গল্পেরা জোনাকি তে আনোয়ার রশীদ সাগর

 নীরবতা

ছেলেটি যে বাড়ি থেকে বের হলো, আর ফেরার খোঁজ নেই। মা তার পথের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে। গোয়ালে বাঁধা গাভীটি হাম্বা হাম্বা ডাকছে অথচ বাছুরটি লেজ উচিঁয়ে খেলতে খেলতে দূরে চলে যাচ্ছে। আবার তাড়াখাওয়া হুনোমানের মতো দৌড়ে ফিরে আসতে চাইছে।
আমকাঁঠালের পাতাগুলো নীরবে জাগরকাটা মহিষের মতো নড়েই যাচ্ছে।
বৈশাখের এ তপ্তরোদে বৃষ্টি নেই। বিয়াল্লিশ ডিগ্রী তাপ পড়ছে। মনে হচ্ছে এখনই বাতাসে আগুন ধরে যাবে। এতো বৈরি আবহাওয়ার মধ্যেও ছেলেটি অর্থাৎ ইদ্রিস ফিরে আসছে না তো; আসছেই না।
বড়ো ছেলে, ‘মা-আসি ‘ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। জামিলা খাতুন পুলিশের জেরার ভয়ে স্বামী ও ছোটো সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসে রয়েছে চুয়াডাঙ্গার শহর তলির এক অচেনা গ্রামে। এখানেই খাস জমিতে তাদের বসবাস করা হয়ে গেলো আট বছর। অনেকটা স্থায়ী হয়ে গেছে তারা। সংসার ভালোই চলছিল জনখেটে। একটা গাভীও কিনেছে। ইতিমধ্যেই স্বামী শামসুল স্ট্রোক করে অসুস্থ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় ঘরেই পড়ে থাকে।
জামিলা খাতুন উঠানে দাঁড়িয়ে শান্তি পাচ্ছে না। একবার উঠানে, একবার টিউবওয়েলের কাছে, একবার জামগাছতলায় যাচ্ছে আর আসছে।
চরম খরতাপের মধ্যে ইদ্রিস আলি বেরিয়েছে দু’কেজি চাল কেনার জন্য। বাড়িতে চাল নেই,নেই তরিতরকারি। সাতসকালে খাবারের খোঁজে মা তাকে পাঠিয়েছিল রেলস্টেশনে। হয়তো কোনো কাজ করে কোনোক্রমে কষ্টটষ্ট করে শুধু দু’কেজি চাল হলেই হবে। তরিতরকারি লাগবে না,ফ্যানে ভাতে হলেই হবে। তাই ইদ্রিস আলি স্টেশনে গিয়েছে। এদিকে দুপুর গড়িয়ে যায় যায় অবস্থা।
ঈদের সময় বিভিন্ন শহর থেকে হরেক রকমের লোকজন বাড়ি আসছে। রেল স্টেশনে যাত্রীদের দু’একটা ব্যাগ টেনে পৌঁছে দিলেই কিছু টাকা পাওয়া যাবে। সে আশায় স্টেশনের প্লাটফরমের একদিকে বসে থাকে ইদ্রিস। ট্রেন আসতে আরো আধা ঘণ্টা দেরি হবে। আজ সোমবার। সকালে কোনো ট্রেন ছিলো না।এখন প্রায় বারটা বাজে। দূরে কোথাও থেকে খুব ধীরে ধীরে বাতাসের টানে টানে প-অ-অ শব্দ ভেসে আসছে। অপেক্ষামান যাত্রীরা রেললাইনের ধারে এসে ঘাড় বাঁকা করে উত্তর দিকে তাকাচ্ছে। ট্রেন আর কতো দূর, তা দেখার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ হয়তো বিশাল দানবের মতো ট্রেনের সম্মুখটা দেখতে পাচ্ছে।
