আমি ও রবীন্দ্রনাথ
“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে /বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে” -শৈশবটা অধিকার করে নিয়েছিলেন তিনি। সহজ পাঠের কাল তখন। আমাদের বালাগাছির উত্তর জানালার ওপারটাই আমার ভূমন্ডল। যেখানে চোখ রাখলেই গ্রামে প্রবেশের মূল রাস্তা। সারাদিন নানান লোকজনের যাতায়াত। সকালে সবজির ঝুড়ি মাথায় গ্রাম্য রমনীর প্রবেশ। কুমোরপাড়ার গোরুরগাড়ির চাকাগুলো কাঁকর চিবানোর কড়কড় কড়কড় শব্দ নিয়ে সটান ঢুকে যায় গাঁয়ে। টিনভাঙা লোহাভাঙা হাঁসে-পালক চুল-ছেঁড়া সংগ্রহের ব্যাপারি হাঁকতে হাঁকতে সাইকেল নিয়ে পেরিয়ে যায় প্রতিদিন । আসে পাম্প হর্ণের প্যাঁকপ্যাঁক আওয়াজের আইসক্রিম ওয়ালা। যদিও দইওয়ালা প্রবেশ দেখিনি কোনোদিন। রাস্তা ঘেঁসে একটি পদ্মদিঘির কালোজল। পদ্মদিঘির অনতিদূরে আমাদের ছোটো নদী অজয়।গঙ্গার সাথে মিলনের তরে সেও চলে এঁকেবেঁকে, বৈশাখ মাসে তারও হাঁটুজল থাকে। নরম রোদে বালিও চিকচিক করে । কাদাও থাকে না কোনও । এপারের রাখাল ওপারে গোচারণে যায়। হাতে তার বাঁশের বাঁশি। কেমন ভাবে যে আমিও রাখাল সাজি ! সে মগ্নতাও আমাকে পুলকিত করত সারা বিহান বেলা। সায়ন রোদ টকটকে লাল হলে তারা ঘরে ফেরে।এতটা প্রহর তারা কী করে ! বাঁশির ফুঁয়ে কোন বিস্ময় বেরিয়ে আসে ! ” আমার বেলা যে যায়….. “! না না ! তারা তো আপনাকে জানে না ! তবে কোন সুরে কাটে তাদের বেলা ! আমার কৌতূহল মুক্তির তাড়নায় জানালা ফেলে ছুটে যাই মায়ের কাছে।! থমকে যাই। মা যে তখন বিস্তর কাজে মগ্ন ! মা কি আমার আকুতির কাছে দাঁড়াবে এখন ! একটা হতাশা জড়িয়ে ধরে আমার শরীর। হঠাৎই মেজো-মা উনুনের আঁচে কাঠ চাপাতে চাপাতে হাসি-মোড়া চোখ নিয়ে বলে – ” কোনো জিজ্ঞাসা আছে তোমার? ” আমিও পুলকিত আঁখিপল্লবে এক দৌড়ে মেজো-মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি, মেজো-মা আমার উচ্ছ্বাসের টাল সামলে নিলে, বলি – “আচ্ছা মেজো-মা, ওই রাখালরা ওদের বাঁশিতে কী গান বাজায় ! ” জিজ্ঞাসা রেখে মেজো-মার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকি — “সে তো অনেক গানই তারা তোলে,বাবা ! — ” তুমি শুনেছো কোনোদিন! একটা বলো – একটা বলো মেজো-মা ! ” শরীর নাড়িয়ে আমার এই নাছোর আকুতির কাছে পরাজিত হয়ে মেজো-মা সুর ভাসিয়ে দেয় –
” যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার সনে নাই লেনা দেনা
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া, যে নেয় নকল সোনা
সে জন সোনা চেনে না। ”
মেজো-মার কণ্ঠ নিসৃত চিরায়ত সুরটি আমাকে বড়ো বিমর্ষ করে তোলে । আমি ফিরে যাই জানালার কাছে।
