ছোটগল্পে অমিতা মজুমদার

ঘর বদল মন বদল

রাস্তার এপারের বাড়িটার তিনতলার অপলার আজ খুব মন খারাপ। না কোন ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। অপলার এমন মন খারাপ মাঝে মাঝে হয়। অপলার বাড়ির উলটো দিকের দোতলায় এতদিন একটা পরিবার ছিল। যাদের বারান্দায় এক বিশাল পায়রার খাঁচা ছিল,সেখানে অনেকগুলো পায়রা থাকত। আর ঘরে ছিল অনেক লোক । সবাই একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে থাকত। রাতে ১ টা ২ টার সময় সবাই হাতে ভাতের থালা নিয়ে খাটে , মেঝেতে,পাশে হাতলভাঙা চেয়ারে বসে গল্প করতে করতে খেত। আবার বিকেলের নাস্তা করত। সবাই একসাথে টিভি দেখত এভাবেই বসে। যে যেমন জায়গা পেত বসে পড়ত। এরই মধ্যে বাচ্চারা ঘোরাঘুরি, খেলাধুলা করত। অপলা তার বারান্দার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দেখত। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে হয়তো দেখত ওদের ডিনার পর্ব চলছে মহা ধুমধামে।
পায়রার খাঁচাটায় রোজ একজন খাবার দিত,পরিষ্কার করত। আজ দুদিন হলো ওরা চলে গেছে।
অপলার সাথে কোনো দিন কথা হয়নি। মাঝে মাঝে চোখাচখি হয়েছে। অপলা জেনেছে ওরা পাশেই ওদের নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হচ্ছিল সেই সময়টা ওরা এখানে থেকেছে।
সেকথা শুনেই অপলার চোখে দৃশ্যটা কেমন বদলে গেল। পুরোনো রঙচটা দেয়াল, স্যাঁতস্যাতে লাল মেঝেতে ছোপছোপ দাগওয়ালা এই বাড়িটার দু কামরায় থাকা মানুষগুলো এখন উঠেছে নিজেদের ঝকঝকে নতুন ঘরে। যার যার আলাদা ঘর,আলাদা সংসার।নিজের মনের মতো করে সাজানো গুছানো। কোথাও কোন জিনিষ বাড়তি ফেলে রাখা নেই। একেবারে ছবির মতো। সবার রান্নাঘর আলাদা, তাই খাবারও হয় যার যার নিজের পছন্দ মতো। এখন আর কাউকে সবার কথা ভাবতে হয়না। শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলে। আঃ কি শান্তি।
দূপুরবেলা ও বাড়ির মেজবৌ নিজের একান্ত শোবার ঘরের নতুন খাটের নরম বিছানায় শুয়ে এসিটা ফুল স্পীডে ছেড়ে ছাদের দিকে চেয়ে আপন মনে গেয়ে উঠল —”এতদিনে পেয়েছি যে আমি সেই তোমারি দেখা—-”।
ওদিকে বড়বৌ ভুল করে ভাত রেঁধেছে বেশি,ছোট দেবর খাবে,মেজ জা খাবে,ভাগ্নে খাবে ভেবে। সে ভুলে গেছে এখন সবার রান্নাঘর আলাদা।
বড় ননদ চাকুরি করে,সে তার ফ্লাট নিয়েছে পাঁচ তলায়। মেঝ দেবর নিয়েছে আট তলায়।শাশুড়ি খায় তাদের সাথে কিন্তু সে ফ্লাট নিয়েছে দোতলায়। সেখানে একা থাকবে ছোট দেবরকে নিয়ে। অন্য সবাই মায়ের ঘরে যখন যেমন ইচ্ছা যাবে। শুধু দুই ঈদ,আর পালা পার্বণে সবাই মিলে শাশুড়ির ঘরে খাবার আয়োজন করবে। বড়বৌ আর ছোট ননদ আছে চার তলায়। বাকি দশ তলা বিল্ডিং ভাড়া দেয়া। একটা কমন হলরুম আছে ছাদে।
এখানে আসার পর ছেলেমেয়েগুলোও যেন কেমন হয়ে গেল রাতারাতি। যার যার ঘরে দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যেও কথা বলেনা।
নতুন ঘর নতুন বাড়ি কিন্তু বড়বৌয়ের কিছু ভালো লাগেনা। এর মধ্যে মেঝবৌ সেজে গুজে তাদের ঘরে এল। বড়বৌয়ের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মেঝকে সে চেনেনা। একেবারে মেহমানের মতো করছে। নিজের ঘর কেমন করে কোথায় কি রাখবে,সাজাবে এসব গল্প করতেই ব্যস্ত সে। বড়বৌ একটূ কুন্ঠিত হয়ে বলে মেঝ বস চা বানাই। মেঝবৌ বলে উঠল না আপা আমি এইমাত্র কফি খেয়ে এসেছি। তোমার দেওর আসার সময় পিৎজা আর রসমালাই নিয়ে আসছিল,সে সব খেয়ে এককাপ ঘন দুধের কফি খেয়েছি। কফি আমার খুব পছন্দ। এতদিন এত মানুষের মধ্যে আলাদা করে আর কফি বানাইনি। এখন নিজের ঘর হয়েছে ,তাই ব্যবস্থা করে নিয়েছি। পাপনকে জুস দিয়েছি। আপনার দেওরের তো আবার আপনার হাতের চা বেশি পছন্দ সে হয়ত এসে পড়বে এক্ষুণি চা খেতে।