এক সময় ভো-অ শব্দে স্টেশনে পৌঁছিয়ে ভূস শব্দে নিঃশ্বাস ফেলে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে ‘ভূজভূজ ভক ‘ শব্দ হচ্ছেই। একদিকে লোকজনের গেট থেকে নামার তাড়া অপরদিকে একই গেটে ট্রেনে উঠার তাড়া। ভীড় তো চরম। তবুও উঠতেও হবে আবার নামার যারা তাদের নামতেই হবে। কয়েক হাত দূরেই ইদ্রিস দাঁড়িয়ে থাকে। সেচ দেওয়া মাঠে পতঙ্গের আশায়, স্রোতের অনুকুলে সাদা বকটা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবে ইদ্রিস দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ যদি বলে ব্যাগটা ধরতো বাবা, তাহলেই ইদ্রিসের শান্তি। ট্রেন ছেড়ে দেয়। কেউ তো ব্যাগ বা ব্রিফকেস নিয়ে এগিয়ে এলো না। হঠাৎ ধীরে চলন্ত ট্রেন থেকে একটা মেয়ে লাফ দেয়,মেয়েটি স্লিপ কেটে সামনে ঝুকিয়ে পড়ে। তবে সামনে আনমনে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ইদ্রিসই। সাবরিনা নাম মেয়েটির।
সাবরিনা ইদ্রিসের গায়ের উপর পড়ে এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে যায়। ইদ্রিস গড়িয়ে পড়ে মেঝের উপর। ঝলসিয়ে যায় হাতে কনুইয়ের এক অংশ। সাবরিনা ইদ্রিসকে ধরে তোলে। ক্ষুধার্ত ইদ্রিস হতাশ চোখে তাকায়।
সাবরিনা বলে, আমার ব্যাগটা ধরো।
ইদ্রিস ব্যাগটা ধরে। -ধরতে ধরতেই তার চিহারাটার পরিবর্তন হয়ে যায়। যেন ব্যাগটায় শান্তির ঠিকানা। কটা টাকা পাবে সেই ভেবেই তার আনন্দে ভরামুখ।
সাবরিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঝেড়েঝুড়ে পরিস্কার করে নেয়। তারপর হাত বাড়িয়ে বলে,ব্যাগটা দাও।
ইদ্রিস আবার ফ্যাকাশে চোখে সাবরিনার দিকে তাকায়। হতাশা তার চোখে- মুখে। হয়তো কিছুই পাবে না।
ইতিমধ্যে ট্রেন চলে গেছে। অটোরিকশা বা অন্যান্য যানবাহন ওয়ালাও যার যার মতো ভাড়া নিয়ে চলে গেছে। কয়েক মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। প্লাটফরম থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে অটোরিকশা ওয়ালা। সেখানেও অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। সাবরিনার চোখে চোখ পড়তেই ইদ্রিসের চোখ ছলছল করে ওঠে । যেন আদর করলেই টপটপ করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে।
ঘটনাও ঘটলো তাই। যখন চকচকে নতুন একটা টাকার নোট বের করে ইদ্রিসের দিকে এগিয়ে দেয় সাবরিনা, তখনই চোখের পানি পড়া শুরু হয়ে যায়। সাবরিনা কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা আর একটি টাকার নোটসহ দুটিনোট এগিয়ে ধরে।
কাঁপা কাঁপা হাতে নোট দুটো হাতে নেয় ইদ্রিস।
সাবরিনা শান্তগলায় জিজ্ঞাসা করে, বাড়িতে কে কে রয়েছে?
