সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১৪)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ১৪

কিন্তু অনেকদিন খুব ভালােবেসে ছিলাম তাে ওই বাড়িটায়, গিয়ে যদি আর ফিরতে না চাই? – এসব কি বলছ সুলগ্না? – তুমি যা শুনতে চাইছ না । তুমি আমাকে কোনােদিন চাওনি শৌনক । তুমি আসলে চেয়েছিলে একটা ট্রফি । একটা বিউটি কুইন । আর সেই বিউটি কুইনের ভেতরে যে অসুখটা ছিল, যে মানুষটা ছিল, সেই মানুষটাকে তুমি সহ্য করতে পারােনি। – আমি তােমাকে ভালােবাসিনি? শৌনক জিজ্ঞেস করল । – ভালােবাসলে আমার ভেতরের মানুষটাকে ভালবাসতে । কারণ আমার ভেতরের মানুষটাই হচ্ছে আমার অসুখটা । তুমি কোথাও ভেবাে না যে তুমি কমপেনসেশন নিযেছ বলে আমার কাছে খারাপ হয়ে গেছ । ইউ ডিজার্ভ ইট । এভরি পেনি। কিন্তু তুমি আমার অসুখটা ডিজার্ভ করাে না শৌনক । আমার অসুখটা, যে আমায় ভালবাসে সে ডিজার্ভ করে । – রণজয়দা ভালােবাসে তােমার অসুখটাকে?
শৌনকের প্রশ্নটার উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে এলাম । কিছুদিন আগে হলে বলতাম, হ্যাঁ। এত দিনে একজনকে পেয়েছি যে বাসে। কিন্তু আজকের রণজয় রেগে না গেলেও স্পষ্টতই বিরক্ত হচ্ছে আমার ব্যবহারে । ওর মনে হচ্ছে কোথেকে আমি মশা মাছির মতাে দুশ্চিন্তা এনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি আমারই মধ্যে, আর সেই দুশ্চিন্তাগুলাে আমাদের অনাগত সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমাদের ভালােবাসাবাসি, ম্লান করে দিচ্ছে … আমাদের যৌথ জীবনকে এবড়ােথেবড়াে করে দিচ্ছে।
কিন্তু আমার যে মাথার মধ্যে সারাদিন ওই বইটার লাইনগুলাে ঘুরে বেড়ায় । আমি নিজের ভেতরে দেখতে পাই, সাজদা বানুকে যার বর মারা গিয়েছিল প্ল্যান্টে কাজ করতে গিয়ে। নিজের দুই ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে নামা মাত্রই বড় ছেলেকেও হারায় সাজদা, গ্যাসের অ্যাটাকে । আচ্ছা সাজদা বানু না নেমে যদি ওই ট্রেন থেকে আমার মামা নামত! সবসময় মনে পড়ে বি কে শর্মার কথা; সেই স্টেশনমাস্টার রাতের কনকনে ঠান্ডার মধ্যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে যে ট্রেনটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল, আর কাজটা করতে গিয়ে গ্যাসের প্রচন্ড অভিঘাতে নিজেই মরে গিয়েছিল প্রায়। ওঁকে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । এক বন্ধু এসে উদ্ধার করে। ভদ্রলােক ভালাে করে কথাও বলতে পারে না আর । আমার শুধু মনে হয় মিথাইল আইসােসায়ানাইডের কথা । যেগুলাে এখানে তৈরী করে ইউনিয়ন কারবাইড় জমিয়ে রাখত, একটা মস্ত স্টিলের ট্যাঙ্কে । কিন্তু সেই ট্যাঙ্কে গ্যাস রাখার জন্য যা আবশ্যক ছিল সেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ওরা সরিয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল, ভারতের লােক তাে, এত সিকিওরিটি দিয়ে কী হবে !
চুরাশি সালের ডিসেম্বরে ওই ট্যাঙ্কের থেকে গ্যাস হাওয়াতে রূপান্তরিত হয়ে বেরিয়ে এসেছিল । সাধারণ হিসেবেই কুড়ি থেকে তিরিশ হাজারের মধ্যে লােক মারা গিয়েছিল তাতে । কিন্তু আমি পরে মামির থেকে শুনেছি কত মৃতদেহ কেউ ক্লেমই করেনি। গরিবের মৃতদেহ তাে! কে ক্লেম করতে যাবে? তাই আসলে হয়তাে মারা গেছে পঞ্চাশ হাজারের বেশি লােক।পঙ্গু হয়ে গেছে, মৃতবৎ বেঁচে আছে পাঁচলাখের ওপর । লােকগুলাে যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়! বাবার সেই ছবিটার ভেতর থেকে যেভাবে অজস্র হাত, সুজাতার পায়েসটা খেতে চেয়েছিল, এই এতগুলাে মৃত্যু যদি আমার পেটের দিকে হাত বাড়ায়, আমার পেটের ভেতর বেড়ে ওঠা একটা জীবনকে মেরে ফেলতে চায়? আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি বাড়ি না ফিরে ওই দোকানটায় চলে গেলাম, যেখানে এই বইটা পেয়েছিলাম ।
– এই বইটা কত কপি আছে? দোকানদার একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, এককপি । – আপনারা অনেকগুলাে কপি এনে দিতে পারবেন আমাকে? এই বইটার? – কতগুলাে লাগবে বলুন? – অন্তত কুড়িটা ।
