কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রশীদ সাগর

চন্দ্রালো

রাস্তার ধারে জাম গাছের নিচে,রিশা আর সালমা খেলায় মেতে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে সমানতালে। কুয়াশাতে ঢেকে দিচ্ছে প্রকৃতি। দুটি মেয়ের মাঝে সমান ভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা ও কুয়াশা।
রিশার বাবা নরেন্দ্র যায় মন্দিরে আর সালমার বাবা আব্দুল হামিদ যায় মসজিদে। একদিকে আযান হচ্ছে মাইকে অপরদিকে শাঁখ বাজছে মন্দিরে। মানুষ দু’জনও একই মাঠে, একই রোদে,একইভাবে পুড়ে পুড়ে ফসল ফলায়। গায়ের রঙও তামাটে দু’জনের। দু’জনই তাদের জন্মমাতাকে ‘মা’ বলে ডাকে,একই ভাষায় কথা বলে,একই ভাষায় গালি দেয়,একই মাটির উপর একই জলহাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। রিশা এবং সালমাও একই সাথে স্কুলে যায়, একই সাথে প্রতিযোগিতায় নামে। জয়-পরাজয়ও হয়।
আব্দুল হামিদ বলে,লাইলাহা… এবং নরেন্দ্র বলে, ভগবত…।

মানুষ মানুষের শত্রু হয় স্বার্থের কারণে। সে স্বার্থ হতে পারে অর্থ,ক্ষমতা অথবা নারী। তবে যে বীজ বপন রয়েছে মনে, তা দূর করা কঠিন। বীজটা স্বার্থ বা ক্ষমতার জন্যই আদিকাল থেকে বপন করে আসছে সমাজপতি অথবা ক্ষমতাসীনরা অথবা ধর্মব্যবসায়ীরা।
অনুভূতিতে শিশুকাল থেকেই বাবা-মা’র আদর্শ জমা হয় এবং পরিবেশ থেকে মনের জগতে বাসা বাঁধতে থাকে বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। মগজে যে চিন্তা-চেতনা প্রবেশ করে তা আর বের হতে চায় না। বের হয়নি সালমা এবং রিশার মগজ থেকেও। তারাও একজন মুসলিম তরুণী ও অপর জন হিন্দু তরুণী।
এ মূল্যবোধ ও বিশ্বাস থেকে কিভাবে মুক্ত হবে? পৃথিবীতে অন্ধ-কুসংস্কারপূর্ণ মানুষ যে নিজেকে বড় অসহায় ভাবে। আর এই অসহায়ত্বের সুযোগেই মস্তিস্কে ঘর করে থাকে সাম্প্রদায়িকতা। নরেন্দ্র এবং আব্দুল মজিদ ঘনিষ্ট প্রতিবেশি ও বন্ধুও। তবে কেন দূরত্ব বাড়ছে। রিশার যত বয়স বাড়ে তত ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। গুটিয়ে নিতে থাকে সালমাও। কোনো এক ঝড়হাওয়ায় বেড়ে ওঠা লাউডোগার মত বেঁকে যাওয়া, নূয়িয়ে পড়া কুল-কিনার না পাওয়া, দুদিকে ঝুলে পড়ার মত ঝুলে পড়ে কিশোরী রিশা ও সালমা। একজন ঘরে প্রবেশ করে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেকে কাপড় দিয়ে ঢেকে বাইরে বের হয়। অপর জন রঙিন পোষাকে সেজে পুজার ঘরে যায় সঙ্গিহীন। বড় একা লাগে রিশার।
এদিকে মৌলানার কথায় সালমা বন্দি হয় কালো পোষাকে, বোরকা ছাড়া বের হওয়া নিষেধ,মুখ ও হাত-পা কালো মোজায় ঢাকা রেখে বের হতে হয়। এদিকে দু’জনেরই প্রাণ কাঁদে,ভিতরে ভিতরে ছটফট করে।খাঁচায় বন্দী পাখির মত। বেঁধে রাখে,আদেশ উপদেশ ও নীতি বাক্য দ্বারা। -গুরুবাক্য! সেই সাথে পারিবারিক শাসণ।

