: বোরখা তোমার প্রিয় পোশাক তা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।
: তাহলে সুরঞ্জনার চিঠিটা বাদ দিয়ে খাদিজা নাম দিয়ে একটা চিঠি এনে দাও।
খাদিজা নাম দিয়ে কোনো চিঠি ইস্যু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার পক্ষে সম্ভব, খাদিজার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া। আমি তাই করলাম।
খাদিজা ওদিক দিয়ে আরেকটা প্যাঁচ লাগিয়ে দিল। সুরঞ্জনা মেয়েটা হেলাল ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর থেকেই ভীষণ ক্ষেপে ছিল। রাগের কারণ, সে হিন্দু ধর্মের মেয়ে আর হেলাল ভাই ইসলাম ধর্মের ছেলে। ধর্ম ভিন্ন জেনেও সে কেন তাকে প্রেম প্রস্তাব করল? প্রেম জাত-পাত, সম্প্রদায়, ধনী-গরিব মানে না তা সুরঞ্জনা জানে। তবে সুরঞ্জনার একটা বিশ্বাস আছে যে, মসুলমান ছেলেগুলো হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে প্রেমে ফেলে, ধর্ম চেঞ্জ করে বিয়ে করে। তারপর মেয়েটার পরিবারের সাথে কঠিন ঝামেলা শুরু হয়। মেয়েটা ধর্ম চেঞ্জ করে, কিন্তু তার গোটা পরিবার তো ধর্ম চেঞ্জ করতে পারে না।
খাদিজা ২৪৩ নম্বর বাড়ির পাঁচ তলায় গিয়ে তার চিঠিটা সুরঞ্জনার হাতে দিয়ে দিল। বলল: তোমার চিঠি। হেলাল ভাই ভুল করে আমার বাসায় পৌছে দিয়েছিল।
: আমি যে হিন্দু ধর্মের মেয়ে হেলাইল্ল্যা তা জানে না?
: জানে।
: তারপরেও সে আমারে একটার পর একটা চিঠি দিতেছে ক্যান?
: এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নাই।
: তুমিও জানলা যে, হেলাইল্ল্যা আমার পিছে ঘুরতেছে।
: তাতে কোনো সমস্যা নাই। আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাব না, কাউকে কিছু বলবও না।
: আসো, চা খেয়ে যাও।
: না, এখন চা খাব না।
: সমস্যা কী? আসো……।
পাঁচ তলার ওপর থেকে সুরঞ্জনা আমাদের দলের যে কাউকে দেখলেই ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। মেয়েলি মিহি কন্ঠ। সুরঞ্জনা রবীন্দ্র সংগীত গায় বলে কন্ঠের ওপর বেশি চাপ দেয় না। তাই অনেক সময়ই তার ডাক আমাদের কানে পৌছে না। আর কখনো শুনতে পেলেও, না শোনার ভান করে চলে যাই। এক সময় সুরঞ্জনা ডাকাডাকি ছেড়ে দিল।
আমাদের মধ্যে সবচেয় বড় সমস্যায় পড়লো ফেকু। ওর বড়বোন শিলা। আমাদের শিলা আপা। ফিলোসফিতে অনার্স সেকেন্ড সেমিস্টারে আছে। সেই শিলা আপা হেলাল ভাইয়ের চিঠি পেয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড হয়ে গেল।
আমরা আশা করেছিলাম যে, শিলা আপা হেলাল ভাইয়ের প্রেম আহবানে সাড়া দিতেও পারে। কারণ হেলাল ভাইও ফিলোসোফির ছাত্র। কিন্তু তা হল না। দর্শনের প্রতি শিলা আপার যথেষ্ট আকর্ষণ থাকলেও হেলাল ভাইয়ে প্রতি তার পুরোপুরি বিকর্ষণ।
শিলার আপার রাগের আগুনের তাপ আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। শুধু পোড়ায় ফেকুকে। ফেকু বাসায় প্রবেশমাত্র শিলা আপা তেড়ে এসে চিৎকার শুরু করে দেয়: কোথায় থেকে এলি?
: বাইরে থেকে।
: বাইরে থেকে তো বুঝলাম। কার কাছ থেকে? ঐ ভাদাইম্যা হেলালের কাছ থেকে?
: আপা, মানুষ সম্পর্কে এভাবে কথা বলো কেন?
