ছোটগল্পে অসীম কুমার রায়

মাকড়সা

সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায় – এরকম তীক্ষ্ম স্পষ্ট সোজা বাক্য ছাড়া বিমানবাবু অন্য কোনো কিছুই বিশ্বাস করেন না। মৃত্যুর পর অন্য কোনো জন্ম – পরজন্ম, এসব উনার কাছে অসহায় মানুষের অসহায় কল্পনা। মৃত্যুর আগে কিছু  নেই। পরেও কিছু নেই। ঈশ্বর সেই চিন্তার বিলাস।
উনার স্ত্রী রত্না। বাৎসল্যরসে শ্রীকৃষ্ণকে গোপালরূপে পরিচর্যা করেন। কর্মচঞ্চলতায় কাটিয়ে দেন গোটা দিনটা। খুব ভোরে চা বিস্কুটে ঘুম ভাঙিয়ে স্নান সেরে গোপালের ফলমূল, মিষ্টি জল নিবেদন করেন। দুপুরে নিরামিষাশী অন্নভোগ। কোনো কোনোদিন খিচুড়ি ভোগও দেন। সন্ধ্যায় আরতি। আরতির পর লুচি, পায়েস নাতো মিষ্টি। রাতে গোপালের শয়ান। সিংহাসনের মাথার উপর টাঙানো থাকে একটা ছোট মশারি। গ্রীষ্মকালে দিন-রাত্রি এ ঘরে ফ্যান চলে। শীতকালে বেশি শীতের জন্য একটি রুম হিটারেরও বন্দোবস্ত আছে।
নারী পুরুষ বা স্বামী স্ত্রী এই দুই বৈপরীত্যে
আমাদের প্রকৃতি।
বিমানবাবু নিঃসন্তান। বিয়ের বছর বিশেক পর সন্তান অ্যাডাপ্টের একটা চিন্তা এসেছিল। কিন্তু  স্ত্রী রত্না রাজি হননি। পরবর্তীকালে সন্তান পালন,মানুষ করা, দায়িত্ব তারপর ভবিষ্যতে নিজেদের কামনা বাসনাশূন্য হওয়া অনেক বেশি কষ্টকর।
এরপর বিমিনবাবু বিশেষ এগোন নি। বামপন্থী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ উনি অফিসে শ্রমিক ইউনিয়ন করেন। অনেক ক্লাস ফোর স্টাফ সহকর্মীদের উনি ইউনিয়ন মারফত সুবিধা পাইয়ে দেন।
সেইজন্য উনি সবার প্রিয় বিমান দা। আধিকারিকরাও উনাকে সমীহ করেন। নাহলে কখন আবার জনা পনেরো স্টাফ ও তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে চেম্বারে ঢুকে পড়বেন। এর মধ্যে নিজের ডিপার্টমেন্টের স্টাফরাও থাকে। সেটাই সবচেয়ে লজ্জা লাগে। আবার নিজের কাজের জায়গায় উনি খুব কর্মঠ। কাজের সময় কোনো ফাঁকি নেই। সেইজন্য অনেক অফিসার উনাকে পচ্ছন্দ করে। ভালোওবাসে।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন। কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু  হঠাৎ একদিন রাত বারোটার পর উনার স্ত্রীর পেটে, আরাম্ভ হয় অসহ্য যন্ত্রণা। পেট থেকে বুকেও ব্যথাটা ছড়িয়ে পরে। জ্বালা করে সমস্ত শরীর। অ্যারেষ্টজাইম আর রেনটাক খাইয়েও যখন ব্যথা কমে না বিমানবাবু তখন স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল রওনা হন। হাসপাতাল পর্যন্ত আর যাওয়া হয় না, তার আগেই ট্যাক্সিতেই collapse করে। expired করে যান উনার স্ত্রী। অবশ্য হাসপাতাল পর্যন্ত যেতেই হয়। সেখানে ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ঘন্টা চারেক রাখবার পর ডেথ সার্টিফিকেট দেয়।
আত্মীয়, পড়শী, বন্ধুদের নিয়ে শ্মশানে উনি স্ত্রীর সৎকার করেন। বাড়ি আসতে, উনার স্ত্রীর বাপের বাড়ি লোক এবং নিজের বাড়ির লোক, কান্নায় ভেঙে পড়ে। বিমানবাবু চুপ। কোনো কথা বলেন না। আত্মীয়রা বলেন, মনের ভেতরে বেশি শোক জমা হলে মানুষ কথা বলতে পারেনা। উনার শ্বশুর শাশুড়ি বলেন, একটু কেঁদে হাল্কা হও বাবা। যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু  তুমি যদি এরকম করে থাক তো তার আত্মা আরো কষ্ট পাবে।
– আমি ওসব বিশ্বাস করি না মা। কষ্ট হয়তো খুব হচ্ছে। কিন্তু  কান্নাকাটি করলে তার আত্মা শান্তি পাবে, ঐসব অমানুষিক চিন্তা। বোন বলল, দাদা এরকম বৌদিকে নিয়ে বলিস না। শুনে দুঃখ লাগে। বৌদি তোকে কত ভালোবাসত!
ভাই বলল, দাদা তুই ঈশ্বর মানিস না জানি। কিন্তু  মৃত্যুর পর মৃত মানুষকে শ্রদ্ধা যার থেকে শ্রাদ্ধ কথাটা এসেছে এটা তো বিশ্বাস করিস?