কখনো আঁধারের সাথে কথা বলে, কখনো বৃষ্টির সাথে, কখনো বা মুক্ত আকাশের সাথে। এই মনে মনে কথা বলার মধ্যে কখনো নীরবে নিভৃতে প্রাণ কেঁদে ওঠে সালমা ও রিশার।
চলার পথে হঠাৎ হঠাৎ দু’একদিন দেখাও হয়ে যায়। তখন ছলছল চোখে মনের আবেগে বলে ওঠে, সই কেমন আছিস?- দু’জনকে ধরে কোলাকুলি করে। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে সোজা সদ্য জেগে উঠা বুকের উপর, পায়ের কাছে ধুলোর উপর অথবা সবুজ ঘাসের উপর। সে দীর্ঘশ্বাস দিনে দিনে দীর্ঘ হতে থাকে। রিশা সাহস করে বলতে পারে না, সই তোর মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে-রে!
অপর দিকে সালমাও মুখ ফুটে খোলামনে বলতে পারে না, সই তোকে খুব সুন্দরী লাগছে,চল দৌড়ে গিয়ে বাগানে গোল্লাছুট খেলি!দু’জনের মনোবাসনা মনে মনে গুমরিয়ে গুমরিয়ে চাপা পড়ে থাকে বুকের ভিতর।

সকাল থেকেই, ঝুমবৃষ্টি হতে হতে মেঘগুলো হারাতে থাকে আকাশের দূর অজানায়। বৃষ্টি থামে,সূর্যালো ঝলক দিয়ে ওঠে মধ্য আকাশে। তখন দুপুর। বাড়ির পাশে, নদীতে সালমা কাপড় ধুতে আসে। তখন তো আর বোরকা থাকে না শরীরে। সুডৌল দেহ ভেসে ওঠে নীল রঙের সালোয়ার কামিজের ভিতর পানির আলতো ছোঁয়ায়, মৃদু ঢেউয়ে ঢেউয়ে। ঠিক তখনই রিশা আসে হাতে-পায়ে-মুখে কাঁচা হলুূদ মেখে। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। দু’জনের মুখ দিয়ে কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে অস্পষ্ট বেরিয়ে আসে সই, ও সই…
তারপর হেসে-হেসে হয় কুটি কুটি। যেন নিজেদের সামলে নিতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে নদীর ধারে, নীরব স্রোতের কাছাকাছি। দু’জনেরই ভিজে যায় সারা শরীর। সালোয়ার কামিজ, উঠতি বয়সী শরীরটাকে চেপে ধরে,ভেজা কাপড়ের আবেগ আটকিয়ে রাখে যায় ভাঁজে ভাঁজে।
রিশা হলুদ মাখা গাল কুঁচকিয়ে হেসে বলে,কেমন আছিস সই?
দীর্ঘশ্বাস মাখা হাসিতে এড়াঠোঁটে মেলে দিয়ে সালমা বলে, ভালোই আছি,তই ঘটক হারামি, রোজ-রোজ বিয়ে বিয়ে করে আসে মায়ের কাছে। জানিস সই, মন কয় ঝাঁটা দিয়ে মারি ঘটক হারামিটাকে।
রিশা দুষ্টুমি হেসে জড়িয়ে ধরে বলে, সই আমার বড় হয়ি গিছ্।
সালমা বলে, না-রে সই, তোরা লেখাপড়া করবি আর আমু……
চোখ ভিজে আসে, কণ্ঠ জড়িয়ে আসে সালমার।
রিশা এবার মশকরা বাদ দিয়ে বলে, হয়রে সই, তুইও বিয়েটা এখন করিস না,ওদের না বলে দিস। এইবার এসএসসি পরীক্ষাটা দিয়ে দু’জন একই কলেজে ভর্তি হবো-একসাথে থাকবো।
সালমা একটু টেনে-টেনে বলে,আমারও ইচ্ছেটা তাই। কিন্তু হুজুর এসে মা’র কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে,মেয়ি বড় হয়ি গিছ্।
-বাদ দে হুজুরের কথা, বলেই সালমার হাত ধরে টেনেহিছড়ে নদীর গভীর পানির স্রোতের মাঝে দিকে নিয়ে যায়।
সালমাও কাপড়গুলো নদীর কিনারে রেখে, রিশার হাত ধরে সাঁতার দেয় মাঝনদী বরাবর।
দুজনে প্রেমপ্রিয় হাঁসের মত ডুব খেলায় মেতে ওঠে । নদীর পানির মধ্যে ডুব দিয়ে জড়াজড়ি করতে করতে ভূস করে দু’জন মাথাটা তুলে নিঃশ্বাস নেয়। অনেক দিনপর নদীর সাথে, নিজেদের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেয়।

