• Uncategorized
  • 0

ARTICLE 15 – Film Review

বছরে এমন কিছু ছবি তৈরি হয় যা মনের গভীরে এমনভাবে দাগ কাটে যে বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হলেও সেই ছবি আমাদের জন্য শেষ হতে পারে না। অবশ্যই সেটা ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা হবে। এ বছরের ১০মাসেও বহু সিনেমা তৈরি হয়েছে আর বহু সিনেমা দেখেছি কিন্তু যে কটা সিনেমা মনের বুক পকেটে বন্দি থেকে গেল তার মধ্যে অন্যতম হল পরিচালক অনুভব সিনহার ‘আর্টিকেল ১৫’। অনুভব সিনহার ‘তুম বিন’ বা ‘রা ওয়ান’ সিনেমাগুলো দেখার পর কখনোই আমি তার কাছ থেকে এরকম সিনেমা আশা করিনি।
যদি কেউ এককথায় উত্তর দিতে বলে যে সিনেমাটি কেমন লাগল ‘পারব না।’ সোজা কথা “বলতে পারব না।” কেন বলতে পারব না এর উত্তর অবশ্য জানি না। কারণ, এ বড় অদ্ভুত রকমের অনুভব। সিনেমাকে তো শুধু আর সিনেম্যেটিক আর টেকনিক্যালি দিক দিয়ে যাচাই করলে হবে না, দেখতে হবে ফিল্মমেকার এর মাথার ভেতরের কাহিনিকে, তার বক্তব্য কী সেটাই ভাবার বিষয়, ঋত্বিক ঘটক বারবার বলতে চেয়েছিলেন, “সিনেমা কোন বিনোদন নয় বরং হাতিয়ার হয়ে উঠুক”।
তাই শুরু থেকে একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।
ভারতের মতো একটা বিশাল (আয়তনে নয়) গণতান্ত্রিক দেশের চালিকা শক্তি কিন্তু কোন মানুষ বা কোন দলের কাছে বা কোন ধর্মের কাছেও নেই, বরং এই চালিকা শক্তি প্রদান করে ৩৯৫ টি আর্টিকেল, ১২টি শিডিউল, ১১০০০ এরও বেশি শব্দ দিয়ে সাজানো একটি পবিত্র গ্রন্থ যাকে আমরা ভারতীয় সংবিধান বলে জানি। সেই সংবিধানের আর্টিকেল ১৫ কে কেন্দ্র করেই একটা আস্ত সিনেমা। আর্টিকেল ১৫ এই দেশকে শেখায় যে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয়র এই দেশে সমান অধিকার এবং ন্যায় ও সরকার এর কাছেও প্রত্যেক ভারতীয় সমান।
এই বিষয়বস্তুটি যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ভাবার বিষয়, তবুও আমি বিশ্বাস করি ২০১৯ এ দাঁড়িয়ে এখন জাতির বৈষম্য হয়ত অতটা নেই (যে উত্তরপ্রদেশের কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও এতটা তীব্র সমস্যা নয়) বরং প্রখর হয়ে আছে ধর্মের ভেদাভেদ। এমনকি যে মূল সত্য ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সিনেমার গল্প, তাকেও বিকৃত করেছে এক্ষেত্রে (সেটা আলাদা বিতর্কের বিষয়)। তবে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা হওয়ার কারণ নয় কারণ গল্পের শুরুতেই “কাল্পনিক” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপর আসা যাক সিনেমার ভেতরের গল্প নিয়ে। সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় গ্রামবাসীরা কোন এক চাতালে বসে বৃষ্টির মধ্যে নিজেদের লোকসঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত। যদিও হিন্দিতে আমি পক্কই বলা যায় তবে হিন্দির মধ্যে বেশ কিছু উপভাষা আছে যাদের মধ্যে ফারাক খুব বেশি তাই সেইসব উপভাষা বুঝতে একটু কষ্ট হয়, তাও যেটুকু বোধগম্য হল- তা হল ‘আমীর আদমী’ আর ‘হামরা’ এর পার্থক্য। এই ‘হামরা’ আসলে কারা তা খুব সুন্দর একটা ditailing দিয়ে বোঝানো হয়েছে, লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে পাশে বাবাসাহেবের (আম্বেদকর) প্রতিমা। বৃষ্টির মধ্যেই সারা গ্রামের কিছু কিছু cut to cut শট দিয়ে পটভূমি তৈরি হয়ে গেল। এই ধরনের establishment shot এর বরাবরই ভক্ত আমি। কি সুন্দর গল্পের আভাস দিয়ে দিল। আর তারপরের দৃশ্যেই পরিচালক সাহেব cut করে নিয়ে চলে গেলেন শহরের ঝা চকচকে রাস্তায় টপ শট দিয়ে বব ডিলান এর গানের সাথে IPS অফিসার Aryan এর চরিত্রে আয়ুষ্মান খুরানার গাড়ি যা পাড়ি দিচ্ছে নায়কের মতে “countryside