সেই কোন ছোটোবেলায় ভোরে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতো, আর ঘুম জড়ানো গলায় আধো উচ্চারণে ,আমিও মায়ের সাথে সুর করে বলতাম —
“ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে !
ঐ ডাকে
যুঁই-শাখে
ফুলখুকি ছোট রে !
খুকুমণি ওঠো রে !”
একদিন হঠাৎ জানতে চাইলাম — এটা কার কবিতা মা ? রবি ঠাকুরের ? ওই বয়সে আমি জানতাম — দাড়িওয়ালা ওই যে কবি , মা যাঁকে বলে বিশ্বকবি , তিনিই শুধু কবিতা লেখেন —
“কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাবো কবে,
যেটা খুশি সেথা যাবো ভারি মজা হবে !”
সুতরাং কবিতা মানেই ,সেটা নিশ্চয়ই মায়ের প্রাণের কবি রবি ঠাকুরের লেখা । মা ভুল ভাঙিয়ে বললো — নারে ,এই কবিতাটা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। হাঁ করে থাকলাম কিছুক্ষণ ! বিদ্রোহী মানে আবার কি ? আর কি বড় নাম রে বাবা — কবি কাজী নজরুল ইসলাম ! মনে থাকলে হয় ! এর কোনো ছোটো নাম নেই রবিঠাকুরের মতো ? মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো — আমার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাগুলো। আদর করে কোলে টেনে নিয়ে বললো– খুব গরীব বাড়ির ঝাঁকড়া চুলের একটা ছোট্ট ছেলে ছিল। তার নাম ছিল দুখু মিয়াঁ । ছোটোবেলায় ন’ বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলে , একটি দোকানে চা আর রুটি বানানোর কাজ করতো সেই ছেলেটা। সঙ্গে চলতো কবিতা ও ছড়া লেখা । জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও , কবিতা লেখা ছাড়লো না সে । বড় হয়ে সেই ছেলেটাই হয়ে উঠল, কাজী নজরুল ইসলাম– কবি কাজী নজরুল ইসলাম । তাকে সবাই বিদ্রোহী কবি বলে । কেন বলে , বড় হয়ে সব পড়বি আর বুঝবি । কবিগুরুর মতো তিনিও অনেক ছোটোদের কবিতা লিখেছেন , সব শোনাবো তোকে।
সেদিনই প্রথম চিনলাম, জানলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তারপর যত বড়ো হতে লাগলাম , মায়ের মুখে শুনে শুনে, মুখস্থ ও আত্মস্থ হলো সেই কবির ছোটোদের জন্য লেখা এই কবিতাগুলো— প্রভাতী, খুকি ও কাঠবেড়ালী ,খাঁদু-দাদু , ঝিঙেফুল ও লিচু-চোর।
দিনের শেষে সন্ধ্যায় ,শাঁখ বাজিয়ে ঠাকুরের সামনে হাত জড়ো করে, মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমি ও ভাই উচ্চারণ করতাম তাঁর ‘প্রার্থনা’ কবিতা—
“আমাদের ভালো কর হে ভগবান ।
সকলের ভালো কর হে ভগবান ।।
আমাদের সব লোকে বাসিবে ভালো
আমরাও সকলেরে বাসিব ভালো ,
রবে না হিংসা -দ্বেষ , দেহ ও মনের ক্লেশ
মাটির পৃথিবী হবে স্বর্গ সমান–
হে ভগবান।।
জ্ঞানের আলোক দাও হে ভগবান !
বিপুল শক্তি দাও হে ভগবান ।।”
শিশুর মনোজগতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল যে কবির — তাঁকে ও তাঁর কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে প্রবেশ করে , হৃদয়ে দোলা দিল পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত এবং বহির্ভূত তাঁর লেখা যে কবিতাগুলো , সেগুলি হলো — মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম , সংকল্প(দেখব এবার জগৎটাকে), কুলি-মজুর, জীবন বন্দনা , চল্ চল্ চল্ , ছাত্রদলের গান, বাংলাদেশ ও কান্ডারী হুঁশিয়ার । আমার রক্তে দেশপ্রেমের , বিদ্রোহের ও সম্প্রীতির বীজ বপন করলো এইসব কবিতা। স্বাধীনতা দিবসের দিন সকালে স্কুল প্রাঙ্গণে তেরঙ্গা পতাকা নিচে দাঁড়িয়ে ,চল্ চল্ চল্ অথবা কান্ডারী হুঁশিয়ার আবৃত্তি করতে যতটা গর্ব অনুভব করতাম , উত্তেজনায় কাঁপতাম , পৌঁছে যেতাম পরাধীন ভারতের আপোসহীন সংগ্রামের কাছে — আজও ঠিক ততটাই আবেগবিহ্বল হয়ে যাই যখন নিজে আবৃত্তি করি অথবা ছাত্রীদের সঙ্গে আমিও মনে বলতে থাকি অথবা ওদের গলায় সমবেত ঝঙ্কার শুনি —
“কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার
পাষান-বেদী ….”