– দেখ ভাই, তোর সাথে এখন এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে আমার ইচ্ছা করছে না।
উনার শাশুরি বললেন, এসব কথা এখন থাক না বাবা। কাল থেকে কত কাজ! জোগাড়-যন্ত্রর। পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলতে হবে। প্যান্ডেলওলা ডেকরেটরেকে বায়না দিতে হবে। সমস্ত কাজটা এখন ভালোই ভালোই মিটলেই হয়।
– কিসের কাজ মা? বিমানবাবু জিজ্ঞেস করেন।
– কেন, হতভাগীর পারলৌকিক কাজটা তো একটু মোটামুটিভাবে করতে হবে।
– না মা কোনো পারলৌকিক শ্রাদ্ধশান্তি ওর জন্য এ বাড়িতে আমি করব না।
শ্বশুর মশাই বললেন, সেকি বাবা এসব তুমি কি বলছ? হিন্দুর বাড়িতে মৃত্যুর পর কোনো শ্রাদ্ধশান্তি তুমি করবে না?
– না বাবা শ্রাদ্ধ শান্তির কোনো অনুষ্ঠান আমি করব না।
বোন বলল, কী বলছিস তুই দাদা!
ভাই বলল, তাহলে বুঝুন, কোন মানুষকে নিয়ে বৌদি এতদিন ঘর করছিলেন!
বিমানবাবু, কারুর কোনো কথার কোনো উত্তর দিলেন না। নিস্তব্ধ থেকে আর বেশি নিস্তব্ধটা শূন্যে ভাসতে লাগল। অনেকক্ষণ পর উনার শাশুরি প্রথম কথাটা বললেন। কাল তাহলে আমরা সকাল ৮-১০ এর লোক্যালটা ধরব। শুনছো? স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
উনার ভাই, সেই ভালো। আমিও দেখি কাল ভোরে কোন ট্রেন পাওয়া যায়। বোনকে নিয়ে ভোরের ট্রেনেই চলে যাব।
সকাল দশটার মধ্যে সব আত্মীয়রা বিদায় নিয়েছে। এখন বিকেল। গ্রীষ্মের বিকালে সূর্যের কি তাপ! ফ্যানের হাওয়ায় যেন লু বইছে। সন্ধ্যা থেকে অফিস কলিগ ও অভ্যাগতদের আসা যাওয়া শুরু হলো। সকলে মিষ্টির বাক্স আর ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। বিমানবাবু প্রস্তুত ছিলেন না। চা আর ব্রিটেনিয়া বিস্কুটেই আপ্যয়ন করলেন। অফিসাররা কেউ কেউ এসেছিলেন। অনেকেই বিমানবাবুর এই না- আনুষ্ঠানিকতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এটা একটি মৃতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের স্মরণীয় দৃষ্টান্ত – উল্লেখ করতেও ভুললেন না।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে বিমানবাবু অবসর নিয়েছেন। বছরখানেক হল।
আত্মীয় বন্ধুরাও আর বিশেষ আসে টাসে না। কাজের মাসী একবেলা সকালে কাজ করে দিয়ে যায়। রান্নার জন্য সেরকম আলাদা করে বন্দোবস্ত রাখেন নি। হোম সার্ভিসে খাবার দিয়ে যায়। বিমানবাবু প্রায় এখানে ওখানে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে থাকলে প্রচুর বই পড়েন। বাড়ির ছাদে ফুল ফল গাছপালার বিরাট প্রকৃতিকে – ছোট ছোট টবে আটকে মাথার উপর সাজিয়ে রেখেছেন।
উনার পড়ার ঘরে দুটো ঢাউস টিকটিকি। উনি নাম দিয়েছেন – টুকটুকি আর ফুকফুকি। পুরো সংসার নিয়ে গোটা বাড়ির দেওয়ালময় ঘুরে বেড়ায়।
একদিন সন্ধ্যের কিছু পরে বিমানবাবু, টিউবলাইটের আলোতে লক্ষ করলেন – তাকের উপর ওঠানো তার স্ত্রীর রেখে যাওয়া, মশারিবিহীন গোপালের সিংহাসনের উপর দুটো মাকড়সা – একটা বড় জাল তৈরি করতে উঠে পরে লেগে পরেছে। বিমানবাবু এগিয়ে যান সামনের দিকে। মাকড়সা দুটো ভয় পেয়ে দূরে সরে পরে। বিমানবাবু দেখতে থাকেন, মাকড়সার লালায় তৈরি মাকড়সার জাল – কী সূক্ষ্ম, কী মসৃণ, অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য ! পৃথিবীর কোনো শিল্পীর পক্ষে এই সূক্ষ্মতা ধরা সম্ভব নয়। কোনদিন কোনো মানুষই একাগ্রতায় বিশেষ মনযোগে এই জাল দেখেনি। বিমানবাবু ভাবেন, অনুভব করতে থাকেন, আশেপাশে খুব কাছেই, মাকড়সার জালের মতন ভেসে আছে এরকম এক সূক্ষ্ম জগত। কারুকার্যমন্ডিত, অনির্বচনীয়। তাকে দেখা যায়, শোনাও যায়। বুদ্ধি দিয়ে নয়। জ্ঞান দিয়েও নয়।
সেই এক পাগলপারা অনুভূতিতে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।