India” এর দিকে। তার সঙ্গী-সাথীর সাথে কথোপকথন দিয়ে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন নিজের জাত এর প্রতি তারা কতটা সতর্ক। ফিল্মমেকার দল খুব সজাগ হয়ে আয়ুষ্মান এর welcome party এর দৃশ্য দেখিয়েছে। কোন আড়ম্বরপূর্ণ red carpet টাইপ করেন নি বরং করেছেন একেবারে উত্তরপ্রদেশ বিহারের গ্রামের সাংস্কৃতিক চরিত্র অনুযায়ী। ছোট ছোট জিনিস গুলো দেখার মত ছিল ওই দৃশ্যে – কেউ খুশি হয়ে গায়ককে বকশিস দেয় ২০ টাকা, আয়ুষ্মান তার জুনিয়র পুলিশকর্মী যাবত-এর প্লেট থেকে পাকোড়া নিতে গেলে যাবত নিজে প্লেট সরিয়ে দেয়। অন্যান্য পুলিশকর্মীরা এসে সিনিয়র অফিসারের সাথে হাত না মিলিয়ে পা ছুঁয়ে প্রনাম করে, এইসব ছোট ছোট জিনিস চরিত্রগুলোকে আরো বাস্তব ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
এই গেলো গল্পের establishment পর্ব।
গল্পের মূল পর্বে এলে দেখা যায় আয়ুষ্মান এর লালগাও তে আসার পর প্রথম কেস পায় এক গাছে দুটি ঝুলে থাকা নাবালিকার দেহ। কি সুন্দর একটা চমকপ্রদ background sound দিয়ে হাল্কা bottom angle shot দিয়ে সেটা দেখিয়েছে। তারপর তো রীতিমত কেসের জল গড়ায় আর সাথে সাথে কাহিনির রহস্যের জাল বুনতে থাকে, এই জালের সুতো গুলো প্রশস্ত হতে থাকে এবং বিস্তার লাভ করে। কিন্তু আমার মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল ছবিটির এই রহস্যের জাল বুনতে গিয়ে ডিরেক্টর লেখক বেশীই টেনে ফেলছেন না তো? নয়ত কি দরকার ছিল আয়ুষ্মান এর বাড়িতে কাজ করতে আসা এমিলি এর নিখোঁজ হতে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩ মিনিট সময় খাওয়ার। কি দরকার ছিল অদিতিকে ওই গ্রামে নিয়ে যাওয়ার। যাইহোক এইসব কিছুর মধ্যে দিয়ে গল্প বলা চলে।
ক্যামেরা তে প্রচণ্ড রকম ফিল্টার ব্যবহার করায় এক আলাদা রকম পরিবেশনে সাহায্য করে। বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্যামেরার খুব ভাল কাজ কিন্তু দু এক জায়গায় ওই ফিল্টার গুলোই সব নষ্ট করে, কথায় আছে কোন কিছুই বেশি ভাল না। তবে খুব যে খারাপ তা নয়। দেখতে এমনিতে ভালই লাগছে। জঙ্গলের দৃশ্য কিংবা রাত্রে গাড়ির লাইটের আলোতে দৃশ্যমান হাসপাতাল আর থানার দৃশ্য, সবকিছুই বেশ ভালো লাগছিল। এক দৃশ্যে অদ্ভুত সুন্দরভাবে ক্যামেরার কাজ লক্ষ্য করা যায়- আয়ুষ্মান অফিস থেকে বেরোলো ক্যামেরা তার গাড়ির জানলার বাইরে থেকে steady follow করলে ক্যামেরা যেন দু ভাগে বিভক্ত হয়, একভাগে বাকি সমস্ত যোগাযোগ আয়ুষ্মান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আর আরেক ভাগে আয়ুষ্মান যেন নিজের জায়গায় স্থির।
অভিনয় নিয়ে আর কি বলব casting খেলেই সব মাত করে দিয়েছে। এই সব পরিপক্ক খেলোয়াড়দের নিয়ে খেললে যা হয় আর কি, ১০০ তে ৯৮ তো পাবেনই। যেমন খুরানা সাহেব তেমনই বাকি চরিত্রে পাওয়া সাহেব, সায়ানি গুপ্তা, আর আমাদের প্রিয় ভগৎ সিংহ, কুমুদ মিশ্রা সবাই যথেষ্ট ভাল। একটা দৃশ্য আছে যেখানে মনোজ পাওয়ার রেগে ছুটে আসে যাবত চরিত্রের কুমুদ মিশ্রা কে মারতে। সেই দৃশ্যে ক্যামেরা যখন তাকে সামনে থেকে ফলো করে কি মারাত্মক ক্যামেরার স্পীড আর পাওয়ার, জির গতি আর স্টাইল সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়েছে আর তার সাথে সাথে চরিত্রের চেহারায় রাগ-এর ছাপ, চোখ ফেরানো যায় না, সেখানে কি বাচনভঙ্গি।