কৈশোর শেষে তরুণী আমি সিলেবাসের নিয়মমাফিক পড়ার অবসরে , নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ একদিন চমকে উঠলাম ‘সাম্যবাদী’ কবিতা পড়ে ! এক নিঃশ্বাসে পড়লাম , ঠিক পরের কবিতাগুলো —ঈশ্বর ,মানুষ ,পাপ ,বারাঙ্গনা ও নারী।পরপর বেশ কয়েক দিন পড়ার পর , ঘোরের মধ্যে অনুভব করলাম , দরিদ্র অসহায় মানুষের আর্তস্বর এবং বর্ণ, ধর্ম ও লিঙ্গের প্রাচীরভেদ কবিকে কতটা আহত করেছিল বলে , এই কবিতাগুলির জন্ম হয়েছে ! কয়েকমাসের মধ্যেই অনেকবার পড়তে পড়তে মুখস্ত করে ফেললাম সব কটা কবিতাই । প্রকাশ্যে আবৃত্তি করা ছাড়াও ,এই কবিতাগুলি হয়ে উঠলো আমার অন্তরের সম্পদ। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ভুলে , নিজেকে সমাজের একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে তৈরি করার প্রেরণা পেলাম। সাহিত্যানুরাগী ও সংস্কৃতিমনস্ক আমার মা, আমার বিয়ের দিন , বিবাহবাসর সাজিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের ও নজরুলের কবিতার লাইন দিয়ে। সংসার জীবনে প্রবেশের মুখে সাদা দেওয়ালে , তুলিতে লাল রঙের আলতা দিয়ে , মায়ের হাতে লেখা নজরুলের সেই উদ্ধৃতি আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে —
“কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে , শক্তি দিয়াছে , বিজয়-লক্ষ্মী নারী ! ”
ক্রমশ জীবনবোধের গভীরে প্রবেশ করে জানতে পেরেছি ও আবিষ্কার করেছি প্রেমের কবি নজরুলকে । তাঁর লেখা প্রেম-বিরহের মধুর উপাখ্যান ,আলো করে রেখেছে বাংলার কাব্য ও সঙ্গীত জগতকে । তাঁর রচিত প্রায় তিন হাজার গান, আটশো কবিতা, তিনটি উপন্যাস ও আঠারো উনিশটি গল্প , তিরিশটি নাটক-নাট্য বিচিত্রা ও প্রায় একশোটি প্রবন্ধ- অভিভাষণ-আলোচনা-সমালোচনা নিবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে ও আমাদের অন্তরকে সমৃদ্ধ করেছে। দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি , যিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবিও বটে , সেই চির-দুরন্ত দুর্মদ ,কভু প্রশান্ত কভু অশান্ত , সুর-সৈনিক কবির উদ্দাম বিপ্লব তরঙ্গ ধ্বনিত হয়েছে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ।এই বছর সেই অসামান্য কবিতা ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষে পদার্পনের শুভ মুহূর্তে , প্রণাম জানাই সাম্যবাদের ও সম্প্রীতির কবিকে।
আজও সর্বহারার মিছিলে পা মিলিয়ে সমস্বরে যখন বলে উঠি —
“জাগো—
জাগো অনশন বন্দী ওঠো রে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত !
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি’
হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত বাণী ,
সব জনম লভি’ অভিনব ধরণী
ওরে ওই আগত…”
‘ অন্তর- ন্যাশনাল-সঙ্গীত’ -এর অনুবাদক কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মনে-মনে স্যালুট জানাই ,আমার হৃদয়ে বিপ্লবের তুফান তোলার জন্য। তাঁর কবিতার ভাষাতেই চিৎকার করে বলি —
“প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ !”
আজকের এই দুঃসহ যন্ত্রণার দিনে ,আতঙ্কের মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষাতেই একমাত্র প্রার্থনা জানাই —
“দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ
দাও দাও প্রাণ।
দাও অমৃত মৃত জনে,
দাও ভীত – চিত জনে শক্তি অপরিমাণ
হে সর্বশক্তিমান।”