শনিবারের চিঠি – তে অনিন্দিতা শাসমল

তোমাকে লিখছি, মনাদা..

গ্রামের কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে যেখানে বড় রাস্তায় মিশেছে, সেই মোড়েই তোমার সাজানো বইয়ের স্টল ছিল।
আসা-যাওয়ার পথে সাইকেলের ব্রেক আপনা থেকেই থেমে যেত;
ওখানে দাঁড়িয়েই একের পর এক পাতা উল্টে দেখতাম সায়েন্স রিপোর্টার , কর্মসংস্থান ,কর্মক্ষেত্র । নতুন পত্রিকাগুলো তুমি বাড়িয়ে দিতে একটার পর একটা আর আমার মত সব বেকারদের মনে সাহস যোগাতে।
কত পরীক্ষার ফর্ম এগিয়ে দিয়েছো !
পরীক্ষা শেষে কৃতকার্য বা অকৃতকার্যতার খবর তোমাকেই দিয়েছি মনাদা। এসএসসি লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে ইন্টারভিউ দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার না পাওয়া আমি অস্থির হয়ে উঠেছি মনে মনে ; তুমি সাহস দিয়েছো, সঙ্গে নিয়ে গেছো একশো কুড়ি কিলোমিটার দূরের অফিসে খোঁজ নিতে।

তোমার কাছে আমার আজীবনের ঋণ। চাকরি পাওয়ার পর আমাকে তুমি বলেছিলে — কেশিয়াড়ি মন্দিরে পুজো দিয়ে এসো একদিন ,আমি তোমার জন্য মানত করে রেখেছি। চোখের জল চেপে রাখতে পারিনি সেদিন মনাদা।বাড়ি ফিরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। অনাত্মীয় কেউ এত মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারে ? এত ভালোবাসতে পারে ?
ঈশ্বর অবিশ্বাসী আমি নিজের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে যাইনি পুজো দিতে।তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম সেদিন,গেছি — পাছে তুমি কষ্ট পাও!
আমার বিয়েতে সারাদিন কী পরিশ্রমটাই না করেছো মনাদা !
তোমার ওই একটুকরো দোকানের রোজগার থেকে একটা সোনালী রঙের কী সুন্দর ঘড়ি উপহার দিয়েছিলে ! আমি খুব বকেছিলাম তোমায়; মনে মনে খুশী হয়ে রোজ পরে যেতাম স্কুলে। হাতে চোখ পড়লেই মনে পড়ে যেত তোমার দেওয়া সাহস আর উৎসাহ।
জানো মনাদা, তোমাকে কোনোদিন হয়তো বলতে পারতাম না — সেই ঘড়িটা মেয়েকে নাচের ফাংশনে পৌঁছে দিতে গিয়ে হাত থেকে খুলে পড়ে গেছে ! পাগলের মত খুঁজেছি, পাইনি ।
তোমার শেষ স্মৃতিচিহ্নটাও যত্ন করে রাখতে পারলাম না ! আমার অক্ষমতার জন্য ধিক্কার দিয়েছি নিজেকে।
স্বার্থপর আমি ধীরে ধীরে তোমাকে যখন ভুলতে বসেছি ,কর্মময় জীবনের ব্যস্ততায় —
মায়ের ফোন এল একদিন,মনাদা আর নেই। ভোজনরসিক মনাদা কারোর চাকরি পাওয়ার খুশিতে নিজে খাওয়াতো তাকে ভালো রেঁস্তোরায় নিয়ে গিয়ে। সে হঠাৎ—
আমার বাড়ির কাছেই নার্সিংহোমের বিছানায় নাকি তোমার চিরশান্তির শেষঘুম।আমি একবার খবর নিলাম না তোমার ?
তোমাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পেলাম না ?
বছরে একবারও যদি খড়্গপুরে যাই ,তোমার দোকানের পাশ দিয়ে, যাওয়ার সময় আজও স্কুটির গতি আপনা থেকেই কমে আসে; অজান্তেই ব্রেক কষে দিই। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা তোমার দোকানের জং ধরা সাটারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পাই ….
এ পৃথিবী একবার পায় তারে,পায়নাকো আর ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।