মুক্ত গদ্যে অঙ্কুশ পাল

মাধ্যমিক

ঘেমো হাতে, পেন ফসকে যেত বারবার, কাগজ আটকে যেত হাতে। বুক, ইতিউতি দুরু দুরু কেঁপে উঠতো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। পিছিয়ে পড়ার সঠিক মানে তখনও শিখিনি। বিকেলের অখন্ড অবসর কমে আসছিল, কিন্তু, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় মনের অলিন্দে নেচে ওঠতো আর একটা মন। ভেতরের মন, যে মনটা শুধু জানে আনন্দের কথা। টুকটাক লোডশেডিং হতো। এমার্জেন্সি আলো এসে গেছিল তখন, তাও কম পয়সায় কেরোসিন পাওয়া যেত বলে, হ্যারিকেন জ্বলতো। আলোর তাপে যখন কাচ ঘোলাটে হয়ে আসতো, অনেক স্বপ্ন বুনতাম তখন, টেস্টপেপার সলভ করতে করতে। রাতের আকাশ, পূর্ণিমার চাঁদ, এসব দেখতাম অন্ধকার ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে।
দু একটা গল্প পড়লে মন হালকা হতো। অভিমান বলতে মায়ের উপর, পেট ঠান্ডা থাকবে বলে রোজ ঝোল খাওয়াতো। সিনেমার শেষে নায়ক বা নায়িকা মরে গেলে কান্না পেত। হঠাৎ বাসন্তিক বৃষ্টি এলে হাত বাড়িয়ে দিতাম  বারান্দা থেকে। ওই এক দু ফোঁটা বৃষ্টি এসে হাত ছুঁলে সমস্ত মন-খারাপ উবে যেত। দোলে রং খেললে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার বারণ শুনিনি। বারণ না শোনাটা আসলে অধিকার বলে মনে হতো। ধীরে ধীরে কৃষ্ণচূড়ার ফুল রাস্তা ভর্তি করলে, মনও রঙিন হয়ে উঠতো। কালবৈশাখীর মৃদু মন্দ বাতাসে মুখর সন্ধ্যে গুলোয় হুড়োহুড়ি করতাম ছাদে। মাদুর পেতে কতদিন শুয়ে পড়েছি ওই হাওয়ায়। মাদুরে এক অদ্ভুত মায়া ছিল, গা জুড়িয়ে যেত, চোখে নেমে আসতো ঘুম।
সাইকেল চালাই নিই, কিন্তু চড়েছি অনেক। ঘুরে বেড়িয়েছি বন্ধুদের সাথে টিউশনের পর। তখন পড়তে যাওয়ার আনন্দ ছিল, বন্ধুদের সাথে দেখা হবে বলে। আজকালের মতন এত কাছাকাছি থাকা যেত না সবসময়। মেসেজ কার্ড ছিল, কিন্তু যারা প্রেম করতো, তারা জমিয়ে রাখতো, প্রানেশ বা প্রেয়সীর জন্য। অথচ এখন, ওসব প্রেমিক প্রেমিকাদের অধিকাংশেরই আর যোগাযোগ নেই একেওপরের সঙ্গে যেমন জাদুঘরের শোকেসে সাজানো কোনো বাড়ির কুলদেবতার সঙ্গে সম্পর্ক নেই ফুলের!
পাঠ্যে থাকা গল্প গুলো রিভাইসের সময়, নিজে না পড়ে, মা কে পড়ে শোনাতে বলতাম। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুনতাম কম, ঘুমাতাম বেশি। আলতো বকুনি তে ঘুম ভাঙলে দৌড়ে পালতাম অন্য ঘরে। বাবার দোকানে গিয়েও মাঝে সাঝে হুজ্জতি করতাম। ওষুধের বাক্স জুড়ে জুড়ে তৈরি করতাম ঘর। তাতে মানুষ বলতে সিরাপের শিশি। তখন মনে হতো, মানুষ তো সত্যিই সিরাপের শিশি, একজনের সংস্পর্শে এলে আরেকজন সেরে যায়; কিন্তু এখন বুঝি সংস্পর্শ মানেই সংক্রমণ!
মনে হয় এই দিন গুলোর কাছে যদি ফিরে যেতে পারতাম আবার, যে জন্মদিনের গায়ে শুধু ছুটি, পায়েস আর রজনীগন্ধা লেগে থাকতো, কী ভালোই না হতো। যে বিকেলের কাছে সাইকেল চড়ে, দিনান্তের অলস রোদ মেখে ফিরে যাওয়া যায়না, সেই সমস্ত বিকেলের নামই বোধহয় মাধ্যমিক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।