গারো পাহাড়ের গদ্যে মো. আরিফুল হাসান

এক পৃথিবী লেখার খাতা

হাতে মরচে পড়ে গেছে। অনেকদিন ধরে লিখি না। লিখি না মানে টুকটাক দুয়েকটা কবিতা যে লিখি না এমন না। একটানা লেখার মধ্যে ডুবে থাকতে পারিনি। এ অনেক ব্যথার, অনেক দুঃখের। অনেক ভাবনার যে, নাকের মাছি সরাতে গেলেও লেখার ডিস্টার্ব হয়, আর সবচেয়ে বেশি ডিস্টার্ব হয় ডিস্টার্ব ভাবলে। লেখককে ভাবনার জন্য অবারিত থাকতে হয়। কোনোকিছুতে তার মনোযোগ বিঘ্ন ঘটতে পারে না এমন। যেনো সবকিছু স্বাভাবিকের সাথে থেকেই স্বাভাবিক ছন্দে থাকা। অর্থাৎ লেখক সে যে ভূবনেরই হোক না কেনো, হয় ধাতব কিংবা জান্তব, —যেকোনো মুহুর্তেই তার নিজের জন্য একটি সময় থাকা আবশ্যক। এ নিজের জন্য সময়টা একেবারে আলাদা না হলেও চিন্তায় যেনো লেখক তাৎক্ষণিক ডুবে যেতে পারেন এমন মগ্নতা লেখকের থাকা চাই। তা না হলে এই বাড়ন্ত বাস্তবতার সময়ে লেখক কি করে নির্ণয় করবেন তার অলৌকিক কল্পলোকের সৌন্দর্য? তা যে বাঁধা প্রদান হয়ে যাবে বিকশিতে। আর লেখকের কল্পনার বস্তুসারও জনমনে প্রতিফলণ ঘটাবে না কারন তাতে নিবিড়তা নেই।
নিবিড়তাই সৌন্দর্য। এই নিবিড়তার জন্য আবার গুহাবাস দরকার নেই। সম্যক কোলাহলের মাঝে থেকেই নিজেকে একা জানা, একা ভাবা লেখকের স্বধর্ম। এ ধর্মের বাইরে লেখক যেতে পারেন না। যেতে হলে তাকে লেখক স্বত্ত্বার বাইরে এসে যেতে হয়। একেবারে অকল্পলোকের বাসিন্দা হয়ে কল্পলোকে, এমনকি বাস্তবলোকেও লেখক তার হৃদয়জ দহনের চিতা প্রজ্জ্বলিত রাখেন। তার সামনে তখন দুটো পথ খোলা থাকে। হয় লেখা, না হয় ভাবা। এই ভাবনার ঘোরে পড়ে গেলেও আবার লেখকের বিঘœ ঘটে। সুতরাং “এতো ভেবে জীবন চলে না।”
মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে তফাৎ থাকতে নেই। এই দূরত্ব যেমনি একটি মানুষকে অমানুষ করে তুলে তেমনি একজন লেখককে করে তুলে অপরাধী। লেখক স্বভাবতই একজন মানুষ। আর মানব মন কলুষিত হলে তার মনন যে কলুষিত হবে না এ ভাবনায় জোর দিয়ে বলা যায় না। মানুষের ক্রিয়াদি তার মনোদৈহিক সমাহিত। তাই কাজের মধ্যে সে ছাপ থেকে যাবে যা সে মানসপটে লালন করে। সুতরাং লেখকের কাজ, এবং প্রধানতর কাজ হচ্ছে লেখা এবং লেখা। নিজেকে ঘোরের মধ্যে যাচাই করার তার দরকার নেই। তার শব্দেই উঠে আসবে তার সত্যমিথ্যা।
সাধারণচোখে যে সময়টা ব্যস্ততার মনে হয়, একটু গভীর চোখে তাকালে সে সময়টাকেই নিভৃতির মনে হবে। এটি হচ্ছে একটি খেলা। এমন খেলা যে, সচরাচর এর প্রভাব লেখকমনে খেলতেই থাকবে। লেখক তার সমুদয় ব্যস্ততার ফাঁকেও নিজের কাজে অর্থাৎ তার লেখালেখিতেই মনোযোগী থাকবেন। সমগ্রতার মাঝে নিঃশব্দ আরাধনাই তার তপস্যা। নিজেকে খুলে ধরে আবার বন্ধ করার মতো অসাধারণ দক্ষতা লেখকের থাকতে হয়। লেখক মনে করেন, এ বাস্তুজগৎ, এ সবকিছুই তার কাছে মিথ্যা; একমাত্র লেখালেখিই তার কাছে সত্য। এ একটি প্রেম, এমন প্রেম যে কোনোকিছুই এর মজনুত্ব ঘোঁচাতে পারে না। সময় ও সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে লেখকের এই চিরনিবিড়তাই শেষমেষ লেখককে টিকিয়ে রাখে। অবশ্য টিকে থাকা, না থাকা নিয়ে ভাবতে গেলেও লেখকের সাধনা যথাযথ হয় না। নিবিষ্টতায় কাজ করাতেই তার অপার আনন্দ হওয়া উচিত।