বড়বৌ নিমেষে চলে যায় বছর সতেরো পেছনে। সে যখন বৌ হয়ে আসে দোতলা বাড়িটায় সব মিলিয়ে উপর নীচে পাঁচটা ঘর ছিল। নীচে রান্না খাওয়া আর শ্বশুর শাশুড়ি থাকত। উপরে তিনটে ঘরে একটায় সে,একটায় দুই দেবর,আর একটায় ছোট ননদ। বড় ননদের বিয়ে হয়ে গেছে। সে এলে ছোট ননদ ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজে বাবা-মায়ের ঘরে মেঝেতে বিছানা করে নিত। এর পরে একসময় মেজ দেবরের বিয়ে হয় ,ছোট ভাই ঘর ছেড়ে দিয়ে বাবা-মায়ের ঘরে নীচেই বিছানা করে থাকত। ছোট ননদের বিয়ের পরে সে আবার উপরে আসে। ততদিনে শ্বশুর মারা যান। শাশুড়ির কাছে শুনেছে এই বাড়ি তারা কিভাবে একটু একটু করে বানিয়েছিল।
তখন সবকিছু অন্যরকম ছিল। বিকেলে সবাই বারান্দায় বসে কাঁচালংকা,সর্ষের তেল আর পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে নিত একটা বড় পাত্রে। আর কেৎলি ভরে ঘন দুধের গরম চা আসত পাশের গলির গনিচাচার দোকান থেকে। সবাই মাদুর বিছিয়ে বসে চা আর মুড়ি খেত। কত গল্প হত সবটার কোন মানে ছিল এমন নয়। তবু গল্প হত। ননদ দেবর মিলে গান করত। সেও গলা মিলাত। শাশুড়ি শ্বশুর কেউই তাকে বৌয়ের মতো মনে করতনা। মেয়ের মতোই দেখত।
বছর দুই আগে বড় ননদ বদলি হয়ে ঢাকায় এল। এখানেই উঠল তার দুই ছেলে মেয়ে ,স্বামীকে নিয়ে। সমস্যা শুরু হলো তখন থেকেই। সে একসাথে রান্না খাবেনা। তার আলাদা রান্নাঘর চাই। ভেতরে ভেতরে মেঝ জাও সেটাই চাইছিল। ছোট ননদও একদিন এসে বলল মা পিকলুকে এখানে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে তো ওকে স্কুলে আনা নেয়া করা যাবেনা,আমাকেও এখানেই থাকতে হবে।
তারপরে সব ভাইবোন মিলে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। তা ছাড়া এখন আর এরকম পুরোনো বাড়িতে কেউ থাকেনা বলে ছেলে মেয়েরা নিয়মিত অভিযোগ করত। মেঝবৌ আর বড় ননদ মিলেই সব ব্যবস্থা করেছে।তারা সবাই একটা করে ফ্ল্যাট পেয়েছে থাকার জন্য। একটা পেয়েছে নিজের মতো করে ভাড়া দেয়ার জন্য। নগদ টাকাও পেয়েছে যথেষ্ট পরিমান।সকলে খুবই খুশী।
বড় ননদকে এখন অফিস ফেরত সবার জন্য হাতে করে খাবার আনতে হয়না। আবার সারাদিন অফিস করার পর একগাঁদা লোকের সাথে থাকতে হয়না। নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে পারে। ছোট ননদও বেশির ভাগ সময় তার দরজা বন্ধ রাখে। সদ্য দেশের নামী স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ছেলে সকলের সাথে মিশে বখে যাক সেটা সে চায়না। বড় বৌয়ের সদ্য কলেজ পড়ুয়া যমজ মেয়েরাও খুব খুশি। নিজের ঘরে বসে নেট ইউজ করতে পারে ইচ্ছেমতো।ছোট দেওর এখন মায়ের ঘরে থেকে নিজের ঘর সাজাচ্ছে মনের মতো করে। আগামী মাসে তার বিয়ে। তনু খুবই রুচিশীল আর বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। তার যাতে কোন অসুবিধা নাহয় সে কথা মাথায় রেখে সে ঘর সাজাচ্ছে অত্যাধুনিক ভাবে।
শাশুড়ি তার একলা ঘরের বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে নিজের ফেলে আসা সময়ের ছবি আঁকছে ঘরের চারপাশের দুধ সাদা দেয়ালে।
অপলা হঠাৎ মেয়ের ডাকে চমকে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে কালোমেঘে কখন ছেয়ে গেছে পুরো আকাশটা। এক্ষুণি বৃষ্টি নামল বলে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।