ের দিকে তাকালাম । রণজয় বলে উঠল, গন্ধ একটা পাচ্ছি কিন্তু । আমি বললাম, ওই গন্ধটাই তাে জীবন । গন্ধটাই বিশ্বাস । তারপর কাঠিটা ঘষে দিলাম বাক্সে…
৫ই মার্চ:
কলকাতার রাস্তা
সুলগ্নাদি মারা গেল ওর জন্মদিনের পরপরই, ১লা মার্চ । জন্মদিনের দিন আমাকে একটা অদ্ভুত অনুরােধ করেছিল সুলগ্নাদি । – শােন বাবা তাে অথর্ব । আর ভাই কোনও দায়িত্ব নেবে না। তুই একটা কাজ করবি আমার? আমি মরে গেলে আমার ছাইটা…
– গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হবে? আমি আলটপকা বলে ফেললাম।
– না । তুই একবার আমার ছাইটা নিযে ভূপালে যেতে পারবি? টাকা আলাদা করেই রাখা আছে আবিরার কাছে। ও জানে আমার ভাগের টাকাগুলাে কীভাবে কোন কোন সংস্থায় ডােনেট করতে হবে । আর তাের যাওয়া আসার খরচের কথাও ওকে বলে রেখেছি … তাের কোনাে অসুবিধে হবে না । আমি কিছু বলতে না পেরে তাকিয়েছিলাম পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়া সুলগ্নাদির দিকে । – ভূপালে গিয়ে যেখানে ইউনিয়ন কারবাইডের কারখানা ছিল তার আশেপাশে কোনাে ঝিলে, কিংবা ওই মাটিতেই আমার ছাইটা মিশিয়ে দিস । আমি ওখানেই থাকতে চাই। বললাম, মরে যাবে ভাবছ কেন, তুমি বাঁচবে তাে! – অবশ্যই বাঁচব । ওই মাটির মধ্যে থেকে যে নতুন গাছটা উঠবে, ওই বিষ অগ্রাহ্য করে যে চারাটা উঠে আসবে তার পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে, আমিই তাে বাঁচব। আমরা সবাই তাে সবকিছুর জন্য দায়ী। তাই সবকিছুর ওপর অধিকারও আমাদের সবার ।
সেই সুলগ্নাদির বলা শেষ কথা।
আমি ওর চিতাভষ্ম ভূপালে নিয়ে যাওয়ার পারমিশন পাইনি । তাতে কী? অনুভব করি যে, সুলগ্নাদির কথাটাই সত্যি। ভূপাল ইজ আ স্টেট অফ মাইন্ড । ভূপাল আসলে সমস্ত ধ্বংসের মধ্যেও সেই স্বপ্নটার নাম, যার সামনে দাঁড়ালে মানুষ ভুলতে পারে না যে সে শুধুই অনেক মানুষের একজন । জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি । মৃত্যুর পরও।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।