এভাবেই কখনও মা, কখনও মেজো-মার কোল থেকে আদায় করেছি বহু চিরায়ত গানের বিস্ময়। গানের সকল কথা যে আমার বোধের কাছাকাছি স্পর্শ করত তা না। কিন্তু সেই সব সুরগুলি আমাকে অন্য এক গ্রহের সন্ধান দিত প্রতি মুহূর্তে।তবে গানের কথাগুলি যে আমাকে আলোড়িত করত না তেমনটিও নয়। সেসব কথার মর্মার্থ বোঝার জন্য সন্ধের গানের আসরের অপেক্ষা থাকতে হত। নিরঞ্জন জ্যেঠু ছিলেন আমাদের ভৈরবী ও ইমন বেলার বন্ধু, সংগীতের কৌশল আয়ত্তে আনার সুদক্ষ কারিগর। কার কণ্ঠে কোন সংগীত আশ্রয় করতে পারে সে নির্ণয় করে দিতেন তিনি। জেঠুর কাছেই রাখতাম আমাকে অবাক করা সেই গানের কথাগুলো -.—
” আমি কী দেখিলাম মরা নদীর চড়ে
সাপের মাথায় ব্যাঙের নৃত্য ময়ূর কেন নাচে রে
চোর গেল চুরি করতে গৃহস্থ পড়ল ধরা……
বাপে আমায় জন্ম দেয় নাই জন্ম দিল পরে
আমার যখন জন্ম হল মা ছিল না ঘরে….. “
সমগ্র সংগীতটি যেন প্রখর গ্রীষ্মের মরা অজয় তীরের উপকথা। জীবন তো নদীর মতোই উত্থান-পতনের গাঁথা।কখনও উত্তাল উচ্ছ্বাস কখনও স্রোতহীন সরণি । খাদ্যশৃঙ্খলে আবদ্ধ দুর্বলের প্রতি সবলের আস্ফালন। ছল-চাতুর্য-এ ভরে থাকা আমাদের আশপাশ। মানুষ তার প্রতিটি ব্যাখ্যায় রাখে নিজেই চেতনায় লালিত বোধের ফলশ্রুতি।আমরা হাঁ-করে শুনতাম সে সব। “আমার যখন জন্ম হল মা ছিল না ঘরে….. ” কেন জানি না একথার সরল অর্থ জানার ব্যকুলতা তাড়া করত আমাকে। জেঠু সহজ ভঙ্গিমায় শুরু করলেন উভচর প্রাণের কথা -প্রায় সব উভচর প্রাণের (কচ্ছপ ও কুমীর) জন্ম কালে তাদের মা তখন ঘরে থাকে না। এই রহস্যময় জন্ম কথা জানা ওই বয়সে এক চরম আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল বৈকি !
আমারও ঘরের বাইরে যাবার মানা ছিল। না, আমার তেমন কোনও অসুখ হয়নি।সুতরাং কবিরাজের কোনো নিষেধ ছিল না। প্রখর গ্রীষ্মে আমাদের নজর রাখার কৌশল, সহজ করার লক্ষে মা, মেজো-মা, বাড়ির বাইরে যাবার নিষেধ রাখতো আমাদের । চোখ আর তর্জনীতে ভয় চাপিয়ে বলতো -‘ ছেলেধারা এসেছে গাঁয়ে ! ঘরে বাইরে যাবে না! ” কোথাও একটা নতুন ব্রিজ হচ্ছে। নতুন ব্রিজে শিশুদের উৎসর্গ করলে, সে ব্রিজ নাকি পোক্ত হয়। স্বভাব নরম আমি, তাদের নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মান্যতা দিতাম। অথচ ওসব ভয় দাদার স্নায়ুতে কোনও প্রভাব বিস্তার করতো না । সক্কাল সক্কাল দৌড় দিত বাড়ির বাইরে। সকলের চোখ এড়িয়ে। বেলার বাড়লেই পাড়াপড়শির নানান অভিযোগ জোগাড় করে ঘরে ফিরতো দাদা। মায়ের তিরস্কারেও নির্বিকার থাকতো । পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো ধুয়ে নিলেই সব শেষ। কিন্তু ভয় এক আগাম কল্পনা হলেও অবাধ্য হবার সাহস আমার ছিল না। প্রিয় জানালাটিই আমার আশ্রয় হয়ে ওঠে । সম্মুখে লালমাটির রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষজনের বিচিত্র আচরণে কখনো হাসতাম কখনো কাঁদতাম, কোনো কোনো চরিত্র খুব আপন হয়ে ওঠতো।