২ অক্টোবর। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির জন্মদিন। এ বছর তাঁর জন্মের সার্ধ শতবর্ষ। পাঁচ বছর আগে এই দিনেই দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছ ভারত অভিযানের সূচনা করেছিলেন। স্বচ্ছতার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িকতা বর্জন, অহিংসাকে গ্রহণ ইত্যাদির ব্যাপারেও মানুষকে সজাগ ও সক্রিয় করে তোলার উপযুক্ত দিন ২ অক্টোবর। সেইসঙ্গে গান্ধিজিকে নতুন করে উপলব্ধি করার দিনও ওই ২ অক্টোবর।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন স্বচ্ছ ভারত গড়ার জন্য তাঁর জন্মদিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বেছে নেওয়ার কারণ, গান্ধিজি ভারতবর্ষকে জঞ্জালমুক্ত দেখতে চেয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সুন্দর ও স্বচ্ছ ভারতবর্ষের। চম্পারণে অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে অস্পৃশ্যদের যে-গ্রামে তিনি বাস করতেন, সেখানকার রাস্তাঘাটের জঞ্জাল নিজের হাতে তিনি পরিষ্কার করতেন। স্বচ্ছতার প্রতি তাঁর এই অনুরাগকে শ্রদ্ধা জানাতেই ভারত সরকার স্বচ্ছ ভারত অভিযানের দিন হিসাবে তাঁর জন্মদিনটিকে বেছে নিয়েছে।
স্বচ্ছতার পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে গান্ধিজির নাম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গান্ধিজি তথাকথিত পরিবেশবিদ ছিলেন না। তবে না থাকলেও তাঁর কর্মের একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল পরিবেশ। এমনকি, স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম পরিবেশকেন্দ্রিক আন্দোলনের (চিপকো আন্দোলনের) অন্যতম নেতা সুন্দরলাল বহুগুণা পর্যন্ত তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। গান্ধিজি আজ থেকে বহু বছর আগেই জল, মাটি, জঙ্গলের উপর সকলের সমান অধিকারের কথা বলেছিলেন। যে-কথার অনুরণন শোনা গিয়েছিল পরবর্তীকালে নজরুলের কলমেও — “রবি শশী তারা প্রভাত সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে — / এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে! / এই ধরণীর যাহা সম্বল, — / বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল, / সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধা সম জল, পাখীর কণ্ঠে গান, — / সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফর্মান্ — / ভগবান! ভগবান!” গান্ধিজি দেখেছিলেন, আদিবাসী ভূমিপুত্ররা এবং গরীব মানুষরা প্রকৃতির প্রতি অনেক বেশি দরদি। প্রকৃতিকে তাঁরা দেখেছেন তাঁদের পালক হিসাবে। গান্ধিজি বলেছিলেন, প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। কিন্তু মানুষ সেই প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছে তার লোভ মেটানোর কাজে। ফলে আজ তার চরম পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে সেই মানুষকেই। শুরু হয়েছে প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার পালা।
গান্ধিজির গভীর মমত্ব ছিল অস্পৃশ্যদের প্রতি। চৈতন্যদেবের ‘আচণ্ডালে কোল’ দেওয়ার মতো অস্পৃশ্যদের তিনি বুকে স্থান দিয়েছিলেন। পরম শ্রদ্ধায় তাঁদের তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। তাঁদের ঘরের খাটিয়া তাঁর কাছে ছিল পবিত্রতম আসন। মেথরকে গান্ধিজি মাতৃসমা জ্ঞান করতেন। মা যেমন শিশুকে নির্মল রাখেন, তেমনি সমাজজীবনকে নির্মল রাখেন একজন মেথর, এই ছিল মেথর সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা মিশ্রিত উপলব্ধি।
সাম্প্রদায়িকতাবাদ-বিরোধিতার প্রতিও ছিল গান্ধিজির প্রবল শ্রদ্ধা। গান্ধিজির চোখে ভারতবর্ষ কখনই শুধুমাত্র ‘হিন্দুদের দেশ’ নয়, সব সম্প্রদায়ের দেশ। সেখানে শক-হুন-পাঠান-মোগল এক দেহে লীন হয়েছে। জন্মসূত্রে হিন্দু বা মুসলমান; কিংবা জৈন বা খ্রিস্টান হওয়ার সঙ্গে ভারতীয় হয়ে ওঠার মধ্যে কোনো বিরোধ তিনি দেখতে পাননি তাঁর ধর্মচিন্তায়। তাঁর বিশ্বাস-বাণী ছিল ‘সর্বধর্মসমভাব’। গান্ধিজির স্বপ্নের ‘রামরাজ্য’ রামের রাজত্ব নয়, সুনীতির রাজত্ব।
গান্ধিজি ছিলেন অহিংসার বাণী-বাহক। তিনি জানতেন অহিংসাই যাবতীয় মানবকল্যাণের মূল, আর হিংসা হল সকল সর্বনাশের আধার। হিংসাকে তিনি পশুশক্তির (‘ব্রুট ফোর্স’) সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আর পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের জন্য শুনিয়েছিলেন অহিংসার বাণী। চেয়েছিলেন সকলকে একসূত্রে বাঁধতে। একালের কবি জয় গোস্বামী যেন গান্ধিজির কাছে শিক্ষা নিয়েই লিখেছেন — ‘অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো পায়ে …।’ অস্ত্রহীন, হিংসাহীন ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েই গান্ধিজি স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘রামরাজ্য’ স্থাপনের। আর রবীন্দ্রনাথ সেই দেশকেই বলেছিলেন ‘ভারততীর্থ’।
গান্ধিজির জন্মদিন প্রতি বছরই আসে এবং যায়; কিন্তু হিংসার অবসান আজও হয় না। বরং তার মারণ-উন্মত্ততা যেন বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে সাম্প্রাদায়িক হানাহানি। সমানে চলেছে জাতের নামে বজ্জাতির নীচতা। নির্বিচারে চলছে প্রকৃতি ধ্বংসের তাণ্ডবতা। সার্বিক এই পরিস্থিতিতে গান্ধিজিকে নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে সকলকেই। উপলব্ধি করতে হবে তাঁর মাহাত্ম্যকে। আর তাহলেই হয়তো একদিন সুকান্তের স্বপ্ন সফল হবে — এ পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।