বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যায় যায় অবস্থা। বাড়িটার গেটের তালা, কাছে রাখা চাবি দিয়ে খুলি। ধড়াঙ শব্দে ঠেলে গেটটা ভিতরের দিকে চলে যায়। অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে থাকে দিদি,কিরে এটা কী গ্রামের বাড়ি!
আমি বলি,জ্বী দিদি।
-গ্রামের কোনো ছোঁয়ায় তো নেই !-সেই ছায়াঘেরা গাছগাছালি পুকুরঘাট কোথায়?
বলি,দিদি এখন গ্রাম আর শহর আলাদা করা যায় না। দেখছেন তো,সব পাকাবিল্ডিং, রাস্তাগুলো সবই পিচঢালা।
বলতে বলতে বাড়ির ভিতরে ঢুকি। আমার বাড়িটাও দুইফ্লাটের বিল্ডিং। দিদি ঘরে উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করে,বউমা কোথায়,ছেলেমেয়েরা?
আমি উত্তরহীন চন্দ্রিমার দিকে তাকায়। চন্দ্রিমার মুখটা যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে-অনেক কিছু জিজ্ঞাসাও সে দৃষ্টিতে।
নীরব হয়ে যায় মালতী-দিও। তার চোখে এক ধরনের হতাশাও। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, বিয়ে করিসনি নাকি?
আমি এবারও কোনো উত্তর দিতে পারি না।
চন্দ্রিমা ও দিদির চোখে হতাশা আরো বেড়ে যায়, হয়তো তারা এসেই ভুল করেছে। এ রকমই দৃশ্য ফুটে উঠছে তাদের চোখেমুখে।
বাড়িতে ধুপ নেই, ল্যাম্প নেই। রয়েছে ঝকমকা বিদ্যুতের আলো।
গ্রাম দেখতে এসে সেই তো শহরের মতই খাঁচায় থাকতে হবে?
দিদি এ কথা বলে বেশ অনিশ্চয়তা আর অসংখ্য জিজ্ঞাসাভরা চোখে তাকায় আমার দিকে।
মনে মনে বলি, বিয়ে তো করেছিলাম দিদি। ভাগ্যে সয়নি। সবই কপাল।
এরপর শান্তভাবে বলি,হ্যাঁ করেছি।
আমার কথা শোনার সাথে সাথে যেন স্বস্তি ফিরে পায় দিদি। অথচ আমার মনে হয়,চন্দ্রিমার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
আমি ঠিকমত কোনো উত্তরই দিতে পারছি না।
বিদেশ থেকে দু’বছর পরে বাড়ি এসেছিলাম। মনের মত একটি মেয়েকে বিয়েও করেছিলাম। ছয়মাস বউয়ের সাথে বাড়ি থেকে আবার বিদেশ গিয়েছিলাম।
পাঁচ বছরের সব আয়ের টাকা বউয়ের একাউন্টে পাঠিয়েছিলাম।
একদিন বিদেশ থেকে শুনেছিলাম, বউটা তার এক প্রতিবেশির হাত ধরে,আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই দুঃখ-কষ্ট নিয়ে আব্বা মারা যায়। তারপরও আমি বাড়ি আসিনি,লজ্জা ও সংকোচে। এর কয়েক বছর পর আম্মাও মারা যায়, আমি ক্ষোভে-দুঃখে এবারও বাড়ি আসতে পারিনি।ভুলতে পারি না কষ্টগুলো। কষ্টের আয়করা অর্থ এবং সামাজিক লজ্জা আমাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল।
অনেক বছর শূন্য বাড়িটা পড়েই ছিল।
প্রায় ষোল-সতের বছরপর বাড়ি আসি। এসে ভাবতে থাকি সংসারটা সাজানো দরকার। জীবন তো এভাবে চলবে না। একা একা কিভাবে চলবে?
চলতে হলে সঙ্গী লাগে, সমাজবদ্ধ জীব আমরা।
বিদেশ থেকেও একেবারে চলে এসেছি। এটা তো বাংলাদেশের সমাজ। এখানে একা থাকা যায় না।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করে,মুরুব্বিদের ধরে,বিভিন্ন জায়গায় ঘটক ধরে, একটা বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।
শেষমেষ একটা গরীব ঘরের অসহায় মেয়েকে ঠিক করে ঘটক ও আত্মীয়-স্বজনরা। তাই গিয়েছিলাম শহরে বাজার করতে। মেয়ে দেখতে যেতে হবে।
ঘটকের কথা,বাফু দেখতে গিয়ে কলমা পড়ি দেবুন।
আমারও মনে মনে সে প্রস্তুতি চলছিল।
এরই মধ্যে শহরে গিয়ে নিমাইয়ের সাথে দেখা। তারপরের ঘটনা তো সামনেই।
এতকিছু ভাবতে ভাবতে উঠানে নামছি। দিদিও ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখতে থাকে।
হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, শফিক আমাদের বাড়িটা কোথায় ছিল রে?
আমি জবাব দেওয়ার আগেই চন্দ্রিমা বলে,ওই যে মসজিদের সাথেই হবে।
দিদি বলে,তাহলে পূজাঘরটা?
বলি, সে ঘরের অর্ধেক মসজিদের ভিতর আর অর্ধেক ওজুখানা করেছে ।
দিদির মুখটা পানসে হয়ে যায়। বেশ হতাশ হয়ে পড়ে।
এমন সময় মসজিদ থেকে মাইকে মাগরিবের আযান শোনা যায়।
দিদি উঠানে বসে পড়ে,তাকে এখন বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
আমি ঘরের ভিতরের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে, দ্রুত চন্দ্রিমাকে বলি, একটা চেয়ার এনে দিতে।
এই প্রথম চন্দ্রিমার সাথে কথা বললাম। চন্দ্রিমা তার শাড়ির আঁচল ধরে ঘরের দিকে উঠে যায়। আমি দেখতে থাকি। বাড়িটায় দু’জন মানুষ আসায় একধরনের সংসার সংসার মনে হতে থাকে।
দিদি খুব শান্তভাবে বলে, তোর রান্নাবাড়া করবে কে?
এতদিন পর অতিথি নিয়ে আসলি বাড়িতে?-তাও আবার আমার মত অতিথি।
আমি হেসে বলি, কী খাবেন দিদি?
-কী আর খাবো!- মিঠা কুমড়া আর পুঁইশাখ নিয়ে এসে রান্না করলেই হবে।
চন্দ্রিমা ঘর থেকে চেয়ার নিয়ে এসে উঠানে দেয়।
চন্দ্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,আজ চন্দ্রিমা রান্না করবে। ওর হাতের রান্না খাবো।
চন্দ্রিমা গাল কুঁচকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে, এলাম বেড়াতে,এখন দেখছি তলাহীন সংসার?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারছি না।
দিদি বুঝতে পেরে বলে, ওর হয়তো ভাগ্যে বউ জোটেনি। তোর যেমন স্বামী জুটেও,শেষে হাতাগা চলে গেলো!- কী আর করবি সব,দু’জনের কপালই পোড়া।সবাইর ভাগ্যে সংসার জোটে না।
আমি খানিকটা অবাক হলাম,তাহলে চন্দ্রিমারও কী আমার মতই অবস্থা?
মনে মনে আবার চন্দ্রিমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি,কল্পনায় হারাতে থাকি।
ভুলে যেতে থাকি বিয়ের কথা। মেয়ে দেখতে যেতে হবে সে কথায় বড় ছেদ পড়ে যায়।