সন্দেহের চোখে তাকাল বইয়ের দোকানের মালিক আমার দিকে । বলল, চেষ্টা করব । কেন এতগুলাে কপি চাই বলুন তাে? আপনি কি কোনাে এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত? – ঠিক ধরেছেন। ওই এনজিও’র তরফ থেকেই এই ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে আমরা সচেতনতা গড়ে তুলছি । সেই জন্যই এই বই আমাদের অনেকগুলাে দরকার ।
বেশ কয়েকদিন তাগাদা দিয়ে শেষমেশ চোদ্দ কপি বই পেলাম । আমার শরীর এখন পাল্টে যাচ্ছে। । অতগুলাে বই নিয়ে বাড়ি ফিরতে অসুবিধে হচ্ছিল । তার ওপর রােদের মধ্যে ট্যাক্সি পেলাম না। একটা বাস ধরে, বেশ অনেকটা হেঁটে যখন বাড়ি এলাম, দম বেরিয়ে যাচ্ছিল রণজয় বেশিরভাগ সময়ই ট্যাক্সিতে ট্র্যাভেল করত। আমি ইচ্ছে করলেই ড্রাইভারকে একটা ফোন করে ডেকে নিতে পারতাম, গাড়িটা তাে গ্যারেজেই ছিল। একবার ভেবেছিলাম কিন্তু মনে হল, গাড়িটাও তাে ওই গ্যাসের পয়সায় কেনা। ভাত-ডাল-মাছ খাচ্ছি মন সেখানে একটা ছাড় দে আমায়। কিন্তু গাড়ি চড়ার ব্যাপারে সায় পেলাম না ভেতর থেকে। বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল তাও শুলাম না। হাঁফাতে হাঁফাতে বসার ঘরে ড্রয়িং রুমে যে তাকটা, সেখান থেকে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ- শরৎ-শরদিন্দু জীবনানন্দ-শঙ্খ-শক্তি-সুনীল সব সরিযে এই বইগুলাে রাখলাম শুধু । একটাই বই । চোদ্দ কপি। রাতে বাড়ি ফিরে প্রথমে খেয়াল করেনি রণজ্য । আমার সঙ্গে ডিনার করতে করতে খুনসুটি করছিল । আমি আবার ওই প্রসঙ্গ তুললাম, সমস্ত জলগুলাে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছিল জানাে? আশেপাশের কুয়ো থেকে যারা জল তুলত তারা অনেকে মারা গেল ওই জল খেযে। জলের মধ্যে ক্লোরােফর্ম, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, তামা, নিকেল, সমস্ত কিছু ছিল | আমাদের ঘরের জলটা তাে পরিষ্কার তাই না? রণজয় উত্তর না দিয়ে জলটা খেয়ে বসার ঘরে গেল, তারপর যেভাবে কোনােদিন চেঁচায়নি আমার ওপর, সেভাবে চেঁচিযে উঠল, এই বইটা এতগুলাে কে রেখেছে এখানে? – এই বইটার মধ্যেই তাে সব আছে । এই বইটার থেকেই তাে আমাদের সংসার, আমাদের ফ্ল্যাট, আমাদের গাড়ি, আমাদের পয়সা। আমাদের সন্তান তাে এই বইয়ের মধ্যে যার কথা লেখা সেই গ্যাসেই বড় হবে। আমি ঠান্ডা গলায় বললাম । রণজ্য জবাব না দিয়ে একটা একটা করে বই ছুড়ে ফেলতে লাগল মেঝেতে । আমি বললাম, বইগুলাে ছুড়ে ফেললেই তাে গ্যাসটা যাবে না, গ্যাসটা বাতাসে মিশে আছে । মিথাইল আইসােসায়ানাইড যা নিশ্বাসে মেশার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা পুরাে কালাে হয়ে যায় । রণজ্য আমার সামনে এসে চিৎকার করে উঠল, মিথাইল আইসােসায়ানাইড তুই । এই বাড়ির পুরাে পরিবেশটাকে তুই বিষাক্ত করে দিচ্ছিস । আমি কিছু বললাম না, হেসে উঠলাম।
২৬শে জানুয়ারি
ফাস্ট ট্রিমেস্টার পেরিয়ে যাওয়া পরই রণজ্য বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমি হ্যাঁ বলিনি, না’ও না । শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, আবার সাত পাকে। ঘুরতে হবে নাকি? রণজয় হেসে উঠল, না, লােক হাসাব না । – লােক হাসবে কেন? এটা সমাজেরই একটা প্রথা। তেমন হলে ঘুরতেও পারি । আমি বললাম । – তুই চুপ কর। বিয়েটা করা জরুরি । সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে নিতে হবে ।
রেজিস্ট্রি হল । কিছু বন্ধু বান্ধবকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানােও হলাে। কী আশ্চর্য, দু’চারজন কমন লােকও চলে এল, যারা আমার প্রথম বিয়েতেও এসেছিল । আমার খারাপ লাগল না উল্টে মজা পেলাম! ওরা কী সুন্দর শেয়ার করছে আমার জীবনের দুটো অভিজ্ঞতাই ।
রণজয়ের মধ্যে আমাকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি আমার থেকে জানতে চাইলেন, আপনি কি সবসময়, সবকিছুতে একটা অপরাধবােধে ভােগেন? – কই না তাে । আমার মনে হয় আমরা সবাই সবকিছুর অংশীদার । আমি শুধু আমার জীবনটাই বাঁচি না । অন্যের জীবনের অনেকটা অংশ আমার জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। আমি উত্তর দিলাম । ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, রণজয় নিজেও কি অংশীদার নয় ওই গ্যাস কোম্পানির অনেক অনেক টাকার?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।