একজন লেখক তার শব্দের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন। এর জন্য শব্দে শব্দে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। নিজের অন্তর্নিহিত সত্যকে চিহ্নিত করে নিজের চিরায়ত স্বভাবের ভেতর জান্তাকে ভূপাতিত করার নামই লেখক সাধনা। এ সাধনা অলিক কিংবা দৈবাৎ নয়। একেবারে নিজেকে ভাঙাগড়ার সাধনা, নিজেকে পরখ করার সাধনা। মোমবাতি জ্বালিয়ে তার শিখায় নিজের আঙুলকে পরিচালনা করার মতো শক্ত এ খেলা। এখানে শব্দ ও শষ্য একসাথে আসে। ধরা দেয় দুহাতে ছড়ায়ে। সেই গোপন প্রণয়ের ইঙ্গিত না বুঝতে পারলে লেখকজন্মের সার্থকতা বিবেচনা করা যায় না।
সময়কে সংক্ষিপ্ত করে বলতে গেলে কতোটা সংক্ষিপ্ত হওয়া যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া ভার। তবে পথসংক্ষেপকারীদের এ পথে গন্তব্য নেই এ কথা ঠিক। নেই কোনো ঠিকাদারীর কাজকারবারও। একেবারে নির্জনকোণে নিয়মনিষ্ঠ চাষবাসের মধ্যেই রয়েছে এর রৌদ্রছড়ানো ঢেউ। এর তারুণ্যের নির্যাস। যা আপাত অর্থে মনে হতে পারে অর্থহীন, কিংবা কপর্দকহীন। কিন্তু এই বিনালাভের ছাই ধরে রাখতে পারলেই একজীবনের যাপনের তেতোমিষ্টি শাঁশ চেখে দেখা যায়। এটি একটি বাজিও বটে। এক অনিশ্চিত পরিণামের দিকে নিয়ত ধাবা, এ যে বড় সাহসের কাজ, এ যে বড় সর্বনাশের কাজ। তবুও লেখকমাত্রেই সে মরণপথের আলোঅভিসারী। আর তার কংকালেও লেখা থাকবে সেই ইতিহাস, সেই ক্ষয়িষ্ণু সময়ের পরাজিত ইতিহাস —যা সে বহন করেছিলো নিজ বুদ্ধিতে এবং স্বশিক্ষায়।
এখানে লেখকদের একাডেমিক জীবনটাকে একটা কারাগার ছাড়া অন্যকিছু ভাবা যায় না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উন্মুক্ত আকাশ থেকে একজন লেখক যে দিক্ষা নেন রোদের পাঠ, নিশিচন্দ্রিমার জোৎস্নাঢুলুঢুলু নেশারাতে লেখক যে পান করেন জীবনের অমীয়, —তা তো কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয় দিতে পারে না। হ্যা, পাঠ নিতে হবে। অ আ ক খ শিখতে হবে, তা না হলে লেখক ভাষা পাবে কোত্থেকে? কিন্তু লেখকের যে বপনকৌশল তা একান্ত লেখকেরই বীজ।
“ঘরের বিছইন নিয়া অন্যঘরে” রোয়াই লেখকের কাজ। সে অজস্র লিখবে। লেখার মধ্যে অঙ্কিত হয় তার অজস্র নিঃশ্বাস। তাই তার লেখার জন্য এক পৃথিবী মনোরম খাতা হয়ে অপেক্ষা করে। যখনই সে নিজেকে অবকাশ দেবে, তখনই তার খাতার পাতা পূর্ণ হতে থাকবে। এবং একটি বিষয় আবারও মনে রাখতে হবে যে মনোযোগহীন হওয়া যাবে না আর কোনো কিছুতে বিরক্ত হওয়া যাবে না। বিরক্ত হলে লেখায় সে গভীর ক্ষতটি থেকে যায়। লেখকের উদ্বিগ্নতাও ছাপ ফেলে তার লেখায়। শারিরিক সুস্থতা অসুস্থতা, যাপিত কাহনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সুখ দুখ, জীবন ও দর্শনের প্রভাবও থেকে যায় তার লেখায়। তাই একটা মুক্ত মন নিয়ে লেখককে বসতে হয় শব্দফুলের মালা গাঁথতে। না হলে ফুল যে ছিঁড়ে যাবে, কাঁটার খোঁচায় হাত রক্তাক্ত হবে; ভালোবাসার মালা আর গাঁথা হবে না।
আর হ্যা, থামা যাবে না খুব শীঘ্রই। একটানা যতক্ষণ সম্ভব তার চেয়েও একটু বেশি সময় লেগে থাকতে হবে। না লিখতে লিখতে হাতে মরচে পড়ে যায়। এ মরচে পড়া রোগ সারানোর একমাত্র দাওয়াই লেখা। যা খুশি লেখা। নিজের ইচ্ছেমতো লেখা। কাজের অকাজের লেখা। কোনো কিছু লেখার না থাকলে নিজের চারপাশের শব্দস্বর, দৃশ্যপট লিখতে থাকা। কি হলো, না না হলো তা নিয়ে অতো ভাবলে লেখকের লেখা হয়ে উঠে না। তার একটানা লিখে যাওয়াই কাজ। নিচে আকাশ, উপরে সবুজ এক আস্ত পৃথিবী।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।