ইদ্রিস বলে,মা ও অসুস্থ বাবা ।
সাবরিনা আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে, দক্ষিণদিকে সুডাম ফর্সা গোলাপী বামহাতটা উঁচু করে বলে,ওইখান থেকে একটা অটোওয়ালাকে ডাকো।
ইদ্রিস অটোরিকশা ডাকার উদ্দেশ্যে, দৌঁড় দেয় সেদিকে।

অটোরিকশায় চড়ে সাবরিনা নিজেকে গুছিয়ে নেয়। রিকশা চলতে থাকে মাথাভাঙ্গা নদীর ধার দিয়ে। সাবরিনার চোখে পড়ে নদীর মাঝ দিয়ে কিনার পর্যন্ত পানা বেঁধে আছে। প্রখর রৌদ্রে পানার সবুজ পাতা চকচক করছে। চকচকে সবুজ পানার মধ্য থেকে,জিন্সের শার্টপরা নাঈমের শার্ট ধরে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টেনে তুলছে। এটা জিন্সের শার্টপরা নাঈমের লাশ বা মৃতু দেহ। দৃশ্যটি বুড়িগঙ্গা নদীর। অথচ মাথাভাঙ্গা নদীতে চোখ পড়তেই সাবরিনার চোখে ভেসে ওঠে সে দৃশ্য। নাঈম প্রাইভেট পড়িয়ে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু পরের দিন তার লাশ ফিরে এসেছিল।
আজও ধোয়াশা চারিদিকে। দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেটি স্বপ্ন দেখেছিল বড়ো হওয়ার। তার কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু একটা অপরাধ ছিলো, সে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো। এটা অপরাধ না অধিকার তা বলা যাচ্ছে না। যায়ওনি।
অধিকার শব্দটি আপেক্ষিক হলেও। আবেগ তো চলমান। সে আবেগে নাঈম নিজেকে উৎসর্গ করেছিল। হয়েছিল আন্দোলনের মধ্যম গোছের নেতা। আমাদের রাষ্ট্র কল্যাণময় রাষ্ট্র নয়,রাষ্ট্রের অধিকারতন্ত্রে এবং পরিবারতন্ত্রে হারিয়ে যাচ্ছে সাবরিনার মতো এ রকম অনেক মেয়ের স্বপ্নের সাথে হাজারো অসহায় দরিদ্র বাবার সন্তানেরা। সাবরিনা অটোরিকশায় যেতে যেতে এরকম অনেক কিছুই ভাবে। ভাবে ইদ্রিসের কথাও। ছেলেটি বেশ মায়াবী।
সাবরিনার চাকুরী হয়েছে ছ’মাস হলো। পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর। সে ঈদ করতে আসেনি, ট্রেনিং শেষে যোগদান করতে এসেছে ঝিনেদহ জেলাতে। আজ চুয়াডাঙ্গায় পশ্চিমপাড়ায় থাকবে। আগামীকাল ঝিনাইদহে যেতে হবে যোগদান করতে। তবে ঝিনাইদহে যোগদান করলেও বিশেষ কারণে বেশকিছু দিন চুয়াডাঙ্গাতেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।
অটোরিকশায় চলতে চলতে সাবরিনা আবার হারিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে। কতো দিন একসাথে কেটেছে নাঈমের সাথে।
কতো দিন একসাথে কণ্ঠে কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গান করেছে, কবিতা আবৃত্তি করেছে,শুয়ে থেকেছে গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসের উপর,হাত ধরে দু’জনে একসাথে হেঁটেছে কতো পথ! -সে আজ নেই হয়ে গেলো, চলে গেলো না ফেরার দেশে!
অথচ সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকুরীই করতে আসতে হলো তাকে। আগামী পরশু ঈদ। ঈদ পালন করতে হবে চাকরির কারণে ঝিনাইদহে। এই প্রথম তার বাবা-মা-ভাইবোন ছাড়া ঈদ করতে হবে।
তবে ঈদ পালন শেষে, পোশাক পরেই দৌড়াতে হবে এই চুয়াডাঙ্গাতে দায়িত্ব পালন করতে।

চুয়াডাঙ্গাতে দায়িত্ব পালন করতে এসে আবার দেখা হয় ইদ্রিসের সাথে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ইদ্রিস। পুলিশের পোশাক পরা সাবরিনাকে দেখে মনে মনে ভয়ও পায়।
ইদ্রিস বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ে, কাল দেখলাম বুবুডা ভালো মানুষ-আজ দেখছি পুলিশ!
