Cafe কলামে – আত্মজ উপাধ্যায় (পর্ব – ২২)

বিবাহঃ নারী পুরুষের যৌনমিলনের অনুমতি? – ১২ 

মহাভারতের যুগে, হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনী, ধরা হয় সময়টা খ্রীষ্টপূর্ব ৪ শতাব্দী, লেখক কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস, যিনি নিজেও এই মহাকাব্যের এক চরিত্র। সেই সময়ের, অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্মের কয়েকশ বছর আগে, বিয়ের চল থাকলেও নানা রকম বিয়ে হত। মহিলাদের নিজস্ব কোন পছন্দ অপছন্দ তেমন দেখা যায়না। পিতামাতা যার হাতে সঁপে দেয়, তার সাথেই তার জীবন চলে। এছাড়া দেখা যায়, মহিলাদের নিজেদের কোন দাবি – যেমন উত্তরাধিকার, বিশেষ কোন পেশা, ইত্যাদি খুব লক্ষ্য হয়না। মহিলারা বংশধারা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য গর্ভধারিনী যন্ত্র ও পুরুষের সেবা করাই মূল বিষয় ছিল। সমাজের নিম পেশার চরিত্র, যেমন মৎসগন্ধা, জেলেনি ও নদী র উপর নৌকার মাঝি হিসাবে দেখা যায়।
অর্জুন দ্রৌপদীকে উপার্জন করেছে। মৎসচক্ষু ভেদ করে, নিজেকে সেরা ধনুর্ধর হিসাবে। এদিকে দ্রৌপদী স্বয়ংবর সভা ডেকে সেরা ধনুর্ধরকে বিয়ে করবে। ধনুর্ধর যেই হোক না কেন। ধনুর্ধর ভিখারী বা দ্রৌপদীকে পালনে অক্ষম হলেও। আবার কর্ণ কে নিয়মভেঙ্গে ছাটাই করে দেওয়া হল। নয়ত অর্জুনের চেয়ে কর্ণ কম বড় ধনুর্ধর নয়।
সেকালে এধরণের বিয়ে, বা জোর করে কোন মহিলাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে, বা প্রেম করে গন্ধর্ব মতে বিয়ে, ইত্যাদি হরেকরকম ছিল। মহিলা বিয়ের পর স্বামী ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়না। স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়েছে, এমন ঘটনা আছে।

মহিলাদের কাছে আশ্রয়,যৌনচারণা, ও প্রতিপালক এই ৩টি বিষয় ছিল মূল। মৎসগন্ধা ও পরাশরের ঘটনা থেকে বোঝা যায় পুরুষের কামের সাহায্যে মহিলারা প্রত্যাখ্যান করতনা। আবার বিয়ে হলে, মহিলা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি হয়ে যেত। তাকে যা বলা হত তাই শুনতে হত। যেমন বৌকে বাজি রেখে জুয়া/ পাশা খেলা যেত। বৌকে অন্য কারুর সাথে সহবাস করে বংশের সন্তান উৎপাদন করা যেত। বৌকে মারা, বা বধ করাও স্বামীর ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। ভৃগুরাম তার স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন।
এদিকে প্রতিপালক হিসাবে স্বামী দেখতেন তার স্ত্রীর উপর কেউ অন্যায় করছে কিনা তাহলে সে তার শাস্তির বিহিত করত।
এসব আচরণ দেখে বলা যায় বিয়ে সে যুগে ছিল মহিলারা মালিকানার ছাড়পত্র। মহিলা দাসী, পতি তার পরম গুরু। পতির সেবা করে সতী হওয়া যায়। সতী হলে লোকে প্রশংসা করে।

