ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ২১)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

পারবা। খাইতে বইসা এক লহমা মুখে দিলেই ভকভক করে খাওয়া শুরু করে দিবা।
‘ভকভক করে খাওয়া’ লোকটার ভাষা এত বিশ্রী। আমরা চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। লোকটা বলল: রাতে ধরা ইলিশ মাছের তরকারি এনেছি। পদ্মার তাজা ইলিশের তরকারি বাপের জন্মে খাইছো? আলু আর পোটল দিয়া ঝোল ঝোল কইরা রান্না করা হইছে। খাও, খাইতে হবে। নইলে আমরা জোর কইরা খাওয়াবো। ও একেকটার মুখ চেয়ে ধরে হাঁ করাবে, আর আমি হায়ের মধ্যে মাখা ভাত ঢুকায়া দিবো। কাঁটা বাইছা মাছ দিবো।
গুল্লু বলল: আপনি কি জানেন যে, জোর করে ঘোড়াকে পানির কাছে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু সে যদি পানি না পান করে তাকে পানি পান করানো যায় না।
: তোমরা কি ঘোড়া? তোমাদের ঠিকই খাওয়াতে পারবো। মুখের মধ্যে ভাত দিয়া হাঁ করায়া রাখলে কতক্ষণ থাকবা? গিলতে হবেই।
লোকটা কি অদ্ভূত কথা বলছে! কেউ না খেলে এভাবে খাওয়ানো যায়? আমরা একটা করে প্লেট তুলে নিয়ে বসলাম। তাদের একজন প্লেটে ভাত দিয়ে গেল। আরেকজন প্লেটে দুই টুকরা আলু, দুই টুকরা পোটল, দুই চামচ ঝোল আর এক চামচ মাছ দিয়ে গেল। চামচ নাড়লো খুবই দক্ষ হাতে। একবারেই দুই টুকরা আলু, আর দুই টুকরা পোটল তুলে ফেললো। পরের বারে মাছ। পেটের বা পিঠের যে টুকরাই হোক তা বেশ চওড়া। আকমল ভাই বলেছিলেন, নদীর ইলিশ চওড়া হয়। সে কথার সত্যতা পেলাম।
খাওয়া শুরু করার আগে আমি বললাম: আমাদের সাথের দু’জনকে কি খাবার দেয়া হয়েছে?
লোকটা: কাদের কথা বলতেছো? শিশু পাচারকারীদের কথা?
: মাহাবুব ভাই আর আকমল ভাইয়ের কথা বলছি।
: তাদের তো মানিকগঞ্জ জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। অতোবড় দাগী অপরাধীদের এতটুকু থানা-হাজতে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।
কথাটা শুনে আমাদের খাবার ইচ্ছা একেবারেই উবে গেল। পেট উগরে বমি আসতে চাইলো। বুক ফেটে কান্না বের হয়ে আসতে চাইলো। মাহাবুব ভাই মানিকগঞ্জে এসেছিলেন মেয়ে দেখতে। সেই মানিকগঞ্জেই গেলেন। কিন্তু জেল-হাজতে।
লোকটা বলল: এক, দুই, তিন গুণবো আর খাওয়া শুরু করে দিবে। দেরি হলেই মুখের মধ্যে খাবার ভরে দিব।
আমি বললাম: আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে।
: বলো।
: সেই মাঝি দু’জন?
: তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখানকার চা দোকানদার, মুদি দোকানদার, ঘাটের লোকজন সবাই মাঝিদের সম্পর্কে ভালো রিপোর্ট দিলো। শেষে ছাড়া পাইছে।
গুল্লু আমাকে কুনুই দিয়ে গুতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল: দেখিস, মাহাবুব ভাই, আকমল ভাইয়েরও কিছু হবে না। যত গর্জে তত বর্ষে না। জাস্ট কিছুটা ভোগান্তি।
সত্যিই তরকারিটা অসাধরণ হয়েছে। মাছে খুব তেল। মুখে দিলে সুগন্ধে মন ভরে যায়। চিকন চালের গরম ভাতটাও বেশ। কিন্তু আমরা সেরকম খেতে পারলাম না। কেউ অর্ধেক, কেউ অর্ধেকের কম খেয়েই প্লেট ঠেলে উঠে গেলাম। অন্য সময় হলে এই তরকারি দিয়ে দুই প্লেট সাবার করে দিতাম।
সেই লোকটা গরম চোখে তাকালো আমাদের দিকে। এবার মুখ খুলল এতক্ষণ চুপ করে থাকা দ্বিতীয় লোক। মুখ খুলে আমাদের রক্ষা করল। সে বলল: যথেষ্ট খাইছো। থানা-হাজতে বইসা এর চাইতে বেশি খাওয়া কঠিন। সেই শিশু পাচারকারী দুইজন তো এতক্ষণে প্যাঁদানী খাইতে শুরু করছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। আচ্ছা, তোমরা কি এর ইংরেজিটা জানো?