সায়নী সম্বন্ধে আর কি বলব, jolly LLB তেই দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল মেয়েটি কিন্তু তার অভিনয় যে এতটা গাঢ় হতে পারে তা সে প্রমাণ করে দিয়েছে, মুখে খুব বেশি কথা নেই কিন্তু চোখে প্রচণ্ড জেদ এরকম জেদ শেষ কোন সিনেমায় কার চোখে দেখেছিলাম মনে নেই। তার বাচনভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টেছে, সে তাই তো শেষ দৃশ্যে যখন সবাই পূজাকে খুঁজতে জঙ্গলে গেছে তখন তার মুখ থেকে বেরোয় উত্তরপ্রদেশের ভোজপুর অঞ্চলের টান “অ্যা পূজা” এই “অ্যা” ধ্বনি কিন্তু চরিত্রের বাস্তবায়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন সেখানে। শেষ দৃশ্যে জিসানের এনকাউন্টারের পর সঙ্গীতা আর কুমুদ মিশ্রার কান্না টা আমি সিওর অরিজিনাল, কোন গ্লিসারিন ব্যবহার হয়নি। তবে খারাপ লাগল যে জিশান আয়ুব কে খেলার জন্য আরেকটু জায়গা দিতে হত তার চরিত্রের বুনুনিটা ঠিকঠাক হল না মনে হয়, কেমন যেন উড়ো জীবের মত এল আর চলেও গেল কোন ছাপ না রেখে। তবে এই প্রতিবাদী নাসাদকেও শেষে কাঁদিয়ে অনুভব সিনহা তার পক্বতার পরিচয় দিয়েছেন।
সংলাপ খুব সুন্দর সুন্দর ব্যবহার হয়েছে এক্ষেত্রে মনে হচ্ছিল যেন কোন উপন্যাসের চরিত্রের উক্তি। যেমন ধরা যাক উদাহরণস্বরূপ আয়ুষ্মান বলল I WILL “UNMESS” IT, ফোনের ওপার থেকে অদিতি জানতে চায় is there even a word unmess? উত্তর আসে “নয়া word ঢুন্ঢনা পড়েগা, নয়া সোচ লানা পড়েগা।” এই দুটো লাইন কতটা গভীর ভেবে দেখতে হবে। Dialogue এর মধ্যে humour এর মিশ্রন খুব সুন্দর যেমন fuck মানে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। আবার জাতপাত নিয়ে সমস্যা হলে কি চমৎকার একটা ছোট ডিটেলিং আছে সিনেমায় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে। যখনই জাতপাতের কোন case আয়ুষ্মান- এর অফিসে আসে তখন আয়ুষ্মান একটু নাটকীয়ভাবে বাম দিকে ঘুরে বসে (লক্ষ্য না করলে বোঝাই যাবে না), কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে কেন? ভালো করে দেখলে দেখা যাবে তার পেছনের দেওয়ালে দু দিকে দুটি ছবি টাঙানো আছে ডানদিকে আম্বেদকর আর বাম দিকে গান্ধিজি আর মজার ব্যাপার হল গান্ধিজির ছবি তে বাপুজির মাথা নিচের দিকে রয়েছে। আমার ছবিটি ভালো লাগার কারণগুলি এগুলোই। ভালো মন্দ মিশিয়ে ছবি, তবে ভালোর পরিমাণ খারাপ এর চেয়ে বেশি হওয়ায় মন্দ ভুল ত্রুটি সব ঢাকা পড়েছে।
একটা সিনেমা তৈরি হল ২০১৯ এর মতো এক পঙ্কিল সময়ে আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সিনেমা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা জহির করল, একটা নয়, দুটো নয় বরং চার চারটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এই সিনেমাটি। ভারতীয় সংবিধান, ভারতীয় সরকার, এ দেশের আইন, সর্বোপরি এ দেশের মানুষের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নগুলোই আসলে এই সিনেমার মূল্য নির্ধারণ করে।

Anirban Chatterjee – জন্ম তৎকালীন বিহারের অন্তর্গত ‘কয়লার রাজধানী’ নামে পরিচিত ধনবাদ শহরে। প্রাথমিক শিক্ষা ওখানেই হয় পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটির দেশ পুরুলিয়ায় আসায় বাংলা সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে এবং ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণতি পায়। সাথে নানান ভাষার সাহিত্য পড়তে শুরু করে। লেখা শুরু হয় গল্প দিয়ে। ২০০৯ সালে প্রথম লেখা গল্প প্রকাশিত হয় লিটিল ম্যাগাজিনে। ২০১১ সালে আশাবরী প্রকাশনী থেকে প্রথম বই প্রকাশিত হয় “অনির্বাণ”, তারপর “অনুভব”। ২০১৮ সালে অনির্বাণের কয়েকটি কবিতা নিয়ে নতুন ধরার শ্রুটিপাট করার চেষ্টা করেন সতীনাথ ব্যানার্জি ও কয়েকজন আবৃত্তিশিল্পী র দল। সাহিত্যের পাশাপাশি অনির্বাণের নেশা সিনেমা। নিজে একসময় বাংলা সিনেমায় সহ- পরিচালকের কাজও করেছে এবং কয়েকটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিও করেছে। অভিনয় করে জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।