রাত গভীর হতে থাকে। থেমে থেমে টিপটপ বৃষ্টি পড়ছে।আধাঘুম অবস্থায় সালমার কানের পর্দায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ মাঝে মাঝে মৃদু দোলা দিচ্ছে। জানালার পাশে কলা পাতায় পড়া বৃষ্টির শব্দ, সুর তোলছে যেন। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ। সালমা অলস ঘুমে উঠে গিয়ে, দরজার হাক খোলে। ঠিক তখন মেঘের কোণায় বিদ্যুৎ চুমকিয়ে আলো জ্বেলে দেয়। দেখা যায় আলোছায়ায় রিশার ভেজা মাথা ও মলিনমুখ।
অবাক হয়,অস্পষ্টভাবে বলে সই তুই!
রিশা কিছু না বলেই সালমার ঘরে ঢুকে পড়ে। বসে চৌকির উপর। সালমার গামছা টেনে নিজের মাথা মোছে। রিশার মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থা।
সালমা রিশার পাশে বসে।
রিশা মুখ খোলে,কিছু বদমাইস ছেলে দল বেঁধে বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিয়ে যাচ্ছিল। পুকুর পাড়ে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নগ্ন করার চেষ্টা করছিল। ওই সময় আমি পালিয়ে এসেছি। ওরা হয়তো আমার সর্বনাশ করতো।
সালমা বলে,ওরা কারা?
– সরকারি দলের সাথে থাকে। আমি ওদের চিনি। রিশা বলে।
খানিক থেমে আবার বলে, চেয়ারম্যান আমাদের কাঁঠাল বাগানটা নেওয়ার জন্য বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাবা রাজি হয়নি। বাবা আমাকে ও মাকে বলেছে,ভারতে চলে যাওয়ার কথা। আমরা রাজি হইনি।
সালমা এবং রিশার কথার শব্দ শুনে এগিয়ে আসে আব্দুল মজিদ।
আড়াল থেকে সবই শোনে।
রিশা বেশ শক্ত গলায় বলে,আমরা কোনোদিনও ভারতে যাবো না। প্রয়োজনে পুলিশের কাছে যাবো,পুলিশ সহযোগিতা না করলে মিডিয়ার কাছে যাবো।
সালমা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, আমিও তোর সাথে থাকবো।
এবার আব্দল মজিদ ওদের সামনে এসে বলে, দেখো মা তোমরা পারবে না। ওরা অনেক শক্তিশালী।
কথা বলা শেষ না হতেই বাইরে অন্ধকারে কিছু ছেলের আনাগোনার শব্দ শব্দ শোনা যায়।
আব্দুল মজিদ হাতে থাকা টর্চলাইট অন করে। দেখা যায় কিছু মুখ। দু’জন ছেলে এগিয়ে আসে। একজন এগিয়ে এসে হিংস্রভাবে রিশার হাত ধরে,অপরজন সালমার।
আব্দুল মজিদ চিৎকার করে ওঠে,এই হাত ছাড়,টর্চলাইট দিয়ে আঘাত করে একজনের মাথায়। পাশের ঘর থেকে সালমার মা এসে দরজার হাক তুলে নেয় হাতে। দু’জন ছেলে গালিগালাজ করতে করতে পালিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে।
মজিদ চিৎকার দিয়ে বলে,যা যা ; বলগা তোর চেয়ারম্যানকে।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে নরেন্দ্র এবং রাগে রাগে বলে, দ্যাক মজিদ তুই যদি আমার সাথে থাকিস ওরা আমাদের কিছু করতে পাইরবি না।
আব্দুল মজিদ নরেন্দ্র কে জড়িয়ে ধরে। সালমার মা রিশা ও সালমাকে দু’বাহুর মাঝে জড়িয়ে ধরে।
মেঘ ভেসে যেতে যেতে হঠাৎই চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে আকাশ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।