পদ্মদিঘি আর অজয় কিনারা পর্যন্ত এক চিলতে মালভূমির মতো পড়ে থাকা ভূমিতে কাশবন আর কয়েকটি বাঁশঝাড়, কুল-বরচির গুল্মে ঢাকা প্রান্তরও এক রূপকথা লিখে দিত । ঋতুর সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায় এদের রূপরঙ্গ। কখনও ধূসর হয়ে ওঠে । আবার শ্রাবণ এলে নদী গর্ভবতী হয় হয়ে ওঠে । দু-কূল ছাপিয়ে যায় উচ্ছ্বাসে। সবুজের ঢেউ বয়ে চলে সমগ্র প্রান্তর জুড়ে। শরতের দোলায় থই থই কাশফুলের দোলায়িত ব্যকুলতা মনন জগতে এক স্বর্গীয় স্পর্শ ছুঁয়ে যায় । অজয় নদে বান এলে সোনার ধানও ভেসে যায়। আমি পূর্ণ হয়ে উঠি আমার এই ভূখণ্ডের বিচিত্র রূপে।
তবে আমাদের এই রাস্তায় কোনোদিন দইওয়ালাকে আসতে দেখিনি। এই পাড়াগাঁয়ে দই কেনার যে কেউ নেই । তবুও গ্রাম ছাড়া এই রাঙামাটির পথটি আমারও মন ভুলিয়ে দেয়। নদীর কাছে যেখানে আকাশ মিশে গেছে সেও আমাকে উদাস করে দেয়। দইওয়ালা আসেনি বলে শ্যামলী নদীর কথা, পাঁচমুরা পাহাড়ের কথা, জানা হয়নি কোনোদিন। তবে এখানেও গাঁয়ের বধূরা পদ্মপুকুর থেকে কলসি কাঁখে জল নিয়ে ঘরে যায়। পরনে তাদের লাল-নীল-হলুদ শাড়ি। গোরুর-পাল চরে বেড়ায় পদ্মপুকুরে পাড়ে অজয়ের তীরে। দইওয়ালা নয়, আমার যে রাখাল হবার ইচ্ছে হয় বড়ো। মালকোঁচা মতো গামছা পরে, মাথায় শতছিন্ন গামছার পাগড়ি, বাহুমূলে বাঁশের লাঠি, হাতের মুঠোয় বাঁশি। দুপুর প্রখর রৌদ্রে ক্লান্ত হলে বটের ডালের চড়ে বাঁশিতে তুলবো চিরায়ত সুর…..
দইওয়ালা না থাকলেও সাদা স্লিভলেস ফ্রক পরিহিতা একজন সুধা ছিল আমার । প্রত্যহ সকালে সে বেতের সাজিভর্তি সাদা-গুলঞ্চ ফুল আর পিতলের ঘটিতে জল নিয়ে , পদ্মপুকুরে সদ্য স্নানে ঘরে ফেরে। প্রতিদিন আমার জানালার দিকে ভেংচি কেটে বলে যায় – ” বাড়ির বাইরে আসতে পারো না ! ” আমি মনের ভেতর হাসি ছড়িয়ে দিই। জানালার ওপারের জগৎটা আমার মনের খুব কাছাকাছি বসে থাকে একারণেই, হয়তো তারা আমার নাগালের বাইরে ! আমি যে এই দূরত্ব সুখেই সুখি। একদিন সুধার কাছে জিজ্ঞাসা রাখি – “তুমি প্রতিদিন ফুল ছেঁড়ো তোমার কষ্ট হয় না ! গাছেদের তো কষ্ট হয় ! ” তীক্ষ্ণ তীরের মতো সুধার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে – ” যত্তসব ! ঢং দেখে বাঁচি না ! ” না ! আমার এই ঢঙের কারণেই হয়তো, আমার সুধা সাদা-গুলঞ্চ ফুলের মালা গেঁথে আমাকে উপহার দেবার কথা ভাবেইনি কোনোদিন …..