ইদ্রিস একটু একটু করে দূরে সরে যেতে চায়। কয়েক হাত দূরে গিয়ে নিজেকে ঘুরাতে চায় সে। ঘুরে দাঁড়ানোর আগে আর একবার সাবরিনাকে দেখে নিতে যেয়েই ধরা খায়।
-এই শোন,এদিকে আসো। হাত দিয়ে ইশারাও করে সাবরিনা।
ইদ্রিস দৌড়ে পালাতে চায়। তার আগেই পাশ থেকে একজন লোক চিৎকার করে, এই খোকা তোকে ডাকে।
ইদ্রিস ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে, সাবরিনার সামনে জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়।
সাবরিনা হাঁটু গেড়ে ইদ্রিসের সামনে বসে। ঘাড় উঁচু করে ইদ্রিসের চোখে চোখ রেখে বলে,নাম কি তোমার?
-ইদ্রিস।
-অটো চালাতে পারো?
-অটো পাবো কনে?
-আমি তোমাকে একটা অটো কিনে দিই।
ইদ্রিস যেন কানে কম শোনে। ভয়ে ভয়ে বলে, জ্বি?
-তুমি অটো চালাবে?
-জ্বি।
সাবরিনা একটা এক’শ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলে, বাড়ি যাও। আগামী পরশু অটো নিয়ে যাবে।
ইদ্রিস নীরবে অপরাধীর মতো অথবা কৃতজ্ঞতায় ঘাড় নেড়ে চলে যায়। সাবরিনা হাঁসতে হাঁসতে, হাতে থাকা লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে সামনে এগিয়ে যায়।

অটো চালাতে থাকে ইদ্রিস। দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা হয় পরিবারটির। সারাদিন অটো চালিয়ে, যখন হাতে অনেকগুলো টাকা আসে,তখন ইদ্রিস কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য, দেখা করার চেষ্টা করে সাবরিনার সাথে। কিন্তু দেখা হয় না। মনটা তার কখনো কখনো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কেন লোকের দেওয়া অটোরিকশা চালাতে হবে,কেন তিনি অটোরিকশা কিনে দিলেন?
এ সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ইদ্রিসের।
একদিন রাতে ভাত খেতে খেতে ইদ্রিস তার মাকে প্রশ্ন করে, মা ওই পুলিশ বু’ডা আমাকে অটোরিকশা কিনে দিলো ক্যান?
মা কিছুই বলতে পারে না। চুপ করে থাকে। ইদ্রিস মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে থেকে নিজেও চুপ হয়ে যায়। এ বাড়ির সবাইর নীরবতায় ভালো। বড়ো ছেলে মারা যাওয়ার পর কয়েকবার ঝিনেদহের নিজ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। সাংবাদিক বা অন্য কোনো মিডিয়ার সাথে কথা বললে,’ জেলে ভরে দেবো’। পুলিশের বার বার এ রকম গরম বুলিতে ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল পরিবারটি। পরিবারটি হারিয়ে যাওয়ার পর পুলিশও শান্তি পেয়েছিল। পুলিশ উপরের অর্ডারে কাজ করে। চাকুরির কারণে মানবতা এখানে নীরব হয়ে যায়। পুলিশের নিম্ন পদে চাকুরী করে সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তাদের শ্রেণির প্রতি টান থাকলেও,চাকুরী ঠেকাতে নীরবই থাকতে হয়। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ কালচারটি চালু হয়ে আছে,জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর অর্ডারে স্টিমরোলার চালাতে হয়।
হঠাৎ এ রাতেই এ বাড়িতে একদল পুলিশ এসে হাজির হয়। সাবরিনাও আসে। ইদ্রিসকে দেখে সাবরিনাও নীরব হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে তাহলে এটায় নাঈমের পরিবার! ইদ্রিসই নাঈমের ছোটো ভাই?
সবকিছুই নীরব হয়ে যায়। নীরবতায় এখনকার বড়ো কালচার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।