ক্যাফে গল্পে অমিতা মজুমদার

বৈরি বসন্ত

শান্তা ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছে প্রায় ঘন্টা চারেক। ওর একটা ইঞ্জেকশন কিনতে হবে।যেটা ডাক্তারের লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো ওষুধের দোকান দেবে না। শান্তার দিদি দূরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে লড়ছে।সারা শরীরে এই মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। শেষ চেষ্টা চলছে যদি অলৌকিক কিছু ঘটে। নাবালক সন্তানেরা অপেক্ষা করছে মায়ের সুস্থ হয়ে ফিরে আসার।স্কুল শিক্ষক দিদির চিকিৎসায় শান্তা সর্বস্ব বাজি রেখে এই কয়েক মাস লড়ে যাচ্ছে। ডাক্তারখানায় বসে একা একা ভাবছে মানুষের অসহায়তার কথা।তারা দুই বোন এক ভাই আর মা বাবা মিলে একটা সুন্দর সুখি পরিবার ছিল। প্রাচুর্যের আধিক্য ছিল না কিন্তু আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যটুকু ছিল।বছর দশেক আগে ভাইটা পাড়ার দোকান থেকে মায়ের জন্য ওষুধ নিয়ে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। সময়ের সাথে সে শোক কিছুটা থিতু হয়ে আসে ।সকলে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে ধীরে ধীরে।বড়ো বোন বাণীর বিয়ে হয়,সে একটা সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে। বিয়ের পরপরই দুটি যমজ ছেলে জন্মায়।মা তাদের নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাইয়ের মৃত্যুশোকের ক্ষতের উপর যেন একটা মলমের প্রলেপ পড়ে। দিদি শ্বশুর বাড়ি থাকলেও কলেজে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের মায়ের কাছে রেখে যেত।শান্তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটা চাকরিতে যোগ দেয়। বেশ স্বচ্ছলতা আসে পরিবারে।
বাবার পেনশন শান্তার চাকরি মিলিয়ে সংসারে স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে।বছরখানেকের মধ্যে শান্তার জীবনেও শমীকের মতো একজন হৃদয়বান বন্ধু আসে যার সাথে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধতে বেশি সময় নেয়নি। সব মিলিয়ে শান্তা যেন সব পেয়েছির আনন্দধারায় ভাসছিল। আচমকা কালবৈশাখী ঝড়ের মতো মায়ের লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়লো।দুমাসের মধ্যে সব লেনাদেনা চুকিয়ে মা চলে গেলেন অনন্তলোকে। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর নিজেকে এক অভেদ্য নির্মোকে আড়াল করে রাখলেন। মাস তিনেকের মাথায় একটা সেরিব্রাল স্ট্রোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দুইবোন মিলে নিজেদের সংসার চাকরি সামলে বাবার দেখাশোনা করত।কিন্তু স্রষ্টার বুঝি মনে ছিল অন্য ভাবনা।তাইতো বিনামেঘে বজ্রপাতসম বাণীর শরীরেও কর্কটের আগমন ঘটলো। বাণী সবে তিন যুগ পূর্ণ করলো বয়সের ঝুলিতে।সন্তানেরা বয়ঃসন্ধির টানাপোড়েনে কিছুটা দিশেহারা।এরই মধ্যে এমন ঘন দুর্যোগের আভাস।অস্ত্রপোচার সহ চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যায় পার করে মাস তিনেকের মাথায় সর্বশরীরে কর্কটের আক্রমণে জর্জরিত সে। তারই জন্য ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থাপত্র লেখাতে এসেছে শান্তা।
ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে শান্তা মনে মনে হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে।পাঁচজনের একটা পূর্ণ পরিবারের আলো হাওয়ায় সে হেসে খেলে বেড়ে উঠেছে। তার চারপাশে ঘিরে থাকা পরিবারের আত্মজনের বলয়টা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। নিজেকে সে খুঁজে পায় সেই বলয়ের কেন্দ্রে একাকী এক বিন্দুর মতো। যার কোনো পরিধি নেই,ব্যাস নেই,জ্যা নেই।
চরাচর যখন সেজে উঠেছে বসন্তের রূপলাবণ্যে।মানবকুল আকুল হয়ে বসন্ত সমাগমে ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে আহ্বান করছে প্রিয়জনকে।শান্তা তখন এক এক করে তার প্রিয়জনদের চিরবিদায় জানানোর আয়োজনে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা করছে শেষ বাঁশি বাজার।
পরের দিনই বাবা চলে যান মায়ের কাছে অনেকটা নীরবে,একদিন পরে দিদি বাণীও সে পথে পা বাড়ায়।
এতবড়ো পৃথিবীতে স্বজনবিহীন শান্তা শমীকের হাতটা শক্ত করে ধরে ।আগামী বসন্তে সেও চায় তার আপনজন বিহীন বিন্দুকে ঘিরে ভালোবাসা আর আত্মজনের একটা বৃত্ত গড়ে উঠুক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।