দ্বাবিংশত্যাধিকশততম অধ্যায়, শ্বেতকেতু-সংবাদ –এ পরিষ্কার লেখা আছে। পান্ডু কুন্তীকে বলছেন,“হে বরাননে! হে চারুহাসিনি! পূর্ব্বকালে মহিলাগণ অনাবৃত ছিল। তাহারা ইচ্ছা মত গমন ও বিহার করিতে পারিত। তাহাদিগের কাআরও অধীনতায় কালক্ষেপ করিতে হইত না। কৌমারাবধি(কৌমারকাল হইতে) এক পুরুষ হইতে পুরুষান্তরে আসক্ত হওলেও তাহাদের শধর্ম্ম হইত না। ফলতঃ তৎকালে ঈদৃশ ব্যবহার ধর্ম্ম বলিয়া প্রচলিত ছিল।“
“উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাহার পুৎত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদা তিনি পিতামাতার নিকট সবিয়া আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহার জননীর হস্তধারণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘আইস, আমরা যাই।’ ঋষিপুৎত্র পিতার সমক্ষেই মাতাকে বলপূর্ব্বক লইয়া যাইতে দেখিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন। মহষি ইদ্দালক পুৎত্রকে তদবস্ত দেখিয়া কহিলেন, ‘বৎস! ক্রোধ করিও না; ইহা নিত্যধর্ম্ম। গাভীগণের ন্যায় স্ত্রীগণ সজাতীয় শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হ্‌ইলেও উহারা অধর্ম্মলিপ্ত হয় না।“

এই এতটুকু গল্পে, যা পাই তাতে, মনে হয়না ধর্ষণ বলে কিছু ছিল। মহিলারা গাভীগণের মত। তাদের কোন সমস্যা নেই। তারা প্রজননের এক যন্ত্র বিশেষ ছিল।
এরপর পান্ডু বললেন কুন্তীকে, ভর্ত্তা স্ত্রীকে যাহা আজ্ঞা করিবেন ধর্ম্মই হউক বা অধর্ম্মই হউক, নারীকে তাহা অবশ্যই প্রতিপালন করিতে হইবে; অতএব আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা তোমার কদাচ কর্ত্তব্য নহে। বিশেষতঃ আমি পুৎত্রমুখদর্শনে নিতান্ত উৎসুক হইয়াছি; কিন্তু স্বয়ং সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ; হে সুন্দরি! এজন্য আমি কৃতাঞ্জলিপুটে তোমাকে কহিতেছি, তুমি প্রসন্ন হইয়া তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ হইতে অশেষ-গুণসম্পন্ন পুৎত্রগণ উৎপাদন করিয়া লও, তাহা হইলে আমি পুৎত্রবানদিগের উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারিব।“ । এবং স্ত্রীকে বহু পুরুষের সাথে যৌনসংগম করার জন্য উপদেশ দিলেন।
তাহলে বিয়ে টা সেযুগে, একেবারেই মহিলাদের ইচ্ছায় ছিলনা। এবং জোর করে যৌনসংগম ধর্ষণ বলেও ছিলনা।

আবার মনুসংহিতা সহ অনেক প্রাচীন গ্রন্থে, ব্যভিচারকে শাস্তি যোগ্য বলে দাবি করেছে।‘আপস্তম্ব ধর্মশাস্ত্র’ নামের স্মৃতিশাস্ত্রে পরকীয়াকে কুকর্ম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অথচ মহাভারতে, প্রচুর ঘটনা আছে নরনারী যৌন সম্পর্ক নিয়ে। অর্জুন পরস্ত্রী ঊলূপীর সঙ্গে অনেক দিন বসবাস করেন এবং তাঁর গর্ভ থেকেই ‘ইরাবান’ নামক পুত্রের জন্ম। নাগকন্যা ঊলূপীর স্বামী তখন সূপর্ণ নামক নাগের কাছে বন্দি ছিলেন। ইন্দ্র ও অহল্যার কথা সবাই জানেন। তাঁদের দু’জনেরই শাস্তি হয়েছিল। অহল্যাপতি গৌতমের অভিশাপে ইন্দ্র হলেন গলিতাণ্ড আর অহল্যা পাথর। দক্ষের সাতাশ জন কন্যার স্বামী চন্দ্র। তিনি গুরুপত্নী অর্থাৎ দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে বহু দিন কাটান। তারারও সম্মতি ছিল। তাঁদের পুত্রের নাম ‘বুধ’। ব্রহ্মার হস্তক্ষেপে বৃহস্পতি তারাকে ফিরে পান।

যাই হোক, বিয়ে আদি কাল থেকে আজ অবধি দাম্পত্য সম্পর্ক, পরিষ্কার ভাষায় নরনারীর যৌনসম্পর্কে একটি চুক্তি। এই চুক্তি ভাংগলে বিয়ে নিজের নিয়মে ভেংগে যাবার কথা।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।