শিবলু বলল: কোনটার?
: যেমন কর্ম তেমন ফেল।
: এ্যজ ইউ সো, সো ইউ রিপ।
: গুড! তোমরা তো খুব ভালো স্টুডেন্ট। এমন ভালো ভালো স্টুডেন্টদের হারামজাদারা কিডনাপ করছিলো। ওগো পাছা দিয়া গরম ডিম ঢুকানো দরকার। তোমরা কিছুদিন এখানে থাকলে তোমাদের কাছ থেকে কিছু ইংরেজি শিখে নিতে পারতাম।
: আপনি ইংরেজি শিখে কী করবেন?
: শিক্ষা কখনো বিফল হয় না। কবর থেকে দোলনা পর্যন্ত থুক্কু, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষ শিখতে পারে? কবরে যাওয়ার পর সব শিক্ষা শ্যাষ। নাট-বল্টু খুলে যাওয়া হাত-পা কোলে নিয়া বইসা থাকতে হবে। এই অবস্থায় আবার ফেরেশতারা ইন্টারভিউ নিতে আসবে। এরকম অবস্থায় প্রশ্নের জবাব দেয়া খুবই কঠিন হবে। তবে আমার ইচ্ছা আছে, দুই/একটা প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দিবো। হাউইভার, ইংলিশ ইজ এ্যান ইন্টারন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ।
লোকটা কথা শুনে আমরা হেসে ফেললাম। শিবলু হাসলো না। শক্ত মুখ করে বলল: দয়া করে আপনারা এখন যান। যাবার আগে বলে যান প্যাঁদানী কী?
: তোমার জানার প্রতি আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্যাঁদানীর ইংরেজি হল সাইজ করা। অনেক রকমের প্যাঁদানী আছে। প্রথমে যেটা করে সেটা হলো পাকানো বেত থেরাপি। একটা মোটা বেত হাতে নিয়ে আসামিকে টেবিলের উপর হাত নামাতে বলবে। হাত নামাবে আর ঠাস। আবার নামাও। আবার ঠাস। আবার নামাও। আবার ঠাস। আঙুল খুলে পড়তে চাইবে। তারপর আছে গরমপানি থেরাপি। মাথা ছাদের দিকে তুলে ধরে নাক দিয়ে গলগল করে গরম পানি ঢেলে দিবে। সবচেয়ে কঠিন হল গরম ডিম থেরাপি। পরনের কাপর তুলে…..।
: দয়াকরে আপনি যান। আপনার মুখ থেকে আর একটা শব্দ শুনতে ইচ্ছা করছে না। প্লিজ লিভ আস…।
লোকটা চলে গেল। আমরা যে যার মতো বসে রইলাম। বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছি।
ঘুম ভাঙলো সেই লোকটার ডাকাডাকিতে, যে লোকটা আমাদের ইলিশ মাছ-ভাত খাইয়েছে। আমরা আড়মোড় ভেঙে চারপাশে তাকালাম। কয়টা বাজে তা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। বৃষ্টির দিন বলে আকাশে সূর্য নেই। আমাদে হাতে নেই ঘড়ি, কাছে নেই সেলফোন। ঘরটার দেয়ালেও কোনো ঘড়ি পেলাম না। সুতরাং বুঝতে পারলাম না কয়টা বাজে।
লোকটা বলল: ওঠো ওঠো, হাগা-মুতা করে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।
লোকটার ওপর শিবলুর রাগ রয়ে গেছে। শিবলু বলল: আপনাকে তো বলে দিয়েছি যে, এখানে আর আসবেন না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।