ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৩)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

৩।।
পরদিন ভোর থেকেই বৃষ্টি। কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি না। রীতিমতো বাঘ-সিংহ বৃষ্টি। ঢাকা শহর যেন পদ্মানদী হয়ে যাবে। রাস্তা দিয়ে কলকল করে স্রোত বইতে লাগলো। অবশ্য বৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। বৃষ্টির মৌসুম। আষাঢ় মাস শেষ প্রায়। শ্রাবণ শুরু হতে যাচ্ছে।
আমরা যার যার মতো তৈরী হয়ে বসে আছি। বের হতে পারছি না। বাবা এসে বললেন: কোথায় যাবে বলে যেন ঠিক করেছো?
: বাবা, সে কথা তো তোমাকে রাতেই চার/পাঁচ বার বলেছি।
: আবার বলো। নাকি আবার বলতে সমস্যা আছে?
: সমস্যা থাকবে কেন? মামাবাড়ি যাচ্ছি।
: সাথে কে আছে?
: মাহাবুব ভাই। কঙ্কনা আপুকে দেখতে চাচ্ছে মাহাবুব ভাই। পরস্পরকে পছন্দ হলে বিয়ে হবে।
: মাহাবুব করবে বিয়ে? ও যদি বিয়ে করে তো বাংলা ভাষা থেকে ‘চিরকুমার’ শব্দটা উঠে যাবে।
: সারা জীবন এভাবে থাকবে না।
: আমার ছেলে হলে ওকে চাবুক মেরে বিয়ে করাতাম। এইরকম ভাদাইম্যাগিরি আমার সাথে খাটতো না।
বাবার কথা শুনে আমি একটু চুপসে গেলাম। আমার বিয়ের বয়স হলে বাবা আবার আমার পিঠে চাবুক মেরে আমাকে বিয়ে না করায়। বাবা বললেন: এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে কিভাবে?
: বাসে উঠতে পারলেই হয়ে যাবে।
: দেখেশুনে যেও। বিয়ের ব্যাপারে মাহাবুব একটা অপায়া। বিয়ের নাম করে বেড়িয়ে শেষে বিপদে পড়বে।
মা এসে বললেন: ছেলেটা মামাবাড়ি যাচ্ছে। আর তুমি এসে কিসব অলুক্ষণে কথা বলতে শুরু করেছো।
আমার মনেও কেমন খারাপ একটা আশঙ্কা জেগে উঠল। আষাঢ় মাস হলেও গতকালও আকাশ ছিল ঝকঝকে। সহসা বৃষ্টি নামবে এরকম আশঙ্কা কেউ করেনি। অথচ রাতের মধ্যে আকাশে এত মেঘ জমেছে! অভাগা যেদিকে যায়/ সাগরও শুকিয়ে যায়। আর মাহাবুব ভাই যেদিকে যায়/সকলই ভাসিয়া যায়।
মাহাবুব ভাইয়ের ফোন এল। মাহাবুব ভাই বললেন: শোন, জামা-কাপড়গুলো পলিথিন ব্যাগে মুড়ে তারপর ব্যাগে ভর। তারপর বের হ’। এই বৃষ্টি সাত দিনেও থামবে না। আর যদি না যাস তো বাদ দে’।
: বাদ দিবো কেন? যেতে চেয়েছি যাব। ঝর-বৃষ্টিতে বুঝি মানুষ কোথাও যায় না?
: মাথাটা পলিথিন দিয়ে মুড়ে নে’। শরীর ভিজলে সমস্যা নাই। বাসে বসলেই শুকিয়ে যাবে।
: কোথায় যাব?
: সবাইকে বলেছি, ফার্মগেট এ্যাপেক্স গ্যালারির সামনে আসতে। ওখান থেকে গাবতলির বাসে উঠব।
: আচ্ছা, আমি বের হচ্ছি।
: বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম/ ছাতা নেই হাতে
চিন্তা নেই এতটুকু/ আছে পলিথিন সাথে।
: হাহাহাহা।
এই হলেন আমাদের মাহাবুব ভাই। কি সুন্দর এক ছড়া বেধে ফেললেন। এই ছড়াটাই আমাদের সবাইকে পলিথিনের কথা মনে করিয়ে দিবে। এরকম মানুষের সাথে কে না চলতে চায়?
বাসা থেকে বের হলাম। মাথা ঢেকেছি পলিথিন দিয়ে। পলিথিনের ওপর ঠাস ঠাস শব্দে বৃষ্টি ফোটা পড়ে। শরীরে বৃষ্টি ফোটার এরকম অনুভূতি আর পাইনি। বৃষ্টি না, যেন কাঁচের ঠান্ডা গলিত টুকরো। পথে নেমে রিকশা পাওয়া গেল না। রিকশার চাকা প্রায় পুরোটাই ডুবে যাবে। এর মধ্যে রিকশা চালাবে কে? প্রায় কোমড় সমান পানিতে হাঁটি আর আতিউঁতি করে রিকশা খুঁজি।
একটা পেলাম। হলিক্রস কলেজের সামনে যেতে পারলেই হয়। তারপর অভার ব্রিজ পার হয়ে ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের ভেতর দিয়ে এ্যাপেক্স গ্যালারির সামনে যেতে পারবো। রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইলো ৩৫০ টাকা।
বিস্মিত হয়ে বললাম: তিনশ’ পঞ্চাশ! এখানে তো ৩০ টাকা দিয়ে যাই।
: আমি তো ২০ টাকাও নেই। এখন তো সাগর পারি দিতে হবে।
: তাই বলে ৩৫০ টাকা হবে? ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের বাস ভাড়া আশি টাকা।
: গেলে যান, না গেলে না যান। এই ঢলের মধ্যে ফাও কথা ভাল্লাগে না।
আমি হাঁটতে লাগলাম। এরকম বৃষ্টির মধ্যে গ্রামের লোক ডুবিয়ে ডুবিয়ে ধান কাটে, পাট কাটে, মাছ ধরতে যায়। মাহাবুব ভাইকে নিয়ে মামাবাড়ি যাচ্ছি। মনে রাখার মতো স্মৃতি থাকা দরকার। এখন কোনো গর্তে পা না ঢুকলেই হয়। ঢাকা শহর তো খোড়াখুড়ির শহর। কোথায় কোন গর্ত আছে কে জানে। গতে পা ঢুকে মোচর-টোচর লাগলে সমস্যা হবে।
কোনো সমস্যা হল না। ঠিকঠাক মতোই যথাস্থানে পৌছে গেলাম। দেখি অন্যরাও হাজির। তার মানে সবার ভেতরই যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে।
মাহাবুব ভাই বললেন: তোর এত দেরি হলো কেন?
: রিকশা খুঁজছিলাম।
: এখানে রিকশার দরকার হয়? বাংলাদেশের ছেলে না তুই?
: ক্যাঁচাল বাদ দেন। বাসে ওঠার ব্যবস্থা করেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।