: তোকে না বলেছি, ঐ ভাদাইম্যার কাছে যাবি না।
: হেলাল ভাই লোক ভাল, প্রতিভাবান, তার আবৃত্তি শুনলে…….।
: খ্যাতা পুড়ি ওর আবৃত্তির! তোকে বলেছি, ওর কাছে যাবি না, যাবি না, যাবি না।
: তার কাছে না গিয়ে আমরা কেউ থকতে পারব না। আমরা সবাই তার শিষ্য।
: ঐ ফাজিল, শিষ্য কীরে? শিষ্য কী? যে তোর বোনকে প্রেম প্রস্তাব দেয়, তাকে তুই গুরু মানিস। থাপ্পর দিয়া তোর আক্কেল দাঁত ফেলে দিব।
: প্রেম প্রস্তাব দেয়া দোষের কিছু না। তোমাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে, তুমি সে প্রস্তার গ্রহণ করবে কি করবে না সেটা তোমার ব্যাপার। সে কি তোমাকে জোর করতেছে?
: তুই ঢাকইয়া সিনেমাগুলো ভাল করে দেখ।
: ঢাকাইয়া সিনেমা দেখব কেন?
: সেখানে তোর জন্য শিক্ষা আছে। সেসব সিনেমায় দেখবি, বোনকে কেউ প্রেম প্রস্তাব দিলে ভাই তার ঠ্যাং ভেঙে দেয়। তোর উচিত হেলালের ঠ্যাং ভেঙে দেয়া, অথচ……।
: প্রেম প্রস্তাবের জন্য কারও ঠ্যাং ভেঙে দেয়া ফৌজদারি অপরাধ।
: উরি বাবা! আইনও তো জানিস দেখছি। তুই যদি আবার ঐ লুচ্চার কাছে যাস তো……।
: আপা, প্লিজ একজন মহান মানুষকে লুচ্চা বলা ঠিক হচ্ছে না।
: যে একযোগে পাড়ার সব মেয়েকে প্রেম প্রস্তাব দেয়, সে মহান মানুষ? আমাকে মহান মানুষ শেখাস? সে একটা লুচ্চা। লচ্চা দ্য গ্রেট। বুঝেছি, বাবাকে বলে তোকে শিক্ষা না দিলে তুই ঠিক হবি না।
: ধ্যাত্তারি!
ধ্যাত্তারি বলে ফেকু ঘর থেকে বের হয়ে আবার হেলাল ভাইয়ের কাছে আসে।
দর্শনের ভেতর মনোবিজ্ঞানের কিছু আছে কি না জানি না, তবে হেলাল ভাই ফেকুর মনের খবর ধরতে পারে। হেলাল ভাই ফেকুকে বলে: বুঝতে পারছি বাসায় তোর কিছু সমস্যা হচ্ছে।
: আরে না, সমস্যা কিসের?
: শিলা বোধহয়……।
: ওর কথা বাদ দেন তো। ওর মাথায় সমস্যা আছে।
: সমস্যা!
: হু, কোনো একটা বিষয় পেলে তা নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই থাকে।
: ফিলোসফি পড়ুয়া মেয়েরা একটু অন্যরকম হয়।
: ছেলেরাও, আপনাকে দেখতেছি না। জীবনে যদি লেখাপড়া নাও করি তো ফিলোসফি পড়বো না।
: নে, চা খা। রেগে রেগে কথা বললে গলা বসে যায়। আদা-চা খেয়ে গলা ক্লিয়ার কর। আদার দশটা কার্যকরী গুণ আছে। আদা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে, আদা…..।
: আপনের তো দেখছি ডাক্তারি বিদ্যায়ও ব্যাপক নলেজ। বাঁচি আর মরি, ফিলোসফিই পড়বো।
শিলা আপা অবশেষে তার বাবার কাছে ঝেরে বিচার দিল। কোনো রাখ-ঢাক নাই। মুখস্তের মতো বলে গেল: বাবা, ঐ ভাদাইম্যা হেলাইল্ল্যা আছে না, ও একটা লুচ্চা। লুচ্চা দ্য গ্রেট। পাড়ার সব মেয়ের কাছে একযোগে প্রেমপত্র পাঠাইছে। আমাকেও একটা দিছে। আর তোমার ছেলে ঐ লুচ্চাটার পিছে পিছে থাকে। ও নাকি তার শিষ্য। তুমি যদি তোমার ছেলেকে……..।
: শান্ত হ’ মা। আমি ঐ হেলাল ছেলেটার সম্পর্কে জানি। খুবই ভাল একটা ছেলে।
: এলাকার সব মেয়েকে যে একযোগে……।
: একযোগে প্রেমপত্র দিয়েছে তা ঠিক। কোনো মেয়ের দিকে সে চোখ তুলে তাকিয়েছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। সৈয়দ সাহেবের সাথে হেলালের ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে। ছেলেটা অসাধারণ আবৃত্তি করে। ভাবছি, একদিন ওকে বাসায় এনে একটা আবৃত্তির অনুষ্ঠান করব। আগে তো মানুষ খুব সংস্কৃতিবান ছিল। বাড়িতে বাড়িতে সংগীত, আবৃত্তি ইত্যাদির জলসা হত। স্কুল, কলেজে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি হত। এখন তো……।